পার্বত্য অঞ্চলে সহিংসতা বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ : আইএসপিআর
ডিজিটাল ডেস্ক
প্রকাশ: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:০৪
খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর) রাতে আইএসপিআর এ বিবৃতি দেয়।
আইএসপিআর জানায়, ২০২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে মোটরসাইকেল চালক মামুন হত্যাকে কেন্দ্র করে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) মূল এবং অঙ্গসংগঠনসমূহ দীঘিনালা ও রাঙামাটিতে সাম্প্রদায়িক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা করে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ফলশ্রুতিতে তিনজন নিহতসহ বেশ কিছু এলাকাবাসী আহত হয়। গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বরের ঘটনার এক বছর পূর্তি হিসেবে এ বছর ইউপিডিএফ ও এর সহযোগী সংগঠনসমূহ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করে এবং অনুরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটানোর চেষ্টা করে।
আইএসপিআর জানায়, গত ২৩ সেপ্টেম্বর (২০২৫) রাতে খাগড়াছড়ির সিঙ্গিনালা এলাকায় এক স্কুলছাত্রীর ধর্ষণের অভিযোগকে আমলে নিয়ে ইউপিডিএফ (মূল) এর দাবিকৃত সন্দেহভাজন শয়ন শীলকে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ২৪ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করা হয়। পরে পুলিশ হেফাজতে রিমান্ডে নেওয়া হয়। ঘটনাটির সত্যতা বিচারে আইনি প্রক্রিয়া বর্তমানে চলমান রয়েছে। শয়ন শীলকে গ্রেপ্তার করা সত্ত্বেও ইউপিডিএফ এর অঙ্গসংগঠন পিসিপি এর নেতা উখ্যানু মারমা ‘জুম্ম ছাত্র জনতার’ ব্যানারে গত ২৪ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদী মানববন্ধনের ডাক দেয়। এর ধারাবাহিকতায় গত ২৫ সেপ্টেম্বর ইউপিডিএফ এর আহ্বানে খাগড়াছড়িতে অর্ধবেলা হরতাল পালিত হয়। একই সময় দেশে-বিদেশে অবস্থানরত ব্লগার ও পার্বত্য অঞ্চলের কিছু দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা অনলাইনে বাঙালিদের উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন রকম অপপ্রচার ও উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়া হয়।
আইএসপিআর জানায়, গত ২৬ সেপ্টেম্বর ইউপিডিএফ এর কর্মী উখ্যানু মারমার নেতৃত্বে এবং সামাজিক মাধ্যমে দেশী ও প্রবাসী ব্লগারসহ পার্বত্য জেলার কিছু দায়িত্বশীল ব্যক্তির উসকানিমূলক প্রচারণার প্রভাবে সমগ্র খাগড়াছড়িতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। অবরোধ চলাকালে এক পর্যায়ে ইউপিডিএফ-এর প্ররোচনায় উচ্ছৃঙ্খল এলাকাবাসী টহলরত সেনাদলের ওপর ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে। ফলশ্রুতিতে তিনজন সেনা সদস্য আহত হয়। সার্বিক পরিস্থিতি ও উসকানির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সেনাবাহিনী অত্যন্ত ধৈর্য, সংযম ও মানবিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে এবং বল প্রয়োগ থেকে বিরত থাকে।
আইএসপিআর জানায়, গত ২৭ সেপ্টেম্বর ইউপিডিএফ ও অঙ্গ সংগঠনের কর্মীরা আবারও দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। বিভিন্ন স্থানে বাঙালিসহ সাধারণ মানুষের ওপর গুলি, ভাঙচুর, অ্যাম্বুলেন্সে আক্রমণ ও রাস্তা অবরোধসহ নাশকতা করে সমগ্র খাগড়াছড়ি পৌরসভা এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটায়। ওইদিন দুপুর নাগাদ সামগ্রিক বিষয়টি পাহাড়ি-বাঙালির একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রূপ নেয়। অবস্থা বিচারে জেলা প্রশাসন কর্তৃপক্ষ খাগড়াছড়ি ও গুইমারা এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। এমতাবস্থায়, সেনাবাহিনী, বিজিবি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চরম ধৈর্যের সাথে সারা রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে এবং একটি অবশ্যম্ভাবী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিহত করা সম্ভবপর হয়।
আইএসপিআর জানায়, খাগড়াছড়ি পৌরসভা এলাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির অপচেষ্টা ব্যর্থ হবার পর ইউপিডিএফ ও এর অঙ্গসংগঠন সমূহ রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে খাগড়াছড়ি জেলার গুইমারা উপজেলার রামসু বাজার এলাকায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সাধারণ জনগণকে উসকে দিয়ে রাস্তা অবরোধ করে গুইমারা-খাগড়াছড়ি রাস্তা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয়। রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় ইউপিডিএফ কর্মী ও সন্ত্রাসীরা এলাকার বাঙালি জনগোষ্ঠীর সাথে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়াতে লিপ্ত হয়। এই পর্যায়ে সেনাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে তারা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র, ইট-পাটকেল, গুলতি ও লাঠিসোঁটা নিয়ে সংঘবদ্ধভাবে সেনাবাহিনীর ওপর হামলা চালায়। এতে সেনাবাহিনীর ৩ জন অফিসারসহ ১০ জন সদস্য আহত হন।
একই সময় তারা রামগড় এলাকায় বিজিবির গাড়ি ভাঙচুর করে এবং বিজিবি সদস্যদের আহত করে। সংঘর্ষ চলাকালীন সাড়ে ১১টার দিকে রামসু বাজারের পশ্চিম দিকে অবস্থিত উঁচু পাহাড় থেকে ইউপিডিএফ (মূল) সশস্ত্র দলের সদস্যরা ৪/৫ বার অটোমেটিক অস্ত্র দিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত পাহাড়ি, বাঙালি ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত সেনাসদস্যদের লক্ষ্য করে আনুমানিক ১০০-১৫০ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে। এতে ঘটনাস্থলে সংঘর্ষে লিপ্ত এলাকাবাসীর মধ্যে অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়। এমতাবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনাবাহিনীর টহল দল দ্রুত সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ধাওয়া করার লক্ষ্যে ওই এলাকায় গমন করে। সেনাবাহিনীর তৎপরতায় সশস্ত্র দলটি দ্রুত এলাকা ত্যাগ করে।
আইএসপিআর জানায়, সমসাময়িক সময়ে রামসু বাজার ও ঘরবাড়িতে ইউপিডিএফ (মূল) এর বহিরাগত দুষ্কৃতিকারীরা অগ্নিসংযোগ করে এবং বাঙালিদের সাথে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় লিপ্ত হয়। এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রামসু বাজার ও গুইমারা এলাকায় অতিরিক্ত সেনাদল নিয়োগ করা হয়। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
আইএসপিআর জানায়, বিগত কয়েকদিনের ঘটনা পর্যবেক্ষণে এটি স্পষ্ট যে, ইউপিডিএফ ও তার অঙ্গসংগঠন সমূহ পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে সুপরিকল্পিতভাবে এলাকার মহিলা ও স্কুলগামী কোমলমতি শিশুদের বিভিন্ন পন্থায় তাদের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে বাধ্য করছে। একই সাথে পার্বত্যাঞ্চলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠনের লক্ষ্যে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্রসহ পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে আসার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫) বিকালে বিজিবির কাপ্তাই ব্যাটালিয়ন কর্তৃক স্থাপিত চেকপোস্টে ইউপিডিএফ এর সন্ত্রাসী সংগঠন কর্তৃক পরিবহনকৃত বিপুল পরিমাণ দেশীয় অস্ত্র যাত্রীবাহী বাস হতে জব্দ করা হয়।
আইএসপিআর জানায়, গত ১৯ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খাগড়াছড়ি ও গুইমারা এলাকায় বিভিন্ন ঘটনাকে পুঁজি করে আইনের আশ্রয় না নিয়ে পার্বত্য অঞ্চলকে অস্থিতিশীল এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠনের বিষয়টি একটি বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ বলে প্রতীয়মান হয়। এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রমাণাদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিকট সংরক্ষিত আছে। গত কয়েকদিনের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পার্বত্য অঞ্চলের সকল জাতিগোষ্ঠীর রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও জনসাধারণকে সংযত আচরণ করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে।
আইএসপিআর জানায়, পার্বত্য অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সেনাবাহিনীসহ সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতা করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো। সকল ধরনের অপপ্রচার, মিথ্যা প্রচারণা, উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও সেনাবাহিনী বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য এ অংশের অখণ্ডতা রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল জাতিগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে ও দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সেনাবাহিনী যে কোনো ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এমবি

