Logo

জাতীয়

অগ্নিপরীক্ষায় ইসি

মো. বাবুল আক্তার

মো. বাবুল আক্তার

প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২৫, ০৮:০১

অগ্নিপরীক্ষায় ইসি

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে নির্বাচন কমিশন (ইসি) একাধিক জটিল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য এবং ঘোষিত সময়সীমার মধ্যে প্রস্তুতি সম্পন্ন করার চাপ; এই তিনটি প্রধান চ্যালেঞ্জকে ঘিরেই এখন ইসির কর্মকৌশল নির্ধারিত হচ্ছে।

এদিকে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, বরং বাড়ছে দূরত্ব। এমন এক পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) এক কঠিন অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসির সামনে প্রধানত তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ইসি এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে নির্বাচনের জন্য কতটুকু প্রস্তুত হতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

তবে এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যেই জাতিকে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। সম্প্রতি গণমাধ্যমকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি স্বীকার করেছেন যে, পথটি কণ্টকাকীর্ণ, তবে অসম্ভব নয়। তার এই আত্মবিশ্বাস কতটা বাস্তবসম্মত এবং নির্বাচন কমিশন আসলেই এই ত্রিমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবে কি না, তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ দেখি—

ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি
নির্বাচনের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হলো স্থিতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, যা ভোটারদের নির্ভয়ে কেন্দ্রে যাওয়ার নিশ্চয়তা দেয়। কিন্তু সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতা সেই নিশ্চয়তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বড় দলগুলোর নেতা-কর্মীদের রাজপথে শক্তির মহড়া প্রায়ই সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে।

এ বিষয়ে সাবেক সেনা কর্মকর্তা বলেন, নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সব সময়ই চ্যালেঞ্জিং থাকে। কিন্তু এবার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। রাজনৈতিক বিভাজন এখন তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারের কারণে সংঘাতের স্ফুলিঙ্গ দাবানলে পরিণত হতে সময় লাগছে না। পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এ পরিস্থিতি সামাল দিয়ে, ইসির মাধ্যমে কিভাবে একটি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করবে, সেটাই চিন্তার বিষয়।

যদিও সিইসি নাসির উদ্দিন তার সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সরকার ইতিমধ্যে পুলিশ, বিজিবি, সেনাবাহিনীসহ সব বাহিনীকে প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়েছে। জনগণ যদি আমাদের সঙ্গে থাকে, কোনো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিই সমস্যার কারণ হবে না। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণও নির্ভর করে একটি আস্থার পরিবেশের ওপর, যা তৈরি করার মূল দায়িত্ব ইসি এবং সরকারের।

রাজনৈতিক অনৈক্য ও আস্থার সংকট
এবারের নির্বাচনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার পর্বতপ্রমাণ অনৈক্য। জুলাই গণহত্যার বিচার ও সংস্কার নিয়ে প্রধান রাজনৈতিক শিবিরে যে মতপার্থক্য, তা এখনো অমীমাংসিত। একটি পক্ষ নির্বাচনের আগে বিচার ও সংস্কারের দাবিতে অনড়, অন্য পক্ষ প্রয়োজনীয় কিছু সংস্কার করে আগে নির্বাচন করতে চায়। এ অবস্থার নিরসন না হলে ফেব্রুয়ারিতে কিভাবে নির্বাচন হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. আকরাম হোসেন মনে করেন, নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে রাজনৈতিক সমঝোতা তৈরি করা সম্ভব নয়। এটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। ইসি একটি নিরপেক্ষ রেফারি হিসেবে কাজ করতে পারে। তিনি আরও যোগ করেন, ‘সিইসি যখন বলেন, ‘আমি বিচারকের মতো কাজ করব’ তখন তার ব্যক্তিগত সততাকে সম্মান জানাতেই হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনকে সব দলের কাছে সেই আস্থার জায়গা তৈরি করতে হবে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত এবং জামায়াতের ‘দাঁড়িপাল্লা’ প্রতীক ফিরিয়ে দেওয়ার মতো বিষয়গুলো নিয়ে ইতোমধ্যে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তা ইসির নিরপেক্ষতাকে শুরুতেই প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।’’ এসব বিতর্কের জবাবে সিইসি নাসির উদ্দিনের অবস্থান স্পষ্ট। তিনি বিএনপি বা জামায়াতপন্থি হওয়ার অভিযোগকে 'রাজনৈতিক বক্তব্য' বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তার মতে, সময়মতো সবাই বুঝবে আমরা নিরপেক্ষভাবে কাজ করছি। কিন্তু যে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রতিপক্ষকে ব্যক্তিগত আক্রমণের মাধ্যমে ঘায়েল করার প্রবণতা রয়েছে, সেখানে সিইসির এই সরল বিশ্বাস কতটা টিকবে, তা সময়ই বলে দেবে।

সময়ের সঙ্গে দৌড় ও প্রশাসনিক প্রস্তুতি
একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ব্যাপক প্রশাসনিক প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে রয়েছে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা, প্রায় ৪২ হাজার ভোটকেন্দ্র স্থাপন ও প্রস্তুত করা, লক্ষাধিক ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ ও তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, এবং নির্বাচনি সরঞ্জাম সারা দেশে পৌঁছে দেওয়া। ডিসেম্বরে প্রস্তুতি শুরু করার কথা সিইসি বললেও, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে মাঠপর্যায়ের অনেক কাজ এখনো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

সাবেক নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নির্বাচনের দিনক্ষণ এখনো চূড়ান্ত নয়। সিইসি ফেব্রুয়ারি বা এপ্রিলের কথা বললেও সরকারের পক্ষ থেকে সবুজ সংকেত না পাওয়ায় ইসি পূর্ণ গতিতে কাজ শুরু করতে পারছে না। নির্বাচনের অন্তত ৯০ দিন আগে থেকে পুরোদমে কাজ শুরু করা না গেলে শেষ মুহূর্তে সবকিছু সামাল হু সামাল দেওয়া খুব কঠিন হয়ে পড়বে।

এর মধ্যেই প্রায় দেড়শো দেড়শো রাজনৈতিক দল নি নৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে, যা ইসির জন্য আরেকটি বড় প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ। সিইসি নিজেই স্বীকার করেছেন, অনেকের সাইনবোর্ড পর্যন্ত নেই। এই দলগুলোকে যাচাই-বাছাই করে নিবন্ধন দেওয়া এবং প্রতীক বরাদ্দ করার কাজটিও সময়সাপেক্ষ। বিশেষ করে, জাতীয় ফুল 'শাপলা' প্রতীক কোনো দলকে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত এবং জামায়াতের 'দাঁড়িপাল্লা' প্রতীক আদালতের নির্দেশে বহাল রাখার বিষয়টি ইসির প্রতীক বরাদ্দের নীতিতে জটিলতা তৈরি করেছে।

এদিকে, ক্ষমতাচ্যুত এবং রাজনৈতিক কার্যক্রম স্থগিত থাকা আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারার বিষয়টি এবারের নির্বাচনকে ঘিরে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন তৈরি করেছে। একটি প্রধান রাজনৈতিক দল ছাড়া নির্বাচন হলে তার গ্রহণযোগ্যতা দেশে ও বিদেশে কতটুকু থাকবে? এ প্রসঙ্গে সিইসি নাসির উদ্দিনের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, যদি কোনো বড় রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে, তাহলে নির্বাচন কতটা অংশগ্রহণমূলক হবে সেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

তবে তার মতে, অংশগ্রহণমূলক মানে ভোটারদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আকরাম হোসেন এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দুটি দিক রয়েছে। একটি হলো ভোটারদের উপস্থিতি, অন্যটি হলো প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ। দ্বিতীয়টি ছাড়া প্রথমটি নিশ্চিত করা প্রায় অসম্ভব। একটি একতরফা নির্বাচনে ভোটারদের আগ্রহ থাকে না, যা আমরা অতীতেও দেখেছি। তাই সব দলের জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করে তাদের নির্বাচনে আনতে পারাই হবে ইসির সবচেয়ে বড় সাফল্য।

অন্যদিকে, নানা প্রতিকূলতা ও সমালোচনার মুখে সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন তার দায়িত্বকে 'জীবনের শেষ পর্যায়ে বড় একটি চ্যালেঞ্জ' হিসেবে নিয়েছেন। তিনি যে হাসিমুখে দায়িত্ব শেষ করতে চান, তা তার ব্যক্তিগত সততা ও দৃঢ়তার পরিচায়ক। কিন্তু তার এই ব্যক্তিগত ইচ্ছা একটি সফল নির্বাচনে রূপান্তরিত হবে কিনা, তা নির্ভর করছে বহুলাংশে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং ইসির প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার ওপর। জাতি এখন তাকিয়ে আছে, নির্বাচন কমিশন এই অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে দেশকে একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক পথে এগিয়ে নিতে পারে নি, সেই উত্তরের আশায়।

ড. আমেনা মোহসিন বলেন, এই বছর রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত ঘটনাবহুল হতে যাচ্ছে। সংস্কার ও ঐকমত্যের জন্য ধৈর্য, সহনশীলতা ও সংযম প্রয়োজন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে আরপিও (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ) সংস্কার জরুরি। রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতি ছাড়া কোনো সংস্কার কার্যকর হবে না।

  • এটিআর

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

সংসদ নির্বাচন নির্বাচন কমিশন নির্বাচন

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর