Logo

জাতীয়

পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের দরপত্র নিয়ে বিতর্ক চরমে

Icon

বাংলাদেশের প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২৫, ১৩:২০

পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের দরপত্র নিয়ে বিতর্ক চরমে

পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা পরিবহন ও লাইটারিং পরিষেবার দরপত্র নিয়ে চরম বিতর্ক শুরু হয়েছে।

জানা গেছে, এসএইইটি-সিনোট্রান্স জেভি নামে একটি যৌথ কোম্পানির দরপত্রে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে বিতর্কিত সাউথ এশিয়া এনার্জি ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি কোম্পানি লিমিটেডের (এসএইইটি) নাম সবার উপরে রাখা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সরগরম বিতর্ক শুরু হয়েছে।

অনেকে মনে করছেন, এটি সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর প্রভাবিত কোনো ফাঁদ। এমন কার্যক্রম বাংলাদেশ প্রোকিউরমেন্ট অ্যাক্টেরও পরিপন্থী বলে অভিযোগ উঠেছে।

সূত্র জানায়, সাউথ এশিয়া এনার্জি ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি কোম্পানিটি বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিপিসিএল) চায়না অংশের মূল কোম্পানি চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশনের (সিএমসি) সঙ্গে যুক্ত। কোম্পানিটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিক হয়েও সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুকে সন্তুষ্ট করে প্রচলিত আইনের বাইরে গিয়ে বিনা টেন্ডারে ১০ বছরের জন্য কয়লা ও যন্ত্রাংশ সরবরাহের সুযোগ পায়। এতে সহযোগিতা করেন সাবেক মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের এমডি খুরশেদ আলম।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিসিপিসিএলের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াংজি একইসঙ্গে বিতর্কিত এসএইইটি-সিনোট্রান্স জেভিরও কার্যনির্বাহী ও মূল নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি হিসেবে যুক্ত আছেন। এটি বাংলাদেশের পাবলিক প্রোকিউরমেন্ট রুলস (পিপিআর) ২০০৮-এর ধারা ৫৫ ও শিডিউল ৯ অনুযায়ী স্পষ্ট স্বার্থবিরোধী বা কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের আওতায় পড়ে। সিএমসি এই অবৈধ সুযোগ কাজে লাগিয়ে উচ্চ মূল্যে কয়লা ও যন্ত্রাংশ সরবরাহ করে, যার প্রভাব পড়ছে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচে এবং সরাসরি ভোক্তাদের ওপর চাপ তৈরি হচ্ছে।

এছাড়া, বিদ্যুৎকেন্দ্রে আমদানি করা কয়লা গভীর সমুদ্র থেকে লাইটারিং করে কেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছানোর টেন্ডারেও সিএমসি প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে। পূর্বের টেন্ডারে সাউথ এশিয়া এনার্জি ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি কোম্পানি নিজস্ব ও বিশেষায়িত জাহাজের দলিলাদি উপস্থাপন করলেও চীন থেকে সেই জাহাজ পায়রায় আনা হয়নি। বিপরীতে স্থানীয়ভাবে নিম্নমানের ছোট জাহাজ ব্যবহার করে কাজ চালানো হয়েছে। এতে বেড়েছে সিস্টেম লস ও দুর্ঘটনার সম্ভাবনা। এবারের দরপত্রেও একই সমস্যা হতে পারে বলে অভিযোগ উঠেছে।

অভিযোগ রয়েছে, বিসিপিসিএলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক খুরশেদ আলম এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর মেয়াদকালে এসএইইটি ও সংশ্লিষ্ট চীনা কোম্পানিগুলোকে একাধিকবার টেন্ডারবিহীনভাবে সরাসরি চুক্তি দেওয়া হয়েছে। এতে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ও জনসম্পদের ক্ষতি হতে পারে।

সূত্রে বলা হয়, এসব অনিয়মের কারণে পূর্ববর্তী চুক্তিগুলোতে কয়লা সরবরাহ ও লাইটারিং পরিষেবায় অস্বচ্ছতা এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয়ে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটেছে।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সিএমসির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটি পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকারী কোম্পানি বিসিপিসিএলের অর্ধেক শেয়ার হোল্ডার। বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় কয়লা কিনতে ঋণ দেয় চীনা অংশীদার সিএমসি। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত এসএইইটি-সিনোট্রান্স জেভি বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা সরবরাহের দরপত্রে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে নাম আসায় বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা সরবরাহের টেন্ডারে মোট ৬-৭টি কোম্পানি অংশ নেন। এর মধ্যে ৩টি কোম্পানিকে সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। দেশ ট্রেডিং কর্পোরেশন অ্যান্ড বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের (জেভি) বিড মূল্য ৫৮৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা, বসুন্ধরা মাল্টি ট্রেডিং লিমিটেডের (বিএমটিএল) বিড ৫৭৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা এবং সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে এসএইইটি-সিনোট্রান্স জেভির বিড ৫৩৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বিসিপিসিএলের মালিক হিসেবে সিএমসির বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতা হওয়ার বিষয়টি স্বার্থসংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।

এ বিষয়ে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাজমুল হক বলেন, ‘বোর্ড বিষয়টি দেখছেন। মূলত কম রেট আমাদের মূখ্য। বোর্ড যা সিদ্ধান্ত নিবে সেটাই চূড়ান্ত হবে।’

বিএমটিএলের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তাদের উল্লেখিত মূল্যে ২০% ভ্যাট ও কর অন্তর্ভুক্ত ছিল। বিসিপিসিএল যদি ভ্যাট ও কর ছাড় দেয়, তাহলে তাদের মোট মূল্য ২০% কমে যাবে এবং এ ক্ষেত্রে বিএমটিএলের বিডই সর্বনিম্ন হবে। মো. নাজমুল হক বলেন, ‘টেন্ডার ডকুমেন্টের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ভ্যাট-ট্যাক্স যদি ডকুমেন্টে উল্লেখ থাকে, সেভাবেই বিবেচনা করা হবে।’

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল) বাংলাদেশের নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড ও চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশনের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত। প্রতিষ্ঠানটি ১৩২৯ মেগাওয়াটের পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে।

অভিযোগকারীরা বলছেন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পূর্ববর্তী সময়ে কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তির কারণে সিএমসি ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো টেন্ডার ছাড়াই বা সীমিত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কাজ পেয়েছে। এতে সরকারি অর্থব্যয়ে অস্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ও যৌথ উদ্যোগ প্রকল্পে বিদেশি অংশীদারদের সঙ্গে চুক্তি করার ক্ষেত্রে স্বার্থসংঘাত ও প্রভাবের ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে আরও কঠোর নীতিমালা প্রয়োগ প্রয়োজন। তারা সুপারিশ করেছেন, বিসিপিসিএলের বর্তমান ও পূর্ববর্তী সব টেন্ডার প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করা হোক, এসএইইটি ও সিএমসি সংক্রান্ত নথিপত্র স্বচ্ছভাবে প্রকাশ করা হোক এবং সম্ভাব্য স্বার্থবিরোধ আইন অনুযায়ী যাচাই করা হোক।

বিশেষজ্ঞরা দ্রুত নিরপেক্ষ ও স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে রাষ্ট্রীয় অর্থব্যয়, বিদ্যুৎ খাতের সুশাসন এবং প্রোকিউরমেন্টের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায়।

বিএস/এমএইচএস

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর