মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি : শোকে উত্তাল দেশ, জবাবদিহিতার মুখোমুখি রাষ্ট্র

বাংলাদেশের প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২২ জুলাই ২০২৫, ২১:৫০
-687fb338b3a11.jpg)
ছবি : বাংলাদেশের খবর
রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দেশজুড়ে বইছে শোক, ক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঝড়। এই হৃদয়বিদারক ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ জনে। তাদের বেশিরভাগই স্কুল-কলেজের কোমলমতি শিক্ষার্থী ও শিক্ষক। এখনো অনেকেই মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন হাসপাতালের শয্যায়।
গতকাল সোমবার (২১ জুলাই) দুপুরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান দিয়াবাড়ীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিধ্বস্ত হলে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে আগুন। ছাদে পড়া বিমানটির আগুন নিমেষেই ছড়িয়ে পড়ে ক্লাসরুমগুলোতে। অনেক শিক্ষার্থী ঘটনাস্থলেই নিহত হন, বাকিরা হাসপাতালে নেয়ার পর মারা যান। আজ মঙ্গলবার (২২ জুলাই) সারাদিন হাসপাতালগুলোতে স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দগ্ধদের মধ্যে অনেকের অবস্থাই আশঙ্কাজনক, ফলে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
বিমানের দুর্ঘটনার পরদিন সকাল থেকেই রাজধানীর সচিবালয় ও মাইলস্টোন কলেজ এলাকায় শুরু হয় বিক্ষোভ। দুপুরের দিকে সচিবালয় এলাকায় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ রূপ নেয় ক্ষোভে। ‘শিক্ষালয়ে যুদ্ধবিমান কেন?’, ‘কার গাফিলতিতে এত প্রাণ গেল?’— এমন নানা প্রশ্নে মুখর হয় তারা। একপর্যায়ে সচিবালয়ের ফটকে জড়ো হয়ে শিক্ষার্থীরা ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর ও অবরোধ শুরু করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সংঘর্ষও ঘটে, কয়েকজনকে মারধরের ঘটনাও ঘটে। সচিবালয়ে আটকে পড়েন অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী।
অন্যদিকে মাইলস্টোন স্কুলে শিক্ষার্থীরা অবরুদ্ধ করে রাখেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবসহ দুই উপদেষ্টাকে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম, আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল এবং শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সি আর আবরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে পরিদর্শনে যান। ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর পর শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মধ্যে পড়েন তারা। শিক্ষার্থীরা ৬ দফা দাবি তুলে ধরেন। তাদের কিছু দাবি মেনে নেওয়া হলেও সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত উপদেষ্টাদের অবস্থান নিয়ে তৈরি হয় ধোঁয়াশা। অবশেষে রাত ৮টার দিকে জানা যায়, তারা শিক্ষার্থীদের অনুমতিতে ক্যাম্পাস ছেড়ে মেট্রোরেলে উত্তরা ত্যাগ করেছেন।
সচিবালয়ের বিক্ষোভ শেষে শিক্ষার্থীরা গুলিস্তান জিপিও মোড়ে অবস্থান নেন। সেখানে পুলিশের সঙ্গে ফের সংঘর্ষ হয়। এ সময় পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। সংঘর্ষে আহত হন অন্তত ৮৫ জন শিক্ষার্থী, যাদের অনেকেই পরে ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পুলিশ বেশ কয়েকজনকে আটকও করে। আন্দোলনের মধ্যে বহিরাগতদের উপস্থিতিও চোখে পড়ে। তাদের অনেকের কাছেই পরিচয়পত্র ছিল না এবং জিজ্ঞাসাবাদে ফুটপাতের দোকানি বলে পরিচয় দেন।
এদিকে, দগ্ধদের উন্নত চিকিৎসায় সিঙ্গাপুর থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল ঢাকায় এসে পৌঁছেছে। তারা বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসায় সহায়তা করছেন। পাশাপাশি ভারত থেকেও বার্ন নার্স ও ওষুধ পাঠানো হচ্ছে বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বিধ্বস্ত হওয়া বিমানের পাইলট স্কোয়াড্রন লিডার ইফতেখার হোসেনের দাফন আজ পারিবারিক কবরস্থানে সম্পন্ন হয়েছে। তবে তার মৃত্যুর সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি।
বিমান দুর্ঘটনার কারণে আজকের (মঙ্গলবার) এইচএসসি ও সমমানের সব পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে, যার ফলে প্রায় ১২ লাখ শিক্ষার্থীর পরীক্ষায় প্রভাব পড়েছে।
সরকার আজ রাষ্ট্রীয় শোক পালন করেছে। দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয় এবং সকল সাংস্কৃতিক ও সরকারি কর্মসূচি স্থগিত করা হয়।
এ ঘটনায় হতাহতের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ, শিক্ষা উপদেষ্টার পদত্যাগসহ নানা দাবিতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। আজ ময়মনসিংহ, বগুড়া, নওগাঁ, বরিশাল, কুমিল্লা, যশোর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, রাজশাহীসহ অিনেক জেলায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ হয়েছে।
তবে শোকের পাশাপাশি আজ প্রকাশ পেয়েছে তরুণ সমাজের তীব্র প্রশ্ন ও প্রতিক্রিয়া। আন্দোলনরত একাধিক শিক্ষার্থী বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘এটি কেবল শোক পালনের নয়, বরং এটি হতে হবে জবাবদিহিতার দিন।’
তাদের প্রশ্ন—‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাদে যুদ্ধবিমান পড়ল কীভাবে?’, ‘বিমানের রুট কাদের অনুমোদনে স্কুলের উপর দিয়ে নির্ধারিত হলো?’, ‘এই প্রাণহানির দায় রাষ্ট্র নেবে কি?’
শিক্ষার্থীরা বলছেন, শোকপ্রকাশ নয়—তারা চান জবাব, বিচার ও ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে রাষ্ট্রের দৃশ্যমান অবস্থান। না হলে এই শোকই রূপ নিতে পারে আরও বড় আন্দোলনে। মাইলস্টোন, সচিবালয় ও গুলিস্তানসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আজ দেখা দেওয়া আন্দোলনের ঝড় তারই পূর্বাভাস।