এনআইডি হাতিয়ে নিচ্ছে রোহিঙ্গারা, সার্ভার টানাপোড়েনে ইসি
প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২৫, ১৯:৪২

ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম শিবানন্দপুর। এই গ্রামের বাসিন্দা দুই ভাই খাইরুল ও তরিকুল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খাইরুল ইসলামের সঙ্গে কক্সবাজারের সাদিয়া ফাহা নামের এক মেয়ের পরিচয় হয়। যোগাযোগের এক পর্যায়ে খাইরুল তার প্রবাসী ভাই তরিকুলের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেয়। পরিচয়ের কিছুদিন পর সাদিয়া কক্সবাজার থেকে স্বইচ্ছায় খাইরুলের বাসা, ঝিনাইদহে এসে ওঠেন এবং তাকে বিয়ে করে সংসার শুরু করেন।
বিয়ের কিছুদিন পর সাদিয়া জানান, তিনি খাইরুলকে নয়, বরং তার ভাই তরিকুলকে ভালোবাসেন। কিছুদিন পর খাইরুলকে তালাক দিয়ে তিনি তরিকুলকে বিয়ে করেন। তরিকুলের স্ত্রী হিসেবে আবার সেই বাড়িতেই থাকতে শুরু করেন এবং সেখানে এনআইডি করেন। একদিন কাউকে না জানিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। এরপর সাদিয়া চলে যান বগুড়ায়। পরে বগুড়ার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে পাসপোর্ট করার চেষ্টা করেন। তাকে দেখে এবং কথা শুনে অফিসের কর্মকর্তাদের সন্দেহ হয়। এতে তারা নির্বাচন কমিশনকে সাদিয়ার এনআইডি তদন্তের অনুরোধ জানায়।
নির্বাচন কমিশনের তদন্তে উঠে আসে— অভিযুক্ত ভোটার সাদিয়া ফাহা একজন রোহিঙ্গা। স্বামী মো. তরিকুল ইসলাম, পিতা- মৃত রায়হান, মাতা- মৃত রাবিয়া পরিচয় ব্যবহার করে তিনি ভোটার হালনাগাদ-২০২৫-এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। সাদিয়ার মতো অভিনব কায়দায় এনআইডি বানিয়ে নিতে অনেক রোহিঙ্গা প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছেন।
২০১৭ সালে মায়ানমারের জান্তা সরকারের নির্যাতনের মুখে প্রায় ১০ লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। তারপর থেকে বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১২ লক্ষ। এই বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একটি অংশ নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার ও পাসপোর্ট করতে বাংলাদেশি এনআইডি হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
রোহিঙ্গাদের এনআইডি প্রাপ্তি ঠেকাতে যা করছে ইসি
বর্তমান চট্টগ্রাম অঞ্চলের নাগরিকদের এনআইডি সেবা সহজ করতে এবং জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন (এনআইডি) কার্যক্রমে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্তি ঠেকাতে তিনটি ক্যাটাগরিতে নাগরিকদের আবেদন ভাগ করে নিয়ে নিষ্পত্তি করে থাকে নির্বাচন কমিশন। এনআইডি আবেদন করলে প্রথমে ‘এ’ ও ‘বি’ ক্যাটাগরিতে ফেলা হয়। দুটি ক্যাটাগরির কোনোটিতেই আবেদন না থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আবেদন ‘সি’ ক্যাটাগরি বা বিশেষ কমিটির কাছে পাঠানো হয়। আবার কেউ আবেদন করলেই যেন রোহিঙ্গা সন্দেহ না করা হয়, সেই নির্দেশনাও দেওয়া হয় নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, যাদের এসএসসি/ সমমান বা তদূর্ধ্ব সনদ আছে এবং পিতা-মাতার জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) সঙ্গে তথ্যের মিল রয়েছে, তারা ‘এ’ ক্যাটাগরিতে পড়বেন। আবার এসএসসি/ সমমান বা তদূর্ধ্ব সনদ না থাকলেও অনলাইন জন্ম সনদ ও পিতা-মাতার জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে তথ্যের মিল থাকলে তারা ‘বি’ ক্যাটাগরিতে পড়বেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যেসব আবেদনে সন্দেহ করবে, সেই আবেদনগুলো ‘সি’ ক্যাটাগরি বা বিশেষ কমিটির কাছে যাবে।
ইউএনএইচসিআর-এর সার্ভার ব্যবহারের উদ্যোগ আলো দেখছে না
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, রোহিঙ্গাদের এনআইডি প্রাপ্তি ঠেকাতে তারা সর্বশেষ জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর)-এর রোহিঙ্গা সার্ভার (ডাটাবেজ) ব্যবহার করতে চেয়েছিল। এ নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ইউএনএইচসিআরের সঙ্গে একাধিক বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে রোহিঙ্গা ডাটাবেজ ব্যবহারের বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত হয়। কিন্তু বাঁধ সাধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। তারা এই সার্ভার ব্যবহারের অনুমতি দিতে সম্মত হয়নি। তাদের আপত্তির কারণে ইসির এই উদ্যোগ এখনও আলোর মুখ দেখেনি।
জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক এ এস এম হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ডাটাবেজ পাওয়ার বিষয়ে ইসির সঙ্গে টেকনিক্যাল পর্যায়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠক হয়েছিল। অন্য একটি মন্ত্রণালয় ডাটাবেজ নিজেদের কাছে রাখতে চেয়েছে। ইসির কাছে না দিয়ে যে কোনো মন্ত্রণালয়ের কাছে ডাটাবেজ থাকলে আমাদের আপত্তি নেই। আমার জানা মতে, এখনও কোনো মন্ত্রণালয়ে ডাটাবেজটি ব্যবহারের সুযোগ পায়নি। ডাটাবেজটি পেলে রোহিঙ্গা শনাক্ত করা সহজ হবে।’
এসআইবি/এমএইচএস