বিশ্ববিদ্যালয়ে হঠাৎ অস্থিরতা, বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা

তরিকুল ইসলাম সুমন
প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:১২

আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথম ভাগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছে সরকার। এরপর রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে নানা সমীকরণ, রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংঘর্ষও ঘটছে। এ সংঘর্ষ ও অস্থিরতার মধ্যেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দেশের শিক্ষাঙ্গন। আলাদা আলাদা ইস্যুকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে শিক্ষার পরিবেশ। দুটিতে শিক্ষা কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে। রাজনীতিতে নানা ইস্যুতে অস্থিরতার মধ্যে ক্যাম্পাসগুলোও অশান্ত হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করেন শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাকসু নির্বাচন ঘিরে তুলকালাম, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অনশন-হুঁশিয়ারি, ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে রেলপথ অবরোধ, তদন্ত কমিটি গঠন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) সর্বাত্মক শাটডাউনসহ শিক্ষক সংগঠনের মহাসমাবেশে একাধিক দাবিতে সরব শিক্ষাঙ্গন। চট্টগ্রামের শিক্ষার্থী ও গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় প্রশাসনের মামলা, অন্ত্র উদ্ধারে প্রশাসনের আল্টিমেটামেরও ঘটনা ঘটছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার, চার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তহীনতায় পরিস্থিতি ক্রমেই
অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে এমন আশঙ্কা শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের। এ বিষয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা চৌধুরী রফিকুল আবরার সাংবাদিকদের বলেন, গত কয়েকদিন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় যে কতগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে, সেটিতে মন্ত্রণালয় অবহিত রয়েছে। অবশ্যই এসব কারণে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। সেটাতে আমরা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। আমরা মনে করি, যেকোনো সমস্যাই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান সম্ভব। সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সেটা সমাধানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা আশা করি, দ্রুত এর সমাধান হবে। বিভিন্ন পার্টি তারা একে অপরকে বুঝে অবস্থান পাল্টে সর্বজনগ্রাহ্য একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারবেন এবং যত দ্রুত সেটা হয়, ততই মঙ্গলজনক।
আমাদের প্রতিনিধিরা জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে
আরেক ধরনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে একজন শিক্ষার্থী ছুরিকাহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের দাবিতে চলছে আন্দোলন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের নীতিমালা চূড়ান্তকরণ, রোডম্যাপ ঘোষণা এবং সম্পূরক বৃত্তির দাবি জানিয়েছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে স্থানীয় গ্রামবাসীর সংঘর্ষের পর ক্যাম্পাসে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকায় এখনো ১৪৪ ধারা জারি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়েছে।
এদিকে, তিন দফা দাবিতে ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও সংঘর্ষের জের ধরে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা ও আবাসিক হল খালি করার ঘোষণার পরও অনড় অবস্থানে শিক্ষার্থীরা।
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আব্দুল আলীম বলেন, আমরা চেষ্টা করছি শান্তিপূর্ণভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে ক্যাম্পাস খুলে দিয়ে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতার পেছনে বেশ কিছু কারণ থাকলেও অন্যতম হলো শিক্ষার্থীদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো রোডম্যাপ না করা। শিক্ষা কমিশন গঠন না করা, বিপ্লব করা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের পথ দেখাবে এমন কোনো নির্দেশনাও সরকারের পক্ষ থেকে ছিল না। নির্বাচন নিয়ে সরকার ও রাজনৈতিক দল যতটা তৎপর হলেও শিক্ষায় নেই। তারা দেশে নতুন করে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন নেই। এতে তাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। ফলে কিছু হলেই তারা রাস্তায় নামছেন, আন্দোলন করছেন। এর প্রভাব পড়েছে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কেও। শিক্ষকরা এসব বিষয় সরকারের সর্বোচ্চ মহলে বারবার বলার পরও সুরাহা হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ড. মো. তৌহিদুল হক বলেন, শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটনার পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিবর্তনের একটি স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে। তারা মনে করেছিলেন, দেশে যে পরিবর্তন হবে তা শিক্ষার মধ্যে দিয়ে শুরু হবে। কিন্তু বাস্তবে সেটি হয়নি। শুধু সরকার নয়, রাজনৈতিক দলগুলোও বিপ্লবের প্রথম অংশীজন ছাত্রদের সব অর্জন ভুলে যেতে বসেছে। ফলে তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা বিরাজ করছে, যার কারণে কথায় কথায় তার আন্দোলনে নামছেন। অবরোধ করছেন পথঘাট।
আমাদের ময়মনসিংহ প্রতিনিধি জানান, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সভা শেষে অডিটোরিয়াম থেকে বের হওয়ার মুহূর্তে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা মিলনায়তনের সব গেট বন্ধ করে সভায় উপস্থিত সবাইকে আট ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখা এবং পরে বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক ঘটনা, ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত এবং ঘটনার সার্বিক তদন্তের লক্ষ্যে ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। বাকৃবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে এম ফজলুল হক ভূঁইয়ার আদেশক্রমে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার কৃষিবিদ ড. হেলাল উদ্দীন স্বাক্ষরিত এক আদেশে বিষয়টি জানানো হয়েছে। তদন্ত কমিটিতে মৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের ডিন বাকৃবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল ইসলাম সরদারকে সভাপতি এবং সংস্থাপন শাখা-২ এর ডেপুটি রেজিস্ট্রার ড. মো. মঞ্জুর হোসেনকে সদস্য সচিব করা হয়েছে।
কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন- ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ গোলজারুল আজিজ, কৃষি রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী ফরহাদ কাদির, কৃষি অর্থসংস্থান ও ব্যাংকিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আক্তারুজ্জামান খান, পূর্ত বিভাগ-১ এর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী প্রকৌ. এনামুল হক।
এতে আরও বলা হয়েছে, গত ৭ আগস্ট বাকৃবির পশুপালন ও ভেটেরিনারি অনুষদের শিক্ষার্থীরা তাদের চাকরির ক্ষেত্র বাড়ানো এবং চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে নিশ্চয়তায় কম্বাইন্ড ডিগ্রির দাবি সংবলিত স্মারকলিপি উপাচার্য বরাবর পাঠান। উপাচার্য বিষয়টি দ্রুত সমাধান করতে গত ১২ আগস্ট একটি কমিটি গঠন করে দেন। গঠিত কমিটির সুপারিশে গত ৩১ আগস্ট সকাল ১১টায় অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের জরুরি সভায় ২৫১ শিক্ষকের উপস্থিতিতে উপস্থাপন করা হলে শিক্ষা পরিষদ কমিটির সুপারিশ মোতাবেক তিনটি ডিগ্রি প্রদানের সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
আমাদের চট্টগ্রাম প্রতিনিধি জানান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের মধ্যে টানা দুই দিনের সংঘর্ষের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে হাটহাজারী থানায় একটি মামলা ও একটি জিডি করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। মামলায় ১৮ জনের নাম উল্লেখ করে এক হাজার জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম। এ ছাড়া চবির নিরাপত্তা দফতরের দেশীয় অস্ত্র লুটের ঘটনায় একটি জিডি করা হয়েছে। তিনি বলেন, সংঘর্ষের ঘটনায় একটি মামলা আর একটি জিডি করা হয়েছে। আর আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে যা করার সব করছি। শিক্ষার্থীদের অনুরোধ করবো তারা যেন দ্রুত ক্লাস-পরীক্ষায় ফেরে। শিক্ষার্থীদের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে তাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। হাটহাজারী ঘানার ওসি আবু কাউসার মোহাম্মদ হোসেন বলেন, চবিতে সংঘর্ষের ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। আমরা এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।
ঢাবি প্রতিনিধি জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন স্থগিত করে হাইকোর্টের দেওয়া আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ আজ বুধবার পর্যন্ত বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালত। ওইদিন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে এ বিষয়ে শুনানি হবে। হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবার আপিল বিভাগের বিচারপতি ফারাহ মাহবুবের নেতৃত্বাধীন চেম্বার জজ আদালত এ আদেশ দেন। আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি শুনানি করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। রিটকারীর পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া।
বরিশাল প্রতিনিধি জানান, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অল্প সময়ের মধ্যে ১৫০ একর জমি অধিগ্রহণ, পরিবহন সংস্কার এবং তিন মাসের মধ্যে ফিজিবিলিটি স্টাডির সব কাজ সম্পন্ন করার দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দাবি মেনে না নিলে ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়ক অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাউন্ড ফ্লোরে সংবাদ সম্মেলনে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি আমিনুল ইসলাম, ববি শাখার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক আহ্বায়ক রাকিব আহমেদ এবং গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের শাখা সংগঠক।
বিকেপি/এমএইচএস