
ইউরোপের শ্রমবাজার— স্বপ্ন, সম্ভাবনা আর উন্নত জীবনের হাতছানি। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণে এখন বড় বাধা দক্ষতার ঘাটতি। শুধু কর্মদক্ষতার ঘাটতিই নয়; ভাষাগত অদক্ষতা, পুরনো প্রশিক্ষণ পদ্ধতি, সীমিত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, রিক্রুটিং ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সংযোগহীনতা ছাড়াও ইমেজ সংকটও তীব্র হওয়ায় ইউরোপের মাটিতে পা রাখার সুযোগ পাচ্ছেন হাতে গোনা কয়েকজন। যদিও বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রবাসে পাড়ি জমাচ্ছেন লাখো মানুষ। তবে অনেকটাই ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাধ্য হয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন বেশিরভাগ মানুষ। এতে নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশে চাপ বেড়ে যাওয়ায় কর্মসংকটও দেখা দিচ্ছে। বাধ্য হয়ে কেউ কেউ দেশে ফিরে ফের বেকারত্ব বরণ করছেন।
বাংলাদেশি কর্মীরা ইউরোপে পিছিয়ে পড়ার কারণ জানতে চাইলে রোমানিয়া প্রবাসী আব্দুর রব ও সুইজারল্যান্ড প্রবাসী সিকদার শাহজাহানসহ একাধিক প্রবাসী বাংলাদেশের খবরকে বলেন, শুধু দক্ষতার ঘাটতিই নয়, সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে ইমেজ সংকট। শেনজেনভুক্ত দেশগুলোর প্রতি বাংলাদেশের মানুষের একটি বিশেষ দুর্বলতা কাজ করে। যার কারণে নন-শেনজেন দেশগুলো থেকে অবৈধভাবে শেনজেনভুক্ত দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন বেশিরভাগ মানুষ। যা বাংলাদেশের প্রতি চরম নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এছাড়াও বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাও অপর্যাপ্ত ও হতাশাজনক।
২০২৪ সালের পরিসংখ্যানই যেন সেই হতাশার প্রতিচ্ছবি। ২০২৪ সালে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন ১০ লাখ ১১ হাজার ৯৬৯ জন বাংলাদেশি কর্মী, অথচ তাদের মধ্যে মাত্র ১৬ হাজার ৭৭ জনের গন্তব্য ছিল ইউরোপ। আগের বছর যেখানে ৩০ হাজারেরও বেশি কর্মী ইউরোপে গিয়েছিলেন, সেখানে এই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় অর্ধেকে।
ইতালি, ফ্রান্স, গ্রিস, মাল্টা, পোল্যান্ডসহ মাত্র কয়েকটি দেশেই বাংলাদেশিদের আনুষ্ঠানিকভাবে কাজের সুযোগ মিলছে। পশ্চিম ইউরোপের ৯টি দেশের মধ্যে শুধু গ্রিসের সঙ্গে চুক্তি রয়েছে; দক্ষিণ ইউরোপে ইতালির সঙ্গে সম্প্রতি নতুন সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। তবে ইউরোপীয় দেশগুলো দক্ষতা ও ভাষাগত প্রস্তুতির ব্যাপারে আপসহীন— যেখানে বাংলাদেশি কর্মীদের অবস্থান দুর্বল।
দক্ষতার এই চিত্র আরও হতাশাজনক। ২০২৪ সালে বিদেশগামী মোট কর্মীদের মাত্র ২৩.৬২ শতাংশ ছিলেন দক্ষ, আর অদক্ষ কর্মীর সংখ্যা ছিল ৫৪.২৩ শতাংশ। সরকারের ১১০টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গত পাঁচ বছরে ৪ লাখের বেশি মানুষ প্রশিক্ষণ নিলেও বিদেশে যেতে পেরেছেন মাত্র ৮-১২ শতাংশ। বাকিরা অনেকেই দেশে কাজের সুযোগ না পেয়ে বেকার বা হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন।
প্রশিক্ষণ ব্যবস্থায় রয়েছে নানা সীমাবদ্ধতা— মান্ধাতা আমলের যন্ত্রপাতি, অভিজ্ঞ ট্রেইনারের অভাব এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী কোর্স না থাকা। ফলে প্রশিক্ষণ শেষে কর্মীরা প্রয়োজনীয় দক্ষতায় পৌঁছাতে পারছেন না।
বায়রার মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ট্রেনিং সেন্টার থেকে সার্টিফিকেট পাওয়া গেলেও দক্ষতার নিশ্চয়তা মেলে না। নিয়োগকর্তারা সরাসরি দক্ষতা যাচাই করেন, আর সেখানেই পিছিয়ে পড়েন অনেক কর্মী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি এখনই ভাষা শিক্ষা, কারিগরি দক্ষতা এবং বিশ্বমানের প্রশিক্ষণকে অগ্রাধিকার না দেওয়া হয়, তবে ইউরোপের শ্রমবাজারে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব আরও কমে আসবে। প্রফেশনাল ট্রেইনার, আধুনিক প্রশিক্ষণ সরঞ্জাম এবং রিক্রুটিং এজেন্সি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মধ্যে সরাসরি সংযোগই হতে পারে এই সংকট কাটানোর চাবিকাঠি।
এমএইচএস