Logo

জাতীয়

তৃণমূল গণতন্ত্রে নতুন দিগন্ত

মো. বাবুল আক্তার

মো. বাবুল আক্তার

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৫, ১২:০৫

তৃণমূল গণতন্ত্রে নতুন দিগন্ত

দেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা হলো। ব্যাপক আলোচনা ও পর্যালোচনার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার স্থানীয় সরকার নির্বাচন থেকে দলীয় প্রতীক বাদ দেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) তার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটি যদি আন্তরিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয় এবং নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষভাবে কাজ করে, তবে রাজনীতির বিকেন্দ্রীকরণ, স্থানীয় নেতৃত্বের বিকাশ এবং সহিংসতামুক্ত নির্বাচনি পরিবেশ গঠনে এটি হবে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক। তৃণমূল থেকে জাতীয় রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণে এই সিদ্ধান্ত এক নতুন সূচনা এনে দেবে।

সভা শেষে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া তার ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এক পোস্টের মাধ্যমে এ বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচনে থাকছে না দলীয় প্রতীক। উপদেষ্টা পরিষদ বৈঠকে স্থানীয় সরকার বিভাগ কর্তৃক উত্থাপিত এ সংক্রান্ত চারটি আইনের সংশোধনী অনুমোদন করা হয়েছে।’

এই সিদ্ধান্তের ফলে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচন আগামীতে সম্পূর্ণ নির্দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে প্রার্থীরা ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, কোনো রাজনৈতিক দলের পরিচয় বা প্রতীক নিয়ে নয়। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার প্রায় এক দশক আগে আইন সংশোধন করে স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে দলীয় প্রতীকের আওতায় নিয়ে এসেছিল।

এই সিদ্ধান্ত বাতিলের মাধ্যমে দেশের তৃণমূল পর্যায়ের রাজনীতিতে সংঘাত, বিভেদ এবং কেন্দ্রীয় রাজনীতির অসুস্থ প্রভাবমুক্ত এক নতুন অধ্যায়ের সুচনা হবে বলে আশা করছেন বিশ্লেষকরা। উপদেষ্টা পরিষদের গতকালের বৈঠকটি একটি শোকাবহ আবহে শুরু হয়। সম্প্রতি মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণে একটি শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় এবং তাদের আত্মার প্রতি সম্মান জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনায় বিশেষ মোনাজাতও করা হয়।

বৈঠকে দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবার ও আহতদের চিকিৎসায় সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে, নিহত দুই শিক্ষিকা মাহরীন চৌধুরী ও মাসুকা বেগমকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদানের এবং আজ শুক্রবার দেশব্যাপী সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

বৈঠকে চারটি সংশোধনী আইন অনুমোদন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে,  স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন, স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন, স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) আইন এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিধিমালা আইন সংশোধন করা হয়েছে। এসব আইনে দলীয় প্রতীক সংক্রান্ত বিধান ব্যতিল করা হয়েছে এবং নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ, প্রতীকহীন নির্বাচন আয়োজনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

দলীয় প্রতীকের তিক্ত অভিজ্ঞতা
বিগত কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদ এবং পৌরসভা নির্বাচন ছিল চরম সহিংসতায় ভরা। অধিকাংশ জায়গায় প্রার্থীদের মনোনয়ন পেতে হুমকি, দলীয় দখলবাজি, মনোনয়ন বাণিজ্য, এমনকি স্থানীয় নেতৃত্বের অবমূল্যায়ন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ২০২১ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ঘিরে, সহিংসতায় ৬৫ জনের বেশি প্রাণ হারান। ১ হাজার ২০০টির বেশি জায়গায় সহিংসতা ও জাল ভোটের অভিযোগ উঠে। বহু জায়গায় একক প্রার্থিতা ও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়, যা নির্বাচন ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করে।

স্থানীয় নির্বাচন হয়ে উঠেছিল ক্ষমতাসীন দলের অনুগতদের পুরস্কৃত করার একটি প্ল্যাটফর্ম। অনেক স্থানীয় নেতাকর্মী অভিযোগ করেছিলেন, দলীয় প্রতীকের কারণে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলগুলোর প্রার্থীরা জনসমর্থন থাকার পরেও মনোনয়ন পাননি। প্রার্থী বাছাইয়ে গণতান্ত্রিকতার ঘাটতি বেড়েছিল। ২০১৫ সালের পূর্বে বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো নির্দলীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হতো। প্রার্থীরা স্বতন্ত্র পরিচয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন এবং ভোটাররা এলাকার উন্নয়ন, প্রার্থীর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি, সততা ও যোগ্যতাকে মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করতেন। তখন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সামাজিক উৎসবের আমেজ বিরাজ করত।

কিন্তু ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগ সরকার স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন, স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) আইন, স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন এবং স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন সংশোধন করে মেয়র/চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের বিধান চালু করে। এর পেছনের যুক্তি ছিল, রাজনৈতিক দলগুলোই যেহেতু রাষ্ট্র পরিচালনা করে, তাই তৃণমূল পর্যায়েও তাদের পরিচয় ও জবাবদিহিতা থাকা উচিত। কিন্তু বাস্তবে এর ফলাফল হয়েছিল ভয়াবহ। দলীয় প্রতীক যুক্ত হওয়ার পর থেকেই স্থানীয় নির্বাচন তার ঐতিহ্যগত চরিত্র হারিয়ে ফেলে। এটি জাতীয় নির্বাচনের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণে পরিণত হয়, যেখানে এলাকার উন্নয়ন বা প্রার্থীর যোগ্যতা ছাপিয়ে দলীয় পরিচয় ও জাতীয় রাজনীতির হিসাব-নিকাশ মুখ্য হয়ে ওঠে। এর ফলে উদ্ধৃত অনিয়ম ও সমস্যাগুলো ছিল বহুমুখী।

দলীয় প্রতীকের অন্তর্ভুক্তি স্থানীয় সমাজকে রাজনৈতিকভাবে খাড়াখাড়ি বিভক্ত করে ফেলে। একই দলের বিদ্রোহী প্রার্থী এবং বিরোধী দলের প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর ও প্রাণহানির ঘটনা প্রতিটি নির্বাচনে সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়। নির্বাচন পরিণত হয় জীবন-মরণ লড়াইয়ে।

মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণে যোগ্য ও সৎ ব্যক্তিরা অনেক সময় দলের মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হতেন। মনোনয়নকে কেন্দ্র করে প্রভাবশালী নেতা ও সুবিধাভোগী মহলের মধ্যে বিপুল অঙ্কের টাকার লেনদেন বা ‘মনোনয়ন বাণিজ্য’ একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। এতে তৃণমূলের প্রকৃত জনপ্রিয় প্রতিনিধিরা পিছিয়ে পড়েন। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল উদ্দেশ্য স্থানীয় সমস্যার সমাধান করা। কিন্তু দলীয় প্রতীক চালু হওয়ায় প্রার্থীরা স্থানীয় ভোটারদের চেয়ে নিজ দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সন্তুষ্ট রাখাকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। ফলে স্থানীয় উন্নয়ন এজেন্ডা চাপা পড়ে যেত কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক কৌশলের নিচে।

প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে ক্ষমতাসীন দল প্রায়শই স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করত। কেন্দ্র দখল, জাল ভোট প্রদান এবং বিরোধী প্রার্থীদের এজেন্টদের বের করে দেওয়ার মতো ঘটনা অহরহ ঘটত।

যুগ যুগ ধরে পাশাপাশি বসবাস করা প্রতিবেশীরা শুধুমাত্র ভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থক হওয়ার কারণে পরস্পরের শত্রুতে পরিণত হতো। নির্বাচন পরবর্তী সময়েও এই রেশ থেকে যেত, যা সামাজিক সম্প্রীতি ও স্থিতিশীলতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করত। আর সংঘাতপূর্ণ ও ব্যয়বহুল নির্বাচনি প্রক্রিয়ার কারণে অনেক সৎ, যোগ্য এবং সামাজিকভাবে সম্মানিত ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ফলে রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের পথ আরও প্রশস্ত হয়।

নির্দলীয় ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন
উপদেষ্টা পরিষদের এই সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা তৃণমূল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পথে একটি অত্যন্ত ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। তারা মনে করছেন, এই পরিবর্তনের ফলে বেশ কিছু ইতিবাচক দিক উন্মোচিত হবে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. আসিফ শামসুল ইসলাম মনে করেন, এই সিদ্ধান্তে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা ফিরবে। কারণ, দলীয় বিভাজন না থাকায় নির্বাচনি সহিংসতা বহুলাংশে কমে আসবে এবং একটি শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হবে।

এ ছাড়া এখন থেকে প্রার্থীর ব্যক্তিগত পরিচিতি, সামাজিক কর্মকাণ্ড, সততা ও উন্নয়ন পরিকল্পনা ভোটারদের কাছে মূল বিবেচ্য বিষয় হবে। এতে করে তৃণমূল থেকে সত্যিকারের জনপ্রিয় ও যোগ্য নেতৃত্ব উঠে আসার সুযোগ তৈরি হবে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কেন্দ্রীয় রাজনীতির চাপের পরিবর্তে এলাকার রাস্তাঘাট, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পয়ঃনিষ্কাশনসহ বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগ দিতে বাধ্য থাকবেন।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. নওশাদ আহমেদ বলেন, যদিও অর্থ ও পেশিশক্তির প্রভাব রাতারাতি বন্ধ করাও কঠিন হবে। তবে এ সিদ্ধান্তের ফলে রাজনৈতিক দলের কঠোর বলয়ের বাইরে থাকা সাধারণ নাগরিক, সমাজকর্মী এবং সৎ ব্যক্তিরা নির্বাচনে অংশগ্রহণে উৎসাহিত হবেন, যা গণতন্ত্রের ভিত্তিকে আরও মজবুত করবে। আর দলীয় প্রতীক না থাকায় প্রার্থীদের নির্বাচনি ব্যয় অনেকাংশে কমে আসবে বলে আশা করা যায়। এতে কালো টাকার প্রভাবও নিয়ন্ত্রিত হতে পারে।

চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থাদলীয় প্রতীক বাতিল করা হলেও এর সুফল পুরোপুরি পেতে কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো পর্দার আড়াল থেকে 'সমর্থিত প্রার্থী' দিয়ে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করতে পারে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। নির্বাচনি আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ এবং আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যে কোনো ধরনের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করার পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে।

সর্বোপরি, উপদেষ্টা পরিষদের এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের ভঙ্গুর গণতন্ত্রকে তৃণমূল থেকে শক্তিশালী করার একটি আন্তরিক প্রয়াস। এর সফল বাস্তবায়ন নির্ভর করবে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন এবং সর্বোপরি জনগণের সচেতন অংশগ্রহণের ওপর। যদি এই ব্যবস্থা সফল হয়, তবে এটি হতে পারে সংঘাতমুক্ত, উন্নয়নমুখী এবং জনগণের সত্যিকারের ক্ষমতায়নের পথে একটি মাইলফলক, যা দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসবে।

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

সংসদ নির্বাচন নির্বাচন

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর