ভোটের প্রস্তুতিতে গতি, নানামুখী চ্যালেঞ্জে ইসি
প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৫, ২১:০৩

ছবি : সংগৃহীত
পাড়া-মহল্লার চায়ের দোকান থেকে টেলিভিশনের টকশো— সব জায়গায় এখন ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের তারিখ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ‘২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহে, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে’ বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের পর এ সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলেন তিনি। একইসঙ্গে তিনি নির্বাচনের জন্য আইনশৃঙ্খলা-সম্পর্কিত প্রস্তুতিগুলো আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর থেকেই নির্বাচন কমিশন (ইসি) ভোটের প্রস্তুতিতে আরও গতি এনেছে। তবে নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসির কাজে গতি থাকলেও নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সংস্থাটির সামনে এখনো অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
নির্বাচনের প্রস্তুতির মধ্যে রয়েছে— ছবিসহ ভোটার তালিকা হালনাগাদ, নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন, সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনাকাটা, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ এবং দেশীয় পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন। এর মধ্যে কিছু প্রস্তুতি তফসিল ঘোষণার আগেই সম্পন্ন করতে হয়, আর কিছু তফসিল ঘোষণার পর।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ ইতোমধ্যেই শেষ করেছে ইসি। যদিও জুন মাসের মধ্যে তালিকাটি প্রকাশ করার কথা ছিল, তা আইনের জটিলতায় আটকে আছে। নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, আইন অনুযায়ী প্রতি বছর ২ মার্চ ‘ভোটার দিবসে’ চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করতে হয়। কিন্তু কমিশন এখন আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। সংশোধিত আইন পাস হলে ইসি বছরের যেকোনো সময় খসড়া ও চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশের ক্ষমতা পাবে। তখন প্রতি বছর ২ জানুয়ারি খসড়া এবং ২ মার্চ চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পাশাপাশি বছরের অন্য সময়েও হালনাগাদ তালিকা প্রকাশ করা যাবে। এই আইনি প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়ায় চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশে বিলম্ব হচ্ছে।
তবে এবারই প্রথমবারের মতো প্রবাসীদের ভোটদানের সুযোগ দিচ্ছে ইসি। এই লক্ষ্যে ১৭টি দেশে এনআইডি সেবা কার্যক্রম চালু করেছে তারা। লক্ষ্য হচ্ছে, বিশ্বের ৪০টি দেশে প্রবাসী বাংলাদেশিদের এই সেবা দেওয়া। প্রবাসীদের জন্য ভোটদান পদ্ধতিও চূড়ান্ত করা হয়েছে— তারা অনলাইনে নিবন্ধন করে পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দিতে পারবেন।
প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের আগে নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনা করে ইসি। এবার নির্ধারিত সময়ে ১৪৭টি দল নিবন্ধনের আবেদন করেছে, যা বর্তমানে যাচাই-বাছাই পর্যায়ে রয়েছে। কাগজপত্র ঠিক থাকলে মাঠপর্যায়ে যাচাই শেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় ইসি। এই প্রক্রিয়াটি কয়েক মাস সময় সাপেক্ষ।
সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ ইসির সাংবিধানিক দায়িত্ব। এবার ৩০০ আসনের মধ্যে ৭৬টি আসন নিয়ে প্রায় ৭০০টির মতো আবেদন জমা পড়েছে। এসব আবেদনে সংসদীয় আসন সংরক্ষণ, পুনর্বহাল, সংযোজন ও বিয়োজনের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রচলিত আইনে ইসি এই কাজ করলেও এবার রাজনৈতিক দলগুলোর পরামর্শে একটি বিশেষায়িত কমিটি গঠনের প্রস্তাব উঠেছে। ফলে ইসি এখন সীমানা পুনর্নির্ধারণের ক্ষেত্রে এই কমিটির রূপরেখার অপেক্ষায় রয়েছে। সাধারণত এই কাজ সম্পন্নে দুই মাস সময় লাগে এবং এতে প্রশাসনিক অখণ্ডতা, ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যা, ভোটার সংখ্যা ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করা হয়।
ভোটকেন্দ্র স্থাপনও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সাধারণত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ভোটকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। একটি নির্ধারিত নীতিমালা অনুযায়ী ভোটের অন্তত ২৫ দিন আগে গেজেট আকারে ভোটকেন্দ্র চূড়ান্ত করতে হয়। দ্বাদশ নির্বাচনে ডিসি ও ইউএনওকে প্রধান করে কমিটি গঠন করে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের দায়িত্ব দেওয়া হলেও নতুন নীতিমালায় এটি আবার ইসি কর্মকর্তাদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ভোটের প্রস্তুতির আরেকটি বড় অংশ হচ্ছে নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনা। নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে ভোটের জন্য ২১ ধরনের ফরম, ১৭ ধরনের প্যাকেট, পাঁচ ধরনের পরিচয়পত্র, আচরণবিধি, প্রতীকের পোস্টার, নির্বাচন পরিচালনা ম্যানুয়েল, প্রশিক্ষণ ম্যানুয়েল ও নির্দেশিকা ছাপানোর প্রস্তুতি নিয়েছে। সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ জানিয়েছেন, সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই এসব সামগ্রী কেনাকাটা সম্পন্ন করা হবে।
নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ভোটের তফসিল ঘোষণার সময় রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। সাধারণত জেলা প্রশাসকরা রিটার্নিং অফিসার এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসার বা ইসির কর্মকর্তারা সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে কাজ করেন। ভোটগ্রহণে প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তারা থাকেন, যাদের বেশিরভাগই বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। এদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য দেশি-বিদেশি সংস্থাগুলো নিবন্ধন করে থাকে। ইসি ইতোমধ্যে ‘নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নীতিমালা ২০২৫’ চূড়ান্ত করেছে। নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, অতীতে যারা ভুয়া প্রতিবেদন দিয়েছে বা নিবন্ধন নিয়ে কার্যকরভাবে পর্যবেক্ষণে অংশ নেয়নি, তাদের নিবন্ধন নবায়ন করা হবে না। একইসঙ্গে, বিগত তিনটি নির্বাচনকে বৈধ বলে মন্তব্যকারী বিদেশি পর্যবেক্ষকদেরও এবার অনুমতি দেওয়া হবে না।
নির্বাচনে প্রার্থীদের আচরণবিধিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইতোমধ্যে ‘আচরণবিধিমালা ২০২৫’-এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে ইসি। এতে পোস্টার ব্যবহার নিষিদ্ধ, মাইক ব্যবহারে বিধিনিষেধ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারের নিয়মসহ নানা বিধান রাখা হয়েছে। বিধি লঙ্ঘনের সর্বোচ্চ শাস্তি দেড় লাখ টাকা জরিমানা নির্ধারণ করা হয়েছে।
নির্বাচনের প্রস্তুতিমুখী নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুরোদমে কাজ করলেও ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করতে হলে তাদের আরও গতিশীল হতে হবে—বলছেন বিশ্লেষকেরা। এ বিষয়ে এশিয়ান পলিটিক্যাল স্টাডিজ অ্যান্ড গুড গভর্ন্যান্সের সিনিয়র ফেলো ড. বাহারুল হাসান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা একসময় একেবারে ভেঙে পড়েছিল। এখন গণঅভ্যুত্থানের পর মানুষ আশাবাদী হয়েছে, তারা ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশায় আছে। নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে চাইছে, তবে সংসদীয় সীমানা নির্ধারণ, দল নিবন্ধন, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে ডিসেম্বরেই তফসিল ঘোষণা করতে হবে।’
এ বিষয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘ইসির প্রস্তুতির পাশাপাশি নির্বাচনের পরিবেশ ও কমিশনের ওপর আস্থা সৃষ্টি করাও জরুরি। পরিবেশ তৈরিতে রাজনৈতিক দল ও সরকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তবে কমিশনের কাজের অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক।’
নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি প্রসঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন বলেন, ‘নির্বাচনের জন্য এখনো নির্ধারিত তারিখ ঠিক হয়নি। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে পারে। এটুকুই আমরা জানি। তবে আমরা পুরো প্রস্তুতি নিচ্ছি।’ চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন আয়োজনের যত ধরণের চ্যালেঞ্জই থাকুক, আমরা তা মোকাবিলা করেই এগিয়ে যাচ্ছি। যেকোনো সময় নির্বাচনের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।’
এসআইবি/এমএইচএস