সওজের সিদ্ধান্তহীনতায় নষ্ট হতে চলেছে ২২৬ কোটি টাকার প্রকল্প
প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:৪৬

২২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের চারটি জেলায় চারটি আধুনিক বিশ্রামাগার নির্মাণের দুই বছর পরও চালু করতে পারেনি সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নির্মাণকাজ শেষ হলেও চালু কিংবা ব্যবহারের প্রক্রিয়া নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে জটিলতা। যে কারণে দুই বছর ধরে অলস পড়ে রয়েছে বিশ্রামাগারগুলো। অথচ কুমিল্লার নিমসার, সিরাজগঞ্জের পাঁচলিয়া, মাগুরার লক্ষীকান্দর ও হবিগঞ্জের জগদীশপুরে নির্মিত বিশ্রামাগারগুলো চালু হলে হাজারো চালক পেতেন নিরাপদ বিশ্রামের সুযোগ। চালকরা হতেন ক্লান্তিমুক্ত, কমে আসতো সড়ক দুর্ঘটনার প্রবণতা। কিন্তু বাস্তবে বিশ্রামাগারগুলো এখন পরিণত হয়েছে তালা ঝোলানো কংক্রিটের প্রদর্শনীতে।
বিশ্রামাগারগুলো নির্মাণের মূল লক্ষ্য ছিল দীর্ঘপথে চালকদের জন্য নিরাপদ বিরতি নিশ্চিত করা, যাতে অতিরিক্ত ক্লান্তি থেকে সড়ক দুর্ঘটনা না ঘটে। কিন্তু চালু না হওয়ায় বিশ্রামাগার নির্মাণের উদ্দেশ্যই এখন ভেস্তে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে কোটি কোটি টাকার এই প্রকল্প অকার্যকর ব্যয়ে পরিণত হবে।
সওজ সূত্র বলছে, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, সিদ্ধান্তহীনতা আর দায়িত্ব এড়ানোর সংস্কৃতির কারণেই এসব অবকাঠামো অলস পড়ে আছে। এখন পর্যন্ত প্রকল্প পরিচালনা নিয়ে স্পষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সার্ভিস প্রোভাইডারকে টেন্ডারের মাধ্যমে ইজারা দেওয়া হবে নাকি সওজ নিজেরাই পরিচালনা করবে— এ নিয়েই তৈরি হয়েছে অচলাবস্থা। অথচ এই বিশাল অবকাঠামো পরিচালনার জন্য সওজের কাছেও নেই পর্যাপ্ত জনবল।
সওজের এক নির্বাহী প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘প্রকল্প তো শেষ, কিন্তু কে চালাবে সেই প্রশ্নের উত্তর নেই। ফাইল এদিক-সেদিক ঘুরছে, কিন্তু কার্যকর সিদ্ধান্ত হচ্ছে না।’ কুমিল্লা, হবিগঞ্জ, মাগুরা ও সিরাজগঞ্জ সড়ক বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চাইলে কেউই সঠিক জবাব দেননি। কেউ বলেছেন, ‘টেন্ডার প্রক্রিয়া চলছে।’ আবার কেউ বলেছেন, ‘উপর মহলের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি।’ সওজের প্রধান প্রকৌশলীও ফোন ধরেননি। সুনির্দিষ্ট বিষয় উল্লেখ করে ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও কোনো প্রতিউত্তর আসেনি।
এদিকে বিশ্রামাগারগুলো চালু না হওয়ায় দেশের হাজারো চালক আজও বিশ্রামের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য সড়ক দুর্ঘটনা কমানো ও চালকদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি হলেও সিদ্ধান্তহীনতার কারণে তা কার্যকর হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্রুত এসব বিশ্রামাগার চালু না করলে প্রকল্পের পুরো অর্থই অকার্যকর ব্যয়ে পরিণত হবে।
একজন পরিবহন মালিক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘চালকদের বিশ্রামের জন্য এতো টাকা খরচ করা হলো, অথচ আজও তাদের রাস্তার ধারে ট্রাকে শুয়ে থাকতে হয়। এটা আসলে দেশের সম্পদ ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই নয়।’
সওজ সূত্র আরও জানায়, সম্প্রতি এ সংক্রান্তে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে বৈঠকও হয়েছে। তবে সেখানেও কোনো কার্যকরী সিদ্ধান্ত হয়নি। বিষয়টি এখন অনেকটাই সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যে রয়েছে। কবে নাগাদ চালু হবে তা নিয়েও ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। সূত্রটি জানায়, টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সার্ভিস প্রোভাইডারদের হাতে তুলে দেওয়া হবে নাকি সওজ নিজেই পরিচালনা করবে— এ নিয়েই মূলত সিদ্ধান্তহীনতা তৈরি হয়েছে। তবে সূত্রটি দাবি করছে, সওজ চাইলেও বিশ্রামাগারগুলো পরিচালনা করা কঠিন। কারণ, বিশ্রামাগার পরিচালনার মতো জনবল সওজের নেই। এমন জটিলতার ফলে প্রকল্পের লক্ষ্য পূরণ না হয়ে সেগুলো বছরের পর বছর অলস পড়ে রয়েছে।
চালুর বিষয়ে জানতে চাইলে সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মাহবুব আলম বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘সম্ভবত টেন্ডার প্রক্রিয়া চলছে। যারা সেবাটা দেবে (সার্ভিস প্রোভাইডার), তাদের জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। সওজের মাধ্যমে পরিচালনা সম্ভব নয়, কারণ সওজের এতো লোকবল নেই।’ অফিস চলাকালে ফোন দেওয়ার কথা বলে তিনি এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি।
সওজ সূত্র জানায়, কুমিল্লার নিমসার (ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক), সিরাজগঞ্জের পাঁচলিয়া (ঢাকা-যমুনা সেতু মহাসড়ক), মাগুরার লক্ষীকান্দর (ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক) এবং হবিগঞ্জের জগদীশপুরে (ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক)— এই চারটি বিশ্রামাগার নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি বিশ্রামাগারেই রয়েছে আধুনিক শয়নকক্ষ, ট্রাক পার্কিং, ক্যান্টিন, গোসলখানা, স্যানিটেশন, নামাজঘর, চিকিৎসা কক্ষ, ওয়ার্কশপ, ওয়াশ জোন, বিনোদন পয়েন্ট এবং এমনকি সীমিত খেলাধুলার ব্যবস্থাও।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিশ্রামাগারগুলো পুরোপুরি প্রস্তুত থাকলেও এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি ইজারাদারদের মাধ্যমে চালু হবে নাকি ও অ্যান্ড এম (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে। সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে নষ্ট হচ্ছে সময়। আর অলস পড়ে আছে ২২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বিশ্রামাগারগুলো।
সওজ সূত্র জানায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নিমসারের বিশ্রামাগারের কাজ শেষ হয়েছিল ২০২৩ সালের শুরুতেই। একই সময়ে প্রস্তুত হয়েছিল সিরাজগঞ্জের পাঁচলিয়ার বিশ্রামাগারও। ১৩ একরের ওপর জায়গাজুড়ে নির্মিত ওই বিশ্রামাগারে একসঙ্গে ১০০ চালকের আবাসন ও ১০০ ট্রাক পার্কিংয়ের সুযোগ রয়েছে। যদিও জানতে চাইলে কুমিল্লা সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী খন্দকার গোলাম মোস্তফা বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘ওইটা আমাদের টেন্ডার করে দিতে হবে, কাজ চলছে।’ এর বেশি কিছু বলতে চাননি তিনি।
এদিকে এসব বিশ্রামাগার ব্যবহারের বিষয়ে সওজ থেকে একটি নির্দেশিকাও তৈরি করা হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, শয্যা ভাড়া হিসেবে প্রথম ৫ ঘণ্টার জন্য ১৫০ টাকা, এরপর প্রতি ঘণ্টা ২৫ টাকা দিতে হবে চালকদের। এক্সট্রা হেভি যান পার্কিং করলে প্রথম ৫ ঘণ্টায় দিতে হবে ১৫০ টাকা, এরপর প্রতি ঘণ্টা ৩০ টাকা। হেভি ট্রাক পার্কিংয়ের ক্ষেত্রে প্রথম ৫ ঘণ্টায় ১০০ টাকা, এরপর প্রতি ঘণ্টা ২০ টাকা। মিডিয়াম ট্রাক পার্কিংয়ের ক্ষেত্রে প্রথম ৫ ঘণ্টা ৭৫ টাকা, এরপর প্রতি ঘণ্টা ১৫ টাকা। লাইট ট্রাক পার্কিংয়ের ক্ষেত্রে প্রথম ৫ ঘণ্টায় ৫০ টাকা, এরপর প্রতি ঘণ্টা ১০ টাকা। টয়লেট ও গোসলখানা ব্যবহারের জন্যও আলাদা ফি নির্ধারণ করা হয়েছে।
এতোসব সুবিধা সম্বলিত বিশ্রামাগারগুলো অলস ফেলে রাখার কারণ ও কবে নাগাদ চালু হতে পারে জানতে চাইলে হবিগঞ্জের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী শহীদুল ইসলাম বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘বিশ্রামাগার চালুর বিষয়ে যুগ্ম সচিব স্যার এসেছিলেন। তখন ইজারা দেওয়ার বিষয়ে কথা হয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ে একটি মিটিং হয়েছে। মিটিংয়ের একটি রেজুলেশনে সম্ভবত আপাতত এরকমই থাকবে। বিশ্রামাগারগুলো নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’
মাগুরা সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাসেল বলেন, ‘আমি নতুন যোগদান করেছি। অফিস চলাকালে ফোন করলে বলতে পারবো। আমার জানা নেই।’
তবে সিরাজগঞ্জ সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ইমরান ফারহান সুমেল, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী জাহিদুর রহমান মিলু ও উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মাহবুবা আক্তারকে একাধিকবার ফোন দিলেও তাদের ফোন বন্ধ থাকায় কথা বলা সম্ভব হয়নি। সওজের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসানের কাছেও জানতে চেয়ে একাধিকবার ফোন ও ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও তিনি কোনো প্রতিউত্তর দেননি।
এমএইচএস