তরুণদের ভোটই হতে পারে নির্বাচনের ‘গেম চেঞ্জার’
প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ১২:১৬

গ্রাফিক্স : বাংলাদেশের খবর
- নতুন ৪৫ লাখ ভোটারসহ পাঁচ কোটি তরুণ ভোটার
- তরুণদের জন্য থাকতে পারে আলাদা বুথ
তিনটি বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কার্যত ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাননি দেশের সাধারণ মানুষ। নির্বাচনের নামে প্রহসনের ইতিহাসে জনগণের ভোটের অধিকার যেমন ক্ষুণ্ণ হয়েছে, তেমনি ভোটকেন্দ্রের প্রতি তাদের আস্থা ও আগ্রহও কমে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে। তবে ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের পর দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যে নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, তাতে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দেখা দিয়েছে নতুন আশা— বিশেষত তরুণ ভোটারদের মধ্যে।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি) বলছে, এবার তারা ভোটারদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছে। সম্প্রতি ইসি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করেছে, যা প্রায় এক দশক পর কোনো কমিশন হাতে নিয়েছে। প্রকাশিত খসড়া তালিকায় দেখা যায়, নতুন ভোটার যুক্ত হয়েছেন ৪৫ লাখ ৭১ হাজার ২১৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১৮ লাখ ৭০ হাজার ২০৩ জন, নারী ২৭ লাখ ৭৬২ জন এবং হিজড়া ভোটার ২৫১ জন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এবার তরুণ ভোটাররাই হতে পারেন নির্বাচনের ‘গেম চেঞ্জার’। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে বর্তমানে তরুণ ভোটারের সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি— যাদের একটি বড় অংশ প্রথমবারের মতো ভোট দেবে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, তরুণদের অংশগ্রহণ বাড়াতে সরকার এবার বিশেষ ব্যবস্থা নিচ্ছে। নারী ও পুরুষ তরুণদের জন্যও আলাদা বুথ থাকবে, যাতে তারা উৎসবমুখর পরিবেশে নিরাপদে ভোট দিতে পারেন।
নির্বাচন কমিশনও বলছে, জনগণ ভোটকেন্দ্রে যাওয়া ‘ভুলে গেছেন’। তাই ভোটে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিনের ভাষায়, ‘আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে আবার ভোটকেন্দ্রে ফিরিয়ে আনা।’ এজন্য ইসি বিভিন্ন সচেতনতামূলক প্রচার ও ভোটার শিক্ষা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে।
তরুণ ভোটারদের প্রভাব শুধু সংখ্যায় নয়, মনোভাবেও স্পষ্ট। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান এই প্রজন্মের রাজনৈতিক চেতনার নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। সংবিধান সংস্কার, নির্বাচন ব্যবস্থার পরিবর্তন, এবং স্বচ্ছ ভোটের দাবি— সবকিছুর কেন্দ্রেই ছিলেন তরুণরা। এখন সেই প্রজন্মই নির্বাচনী মাঠে বড় শক্তি হয়ে উঠছে।
রাজনৈতিক দলগুলোও তা বুঝতে পারছে। বিএনপি ও জামায়াতের অনুপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত বিগত নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল মাত্র ৪০ শতাংশের কাছাকাছি— বাস্তবে তা ৫ শতাংশের বেশি ছিল না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এবার তরুণ ভোটারদের সক্রিয় অংশগ্রহণ সেই ছবিটা বদলে দিতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিএনপি-জামায়াত বা ক্ষমতাসীন জোটের পাশাপাশি নতুন মুখ হিসেবে আবির্ভূত হওয়া জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) তরুণ ভোটে বড় ফ্যাক্টর হতে পারে।
ভোটার তালিকা হালনাগাদের মধ্য দিয়ে মৃত ভোটার বাদ দেওয়া হয়েছে ২১ লাখ ৩২ হাজার ৫৯০ জন। এখন মোট ভোটার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ কোটি ৬১ লাখ ৭০ হাজার ৯০০ জন। সিইসি জানিয়েছেন, পূর্বের একাধিক নির্বাচনে মৃত ব্যক্তির নামে ভোট পড়ার অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছিল— যাকে তিনি রসিকতার ভঙ্গিতে বলেছিলেন, ‘তারা কবর থেকে ভোট দিয়েছেন।’
নির্বাচন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. আব্দুল আলিম বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বড় নিয়ামক শক্তি হবে তরুণ ভোটাররা। যদি আপনি ভোটার তালিকার পরিসংখ্যান দেখেন, দেখবেন— তরুণ ভোটারের সংখ্যা এখন ঐতিহাসিকভাবে সর্বাধিক। এই বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীই নির্বাচনের ফল নির্ধারণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
ড. আলিম বলেন, ‘তরুণরা এখনো বেশিরভাগই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে— কাকে ভোট দেবে, কোন দল তাদের ভবিষ্যতের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা তারা এখনো ঠিক করে উঠতে পারেনি। কারণ রাজনৈতিক দলগুলোও এখনো নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে পারেনি। তারা নির্বাচনকালীন সরকার, ভোটের পদ্ধতি, অংশগ্রহণ এবং স্বচ্ছতা নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিতর্কে ব্যস্ত। ফলে তরুণ ভোটারদের মধ্যে অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জুলাই মুভমেন্টের স্পিরিট বা চেতনা হলো পরিবর্তন। তরুণ প্রজন্ম সেই পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছে— সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামোতে এক নতুন ধারা দেখতে চায় তারা। আমার ধারণা, যে রাজনৈতিক শক্তি বা জোট এই পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাকে সামনে আনতে পারবে, সেই পক্ষই শেষ পর্যন্ত তরুণদের আস্থা অর্জন করবে। তরুণরা কেবল প্রতিশ্রুতি নয়, বাস্তব পরিবর্তনের ইঙ্গিত চায়।’
ড. আলিমের মতে, রাজনৈতিক দলগুলো যদি এখন থেকেই তরুণদের বাস্তব সমস্যা— শিক্ষা, কর্মসংস্থান, দক্ষতা উন্নয়ন, এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণ— এই বিষয়গুলোতে স্পষ্ট কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরতে পারে, তাহলে সেই দল তরুণ ভোটের বড় অংশটিই নিজেদের পক্ষে টানতে পারবে।
এসআইবি/এমএইচএস