-6885c18f05841.jpg)
চব্বিশের ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ এখন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতিপর্বে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) যখন একটি আধুনিক ও কঠোর আচরণবিধি প্রণয়নের মাধ্যমে স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করতে চায়, তখন মাঠের বাস্তবতা তুলে ধরছে এক জটিল রাজনৈতিক ও প্রযুক্তিগত চিত্র। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির অপব্যবহার, রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিরোধ এবং ডানপন্থি শক্তির উত্থান-সব মিলিয়ে এবারের নির্বাচন হয়ে উঠেছে এক অভূতপূর্ব গণতান্ত্রিক পরীক্ষা।
এদিকে নির্বাচন কমিশন (ইসি) রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের জন্য আচরণ বিধিমালা-২০২৫-এর খসড়া চূড়ান্ত করেছে। এই খসড়া নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বেসরকারি সংস্থা এবং ব্যক্তিপর্যায়ে ৪৩টি মতামত ও সুপারিশ জমা পড়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) উল্লেখযোগ্য প্রস্তাব দিয়েছে। এই প্রতিবেদনে আচরণ বিধিমালার খসড়া, এআই ও সামাজিক মাধ্যমের অপব্যবহার এবং রাজনৈতিক গতিশীলতার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের নির্বাচনি সংস্কারের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
অন্যদিকে এআই’র মতো আধুনিক প্রযুক্তিকে ‘অস্ত্রের চেয়েও ভয়ংকর’ হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। নির্বাচনকালীন সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডানপন্থি রাজনীতির উত্থান নিয়ে দেশের অন্যতম বৃহৎ দল বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের উদ্বেগ। সব মিলিয়ে নতুন বিধিমালা, প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ এবং জটিল রাজনৈতিক সমীকরণের মধ্যে দাঁড়িয়ে এক অভূতপূর্ব নির্বাচনের অপেক্ষায় দেশ।
নতুন আচরণবিধি
আসন্ন নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ করার লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন ‘রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা-২০২৫’র খসড়া চূড়ান্ত করেছে, যা বেশ কিছু যুগান্তকারী পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহর বক্তব্য অনুযায়ী, পরিবেশবান্ধব প্রচারণার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনগুলোর মধ্যে রয়েছে- পরিবেশ দূষণ রোধে কাগুজে পোস্টার ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর বদলে প্রার্থীরা ব্যানার, ফেস্টুন এবং নির্দিষ্ট স্থানে বিলবোর্ড ব্যবহার করতে পারবেন। মাইকে প্রচারণার সময় শব্দের মাত্রা ৬০ ডেসিবেলের মধ্যে সীমিত রাখার বিধান যুক্ত করা হয়েছে, যা জনজীবনে স্বস্তি আনবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের সরকারি সুবিধা ব্যবহার করে নির্বাচনি প্রচারণায় অংশগ্রহণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। আচরণবিধি লঙ্ঘনের শান্তি হিসেবে জরিমানা ৫০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণার ক্ষেত্রে বিদেশি অর্থায়ন নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং এর ব্যবহারকে একটি সংজ্ঞার আওতায় আনা হয়েছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দলকে আচরণবিধি মেনে চলার জন্য অঙ্গীকারনামা দিতে হবে, যা এবারই প্রথম যুক্ত হলো। প্রতিটি আসনে রিটার্নিং অফিসার কর্তৃক আয়োজিত একটি সাধারণ প্লাটফর্ম থেকে সব প্রার্থীকে নিজ নিজ ইশতেহার ঘোষণার ব্যবস্থা করা হবে।
তবে ইসির এই খসড়া নিয়ে অংশীজনদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। বিএনপি ইসির অধিকাংশ প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হলেও মহাসচিবের হেলিকপ্টার ব্যবহার এবং প্রতিটি ওয়ার্ডে ক্যাম্পের সংখ্যা বাড়ানোর মতো কিছু দাবি জানিয়েছে। অন্যদিকে, বিকল্পধারা বাংলাদেশ বিলবোর্ড ব্যবহারের বিরোধিতা করে বলেছে, এটি বিত্তবান প্রার্থীদের অনৈতিক সুবিধা দেবে এবং নির্বাচনি ব্যয় বাড়াবে।
ইসির চ্যালেঞ্জ
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ইসির খসড়া আচরণবিধিতে ব্যাপক ব্যাপক পরিবর্তনের সুপারিশ করে একে আরও শক্তিশালী করার আহ্বান জানিয়েছে। টিআইবির মতে, খসড়ার বেশ কিছু ধারা অস্পষ্ট এবং এতে নির্বাচনি অর্থায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেই। তাদের প্রধান সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে, প্রার্থীদের হলফনামায় দেওয়া সম্পদ ও আয়ের তথ্য যাচাইয়ে একটি অটোমেশন পদ্ধতি চালু এবং সেই তথ্য জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা। নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য একটি পৃথক ও কঠোর আচরণবিধি প্রণয়ন, কারণ বিগত নির্বাচনগুলোতে এদের একাংশের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ ছিল। দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নির্বাচনে মনোনয়ন না দেওয়ার বিধান যুক্ত করা। ধর্মীয় সমাবেশ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা কনসার্টের মাধ্যমে নির্বাচনি প্রচারণা চালানো নিষিদ্ধ করা। নির্বাচন-পূর্ব অনিয়মের অভিযোগ ফলাফল গেজেট আকারে প্রকাশের আগেই তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা।
রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের এত ভিন্নধর্মী ও ব্যাপক সুপারিশ পর্যালোচনা করে, একটি চূড়ায় ও গ্রহণযোগ্য আচরণবিধি তৈরি করা নির্বাচন কমিশনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে।
নির্বাচনের নতুন আতঙ্ক
প্রযুক্তিগত দিক থেকে এবারের নির্বাচন সম্পূর্ণ নতুন এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন নিজেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) অপব্যবহারকে ‘অস্ত্রের চেয়েও ভয়াবহ’ হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি খুলনায় এক মতবিনিময় সভায় বলেন, ‘নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে যে কোনো ধরনের প্রযুক্তিনির্ভর হস্তক্ষেপ রোধে কমিশন সতর্ক রয়েছে।’
সিইসির এই উদ্বেগ অমূলক নয়। বিএনপি তাদের প্রস্তাবে স্পষ্টভাবে এআই দিয়ে তৈরি বিকৃত কনটেন্ট, ঘৃণাত্মক বক্তব্য ও ভুল তথ্য প্রচার নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছে। টিআইবিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা যুক্তের সুপারিশ করেছে, যেখানে এআই’র অপব্যবহার রোধে প্রার্থী ও দলকে দায়ী করার বিধান থাকবে। ডিপফেক ভিডিও, বিকৃত অডিও এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে নির্বাচনের ৪৮ ঘণ্টা আগে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে তোলার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই ডিজিটাল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা ইসির জন্য এক অগ্নিপরীক্ষা হবে।
রাজনৈতিক অঙ্গন
নির্বাচনি বিধিমালার পাশাপাশি রাজনৈতিক মাঠের পরিস্থিতিও বেশ জটিল। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনের অবসানের পর যে জাতীয় ঐক্যের প্রত্যাশা করা হয়েছিল, তা এখন অনেকটাই ম্লান। সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে গণ-অভ্যুত্থানের শরিকদের মধ্যেই দেখা দিয়েছে বিভক্তি। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে এই বিভক্তিকে ‘নির্বাচনি কৌশল’ বলে লঘু করার চেষ্টা করলেও এর গভীরতা অস্বীকার করার উপায় নেই। ক্ষমতার ভারসাম্য, নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচন এবং উচ্চকক্ষের গঠন নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য স্পষ্ট। কিছু দল ‘সংস্কার ছাড়া নির্বাচনে নয়’-এমন কঠোর অবস্থানে থাকলেও বিএনপি মনে করে, গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক সংস্কারগুলো নির্বাচিত পার্লামেন্টের হাতেই ছেড়ে দেওয়া উচিত।
তবে এর চেয়েও বড় উদ্বেগের কথা শুনিয়েছেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থিদের উত্থান দেখছি, আমি উদ্বিগ্ন। তার মতে, আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক বিএনপির মতো একটি উদারপন্থি গণতান্ত্রিক দলকে দমন করার ফলে যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে, সেই সুযোগে গণতন্ত্রে অবিশ্বাসী শক্তিগুলোর উত্থান ঘটছে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, এসব দল ক্ষমতায় এলে নারীর ক্ষমতায়নসহ দেশের প্রগতিশীল অর্জনগুলো হুমকির মুখে পড়বে।
ফখরুল আরও অভিযোগ করেন, একটি মহল দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি করে নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে। তার মতে, পতিত স্বৈরাচারী শক্তি দেশের বাইরে থেকেও ষড়যন্ত্র করছে। এই প্রেক্ষাপটে তিনি ফেব্রুয়ারিতেই একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেন, যা দেশের চলমান সংকট সমাধানের একমাত্র পথ বলে তিনি মনে করেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য একটি সন্ধিক্ষণ। একদিকে নির্বাচন কমিশন একটি কঠোর ও আধুনিক আচরণবিধি প্রণয়নের মাধ্যমে জনগণের আস্থা ফেরানোর চেষ্টা করছে। অন্যদিকে, এআই’র মতো অদৃশ্য শত্রু, সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক অনৈক্য এবং মতাদর্শিক সংঘাত পুরো প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলেছে। নির্বাচনকালীন সহিংসতা, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার এবং ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও ইসির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
এই বহুমুখী সংকট ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হলেই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভিত্তি আরও শক্তিশালী হবে। অন্যথায়, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ভাষায়, ‘বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে’। পুরো জাতি এখন তাকিয়ে আছে একটি সফল নির্বাচনের দিকে, যা নির্ধারণ করবে দেশের আগামী দিনের গতিপথ।
বিকেপি/এমএইচএস