যাত্রাবাড়ী থানার সাইনবোর্ডে এখনো ‘নৌকা’সহ লোগো, খেয়াল করেননি কর্মকর্তার
প্রকাশ: ০৪ আগস্ট ২০২৫, ১৮:৩০

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানা। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শেষ দিনের ভয়াবহ হামলা ও অগ্নিসংযোগে সম্পূর্ণভাবে ভস্মীভূত হয় থানা ভবনটি। ফাইল, রেজিস্টার, কম্পিউটার, ডায়েরি— সবই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। প্রাণ হারান একাধিক পুলিশ সদস্য (সঠিক সংখ্যা নিশ্চিত নয়)। একটি থানায় যেসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক নথিপত্র থাকে, তার কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। সেই ঘটনার এক বছর পার করে অনেকটাই ঘুরে দাঁড়ালেও থানার সাইনবোর্ডে এখনো দৃশ্যমান ‘নৌকা’ প্রতীকসহ পুলিশের পুরনো লোগো।
৫ আগস্টের পর দীর্ঘদিন ধরে যাত্রাবাড়ী থানা ছিল জনসাধারণের কাছে আতঙ্কের প্রতীক। ভিতরে–বাইরে ছাই, দেয়ালজুড়ে ধোঁয়ার কালো দাগ আর বাতাসে ভেসে বেড়ানো পোড়ার গন্ধ— সেই ভয়াবহ পরিস্থিতির এক বছর পূর্ণ হচ্ছে আগামীকাল, ৫ আগস্ট মঙ্গলবার। এক বছর পর, সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এই থানা।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ওইদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে মোট ৪৬০টি পুলিশ স্থাপনায় হামলা হয়। এর মধ্যে ১১৪টি থানা ক্ষতিগ্রস্ত হয়— ৫৮টি ভাঙচুর এবং ৫৬টিতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের যাত্রাবাড়ী থানা, যেখানে প্রাণহানিও সবচেয়ে বেশি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। যদিও পুলিশ এখনও সঠিক সংখ্যা জানাতে পারেনি।
নথিপত্রের ধ্বংসস্তূপ থেকে আবার শুরু
থানার বর্তমান ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কামরুজ্জামান তালুকদার বাংলাদেশের খবরকে জানান, আগুনে পুড়ে যাওয়া সব নথিপত্র পুনরুদ্ধারে ধাপে ধাপে কাজ চলছে। পুরনো রেজিস্টারভিত্তিক জিডি সংরক্ষিত না থাকায় অনেক তথ্য আর পাওয়া যাচ্ছে না। তবে যেসব অনলাইন রেকর্ড রয়েছে, সেগুলো কাজে লাগানো হচ্ছে।
জিডি প্রসঙ্গে ওসি বলেন, ‘জিডি সাধারণত দ্রুত নিষ্পত্তি হয়ে যায়। বছরের পর বছর এসব তথ্যের পেছনে ছুটতে হয় না। তাই পুরনো জিডিগুলোর তেমন প্রয়োজন পড়ে না।’
ওয়ারী বিভাগের সহকারী কমিশনার মাসুদ উদ্দিন বলেন, ‘নথিপত্র সংগ্রহের কাজ এখনো চলছে। অনলাইন থেকে কিছু পাওয়া যাচ্ছে, কিছু আবার অফিসিয়ালি পুনরায় আনতে হচ্ছে। পুরোপুরি কাজ শেষ হয়নি, তবে বড় কোনো সংকটও নেই।’
স্মৃতি রয়ে গেছে সাইনবোর্ডে
সরকারি নির্দেশনার পরও এখনও যাত্রাবাড়ী থানার দুটি বড় সাইনবোর্ডে ‘নৌকা’ প্রতীকসহ পুলিশের পুরনো লোগো দেখা যাচ্ছে— যা অনেকের কাছে রাজনৈতিক ‘ফ্যাসিবাদের প্রতীক’ হিসেবেও বিবেচিত। অন্তর্বর্তী সরকার গত ২৩ এপ্রিল বাংলাদেশ পুলিশের অফিসিয়াল লোগো পরিবর্তন সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে। নতুন লোগোতে পালতোলা নৌকা বাদ দেওয়া হয়। এর পরিবর্তে একপাশে ধান, আরেক পাশে গমের শীষ যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া উপরে তিনটি পাট পাতা এবং মাঝে পানিতে ভাসমান শাপলা আর নিচে বাংলায় লেখা ‘পুলিশ’। পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনটিতে বলা হয়, এই লোগো দেশের বিভিন্ন জেলা ও ইউনিটে পুলিশের ব্যবহৃত পতাকা, সাইনবোর্ড, ইউনিফর্ম এবং অন্যান্য জিনিসপত্রে ব্যবহার করতে হবে।
এ প্রজ্ঞাপনের তিন মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও সাইনবোর্ডে নতুন লোগো ব্যবহার না করা বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়ারী বিভাগের সহকারী কমিশনার মো. নাসিম উদ্দিন বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘সাইনবোর্ডগুলো সরবরাহ করে ডিএমপি সদর দপ্তর। আমরা নিজেরা পরিবর্তন করতে পারি না। এখনো নির্দেশ আসেনি। নির্দেশ এলে পরিবর্তন করব।’
ওসি মো. কামরুজ্জামান তালুকদার বলেন, ‘বিষয়টি খেয়াল করিনি। যেহেতু আপনি জানালেন, দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
এ বিষয়ে ডিএমপির মুখপাত্র (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, “থানার সাইনবোর্ডে ‘নৌকা’ থাকা অনুচিত। আগের সাইনবোর্ডগুলো সরিয়ে ফেলার কথা বলা হয়েছে। অধিকাংশ সরানো হয়েছে, বাকি কয়েকটি প্রক্রিয়াধীন।”
তবে ডিএমপির লজিস্টিকস বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) শাহরিয়ার মোহাম্মদ মিয়াজী বলেন, ‘থানা থেকে চাহিদাপত্র দেওয়ার কথা। যদি পরিবর্তন না করে থাকে, তাহলে চাহিদাপত্র দিলে ডিএমপি নতুন সাইনবোর্ড সরবরাহ করবে।”
আতঙ্কের সেই দিনগুলোর পর
৫ আগস্টের পর বহুদিন ধরে থানা চত্বর ছিল পোড়া গন্ধ, ছাই ও ধ্বংসাবশেষে ঢাকা। আশপাশের দোকানি ও বাসিন্দারা বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ওই সময় ভয়ের এক পরিবেশ বিরাজ করছিল। এখন আর সেই ভয় নেই। পুলিশি কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়েছে।
তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, সবকিছু স্বাভাবিক মনে হলেও, এখনো সেই দিনের কথা মনে হলে কিংবা থানার দিকে তাকালে শরীরে শিহরণ জাগে। সেই দিনগুলো এখনো মানসিকভাবে অনেককে আতঙ্কিত করে তোলে।
তদন্তে ধীরগতি নিয়ে প্রশ্ন
আন্দোলনের আগের মাসে, ২০ জুন, মাতুয়াইলে এক পুলিশ কর্মকর্তার বাবা–মাকে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। সেই মামলার তদন্তও থমকে যায় জুলাইয়ের সহিংসতার ধাক্কায়।
জুলাই বিপ্লবের আগের এমন চাঞ্চল্যকর ঘটনাগুলো সম্পর্কে ওসি বলেন, ‘সব মামলাই নিয়মিতভাবে তদন্ত করছি। তবে পুরো থানা ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। এরপরও কোনো কার্যক্রমই থমকে যায়নি।’
মনস্তাত্ত্বিক ট্রমা ও ব্যবস্থাগত ব্যর্থতা
পুলিশ সদস্যরা এখনো কি সেই সময়ের মানসিক আঘাত কাটিয়ে উঠেছেন?— এমন প্রশ্নে কেউই স্পষ্ট করে কিছু বলতে চাননি।
থানা ভবন যতই নতুন হোক, অনেক সদস্যের মনে হয়তো এখনো পোড়ার গন্ধ লেগে আছে। এক বছর পরের চিত্র অনেকটাই ‘ছাইচাপা আগুনের’ মতো। বাহ্যিকভাবে থানা ভবন দাঁড়িয়ে গেলেও, ভেতরের অনেক ক্ষত এখনও শুকায়নি।
যাত্রাবাড়ী থানা হয়তো আবার কাজ করছে, কিন্তু তার ইতিহাসে ৫ আগস্ট থাকবে ভয়ের, আগুনের এবং জবাবহীনতার দিন হিসেবে।
এনএমএম/এমএইচএস