নির্বাচনের আগে চীনের তৈরি যুদ্ধবিমান কেন কিনছে অন্তর্বর্তী সরকার

ডিজিটাল ডেস্ক
প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ১৪:১৬

ছবি : সংগৃহীত
চীনের তৈরি ২০টি জে-১০ সিই মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান কেনার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। খরচ হবে প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা (প্রায় ২.২ বিলিয়ন ডলার)। নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে এত বড় প্রতিরক্ষা চুক্তি হাতে নেওয়া নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে যেমন আলোচনা চলছে, তেমনি সামরিক বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মাঝেও প্রশ্ন উঠেছে এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে।
অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সম্প্রতি নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে এক স্ট্যাটাসে এ তথ্য প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর আধুনিকায়ন এবং জাতীয় আকাশ প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করতেই এই যুদ্ধবিমান কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তার ভাষ্য অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছরে এই চুক্তি বাস্তবায়নের আশা করা হচ্ছে। যুদ্ধবিমানগুলো সরাসরি ক্রয় বা সরকার থেকে সরকার (জিটুজি) চুক্তির মাধ্যমে কেনা হতে পারে বলেও জানান তিনি।
নির্বাচনের আগে কেন এই সিদ্ধান্ত?
সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের বর্তমান যুদ্ধবিমান বহর তুলনামূলক পুরোনো এবং সীমিত সক্ষমতাসম্পন্ন। আকাশ প্রতিরক্ষাকে শক্তিশালী করা ও আধুনিক প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বজায় রাখতে নতুন প্রজন্মের মাল্টিরোল ফাইটার প্রয়োজন। তবে প্রশ্ন উঠেছে, মাত্র কয়েক মাসের জন্য দায়িত্বে থাকা অন্তর্বর্তী সরকার এত বড় একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি কেন নিচ্ছে।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ.ন.ম মুনীরুজ্জামান বলেন, ‘যুদ্ধবিমান কেনা প্রতিরক্ষার জন্য অবশ্যই জরুরি। কিন্তু এত বড় ব্যয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত একটি পূর্ণ মেয়াদী নির্বাচিত সরকারের।’ তার মতে, নির্বাচনের আগে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত ভবিষ্যৎ সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হবে, যা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া নয়।
যুদ্ধবিমান কেনার আলোচনা শুরু হয়েছিল কবে?
বাংলাদেশে যুদ্ধবিমান কেনার আলোচনা নতুন নয়। ২০১৬ সাল থেকেই রাফাল, ইউরোফাইটার টাইফুন ও এফ-১৬ নিয়ে আলোচনা চলছিল। ২০২৩ সালে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁক্রো ঢাকায় এসে রাফাল বিমান বিক্রির প্রস্তাবও দেন। কিন্তু করোনা-পরবর্তী আর্থিক সংকটে বিষয়টি থেমে যায়। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে আবার এই আলোচনা নতুন করে সামনে এসেছে।
জে-১০ সিই যুদ্ধবিমান কতটা আধুনিক?
চীনের তৈরি জে-১০ সিই একটি চতুর্থ প্রজন্মের মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান। এটি আকাশ প্রতিরক্ষা এবং আক্রমণ— দুই ধরনের কাজেই ব্যবহৃত হতে পারে।
- কম জায়গায় দ্রুত ‘টেক অফ’ করতে সক্ষম হওয়ায় যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সুবিধাজনক।
- সিঙ্গেল ইঞ্জিন হলেও এর ম্যানুভারিং ক্ষমতা অনেক উন্নত, ফলে আকাশযুদ্ধে প্রতিপক্ষকে সহজে ফাঁকি দেওয়া যায়।
- শব্দের দ্বিগুণ গতিতে (ঘণ্টায় প্রায় ২,৪১৫ কিমি) চলতে সক্ষম।
- উন্নত রাডার সিস্টেম থাকায় প্রতিদ্বন্দ্বী রাফালের চেয়েও শক্তিশালী বলে অনেকে মনে করেন।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
গত বছর আগস্টে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। দায়িত্ব নেওয়ার পর তার প্রথম বিদেশ সফর ছিল চীন সফর। এর পর থেকে বাংলাদেশ-চীন প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে নানারকম জল্পনা চলছিল।
আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। ফলে নির্বাচনের মাত্র চার-পাঁচ মাস আগে অন্তর্বর্তী সরকারের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রশ্ন উঠেছে। সমালোচকরা বলছেন, স্বল্পমেয়াদি সরকারের দায়িত্ব দেশের দৈনন্দিন প্রশাসন চালানো, দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরক্ষা ক্রয় নয়।
তবে সরকারের ঘনিষ্ঠ মহল বলছে, বর্তমান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় বিমান বাহিনীকে আধুনিকায়ন করা বিলম্ব করা সম্ভব নয়। আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও প্রতিরক্ষার কৌশলগত প্রয়োজনে যুদ্ধবিমান কেনা জরুরি হয়ে পড়েছে।
ফলে চূড়ান্তভাবে এই চুক্তি কতদূর অগ্রসর হয়, নাকি নির্বাচিত সরকারের হাতে সিদ্ধান্ত ছেড়ে দেওয়া হয়— এখন সেটাই দেখার বিষয়।
এমএইচএস