Logo

জাতীয়

পিআরের পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তিতে বিভেদ

Icon

এম. ইসলাম

প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৪৩

পিআরের পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তিতে বিভেদ

গ্রাফিক্স : বাংলাদেশের খবর

দেশে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে বিশ্লেষকদের মধ্যেও এ বিষয়ে বিভাজন তৈরি হয়েছে।

দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদের উভয়পক্ষে পিআরের পক্ষে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো মনে করছে, এটি চালু হলে সংসদীয় প্রতিনিধিত্বের সুযোগ বাড়বে। কারণ, দল যত শতাংশ ভোট পাবে, ঠিক তত শতাংশ আসন পাবে। যার ফলে বড় দলের একচ্ছত্র ক্ষমতা কমবে।

পিআর বিরোধিতাকারীরা মনে করছেন, এই পদ্ধতি সরকারকে অস্থিতিশীল করতে পারে। তারা নেপাল, ইতালি ও বেলজিয়ামের মতো দেশগুলোর উদাহরণ তুলে ধরছেন। যেখানে পিআর পদ্ধতি বারবার সরকারের পতন ঘটিয়েছে। তাদের মতে, এটি সরকারকে অস্থিতিশীল করতে পারে এবং যেহেতু এমপি মনোনয়ন দেবে দল থেকে তাই স্বজনপ্রীতিও বাড়তে পারে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রাজনৈতিক বাস্তবতায় এখনই সম্পূর্ণ নতুন একটি পদ্ধতির জন্য রাজনৈতিক দল এবং জনসাধারণও প্রস্তুত নন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বাংলাদেশের খবরকে বলেন, নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষে পিআরের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক আছে। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় আমরা আপাতত উচ্চকক্ষে পিআর চালুর প্রস্তাব করেছি। বেশির ভাগ দলও আমাদের প্রস্তাবে একমত হয়েছে। যদিও দু-একটি দল নোট অফ ডিসেন্ট দিয়েছে।

তিনি মনে করেন, একবারেই উভয়কক্ষে পিআর চালুর বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতা এবং দেশের বাস্তবতা উপযোগী নয়। ইতিবাচক দিক আছে জেনেই আমি আগে থেকেই পিআর চালুর ব্যাপারে কথা বলে আসছি। পিআর সিস্টেমে স্বৈরাচার হয়ে ওঠার সুযোগ নেই বললেই চলে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, পিআর চালু পদ্ধতি সরকারকে অস্থিতিশীল করতে পারে। নেপাল, ইতালি ও বেলজিয়ামের মতো দেশগুলো যার উদাহরণ। যেখানে পিআর পদ্ধতি বারবার সরকারের পতন ঘটিয়েছে।

ইনোভিশন কনসাল্টিংয়ের একটি জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ১০ হাজারের বেশি ভোটারের মধ্যে ৫৬ শতাংশই পিআর পদ্ধতি সম্পর্কে জানেন না। তবে, তরুণ ভোটারদের মধ্যে এই পদ্ধতির প্রতি সমর্থন বেশি দেখা গেছে, যা নির্বাচনী সংস্কার নিয়ে প্রজন্মগত পার্থক্যের প্রমাণ করে।

নেপালে ২০০৮ সালে মিশ্র পিআর পদ্ধতি চালু করার পর দেশটি মাত্র ১৭ বছরে ১২টি সরকার পরিবর্তন দেখেছে। যা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করা হয়।

ইতালিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে পিআর ব্যবহার করা এই দেশটি ৮০ বছরে ৬৯টি মন্ত্রিসভা গঠন করেছে। অর্থাৎ প্রতি প্রশাসনের গড় মেয়াদ ছিল এক বছরের সামান্য বেশি।

পিআরের কারণে বেলজিয়াম একবার সরকার গঠনে ৫৪১ দিনের অচলাবস্থার বিশ্ব রেকর্ড স্থাপন করেছিল। তুলনামূলক স্থিতিশীল দেশ নেদারল্যান্ডসকেও ২০২১ সালের নির্বাচনের পর সরকার গঠন প্রক্রিয়ায় জোট গঠন করতে ২৯৯ দিন সংগ্রাম করতে হয়েছে।

পিআর বিরোধীদের মতে, এই আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাগুলো স্পষ্ট প্রমাণ করে যে বাংলাদেশে এই ব্যবস্থা চালু হলে স্থিতিশীলতার চেয়ে অস্থিতিশীলতা বাড়তে পারে। অনেকের মাঝে নানা আশঙ্কাও রয়েছে।

দেশে ৩১ জুলাই জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের জুলাই জাতীয় সনদে পিআর পদ্ধতির অধীনে নির্বাচিত একটি উচ্চকক্ষ অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্তের বিপরীতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং এর সমমনা দলসমূহ নোট অব ডিসেন্ট প্রদান করে।

অন্যদিকে, পিআরের সমর্থনের নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং কিছু সমমনা দল, যারা আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে এই পদ্ধতি গ্রহণের দাবিতে বিক্ষোভ করেছে।

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা দমন এবং রাজনৈতিক দুর্নীতি মোকাবিলায় পিআর অপরিহার্য। তিনি বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘রাজনৈতিক সহিংসতা এবং অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতায় জর্জরিত একটি দেশে পিআর ন্যায্য ও আরও জবাবদিহিমূলক শাসনের দিকে পথ দেখাবে।’

জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষে পিআরের পক্ষে, কিন্তু নিম্নকক্ষের অন্তর্ভুক্তির বিরুদ্ধে। এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আরিফুর রহমান তুহিন বলেন, উচ্চকক্ষে পিআর বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্বকে শক্তিশালী করবে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করবে।

তিনি বলেন, ‘এটি নিশ্চিত করবে যে, কোনো সিদ্ধান্তই জনস্বার্থ বা বিরোধী দলের কণ্ঠস্বরকে উপেক্ষা করে নেওয়া হবে না।’

তবে, বিএনপি ও তার মিত্ররা পিআর পদ্ধতির ঘোর বিরোধী। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘পিআর পদ্ধতি থাকা দেশে প্রায়শই অস্থিতিশীল সরকার ব্যবস্থা সৃষ্টি হয়। আমাদের উচিত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক মামুন আল মোস্তফা বলেন, ‘এই পদ্ধতিতে সহজেই স্বজনপ্রীতি করা যায়। কারণ, কাকে সংসদে পাঠানো হবে সেটি দলের ওপর নির্ভর করে।’

তিনি যুক্তি দেন যে, ‘ছোট দলগুলো প্রধানত পিআরের জন্য চাপ দিচ্ছে, কারণ তাদের সরাসরি নির্বাচনে জেতার মতো জনপ্রিয়তা বা সক্ষমতার অভাব রয়েছে। তারা পিআরকে সংসদে নিশ্চিত আসন পাওয়ার একটি শর্টকাট হিসেবে দেখছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আরেক অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমি একমত যে নিম্নকক্ষের জন্য এই মুহূর্তে পিআর পদ্ধতি চালু করা সম্ভব নয়। বেশির ভাগ সাধারণ নাগরিক এটি বুঝবেন না। তবে, উচ্চকক্ষে চালু করা যেতে পারে।’

বিকেপি/এমএইচএস

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

পিআর পদ্ধতির নির্বাচন সংসদ নির্বাচন

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর