কক্সবাজারের পরিবর্তন ভবিষ্যতে নয়, এখনই চান নাগরিকেরা

বাংলাদেশের প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ১০:১০

ছবি : বাংলাদেশের খবর
কক্সবাজারের মানুষ আর শুধু ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে না। তারা চাইছে এখনই পরিবর্তন। উন্নয়ন যেন হয় মানুষের জন্য, পরিবেশের জন্য, আর জবাবদিহিমূলক শাসনের জন্য— এমন এক স্পষ্ট বার্তা উঠে এসেছে ‘কক্সবাজার গোল টেবিল ২০২৫’-এ।
শনিবার (১৮ অক্টোবর) রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে আয়োজিত এ গোলটেবিল আলোচনায় কক্সবাজার কমিউনিটি অ্যালায়েন্স (CCAD)-এর সাম্প্রতিক জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়। ১৩৪ জন শিক্ষিত, সচেতন ও স্থানীয় উন্নয়নে আগ্রহী নাগরিকের অংশগ্রহণে পরিচালিত জরিপটি তুলে ধরে কক্সবাজারবাসীর উদ্বেগ, প্রত্যাশা ও পরামর্শের প্রতিফলন।
জরিপে অংশ নেওয়া ৮৬ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, কক্সবাজারের অর্থনৈতিক অগ্রগতি নির্ভর করবে পর্যটন ও সৈকত ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের ওপর। তবে সেই উন্নয়ন হতে হবে পরিবেশবান্ধব ও নীল অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
৮৪ শতাংশ অংশগ্রহণকারী রোহিঙ্গা সংকট ও নিরাপত্তাকে জেলার প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। পরিবেশ দখল ও অব্যবস্থাপনাকে ৫৮.২ শতাংশ বলেছেন টেকসই উন্নয়নের বড় বাধা।
৩৬.৬ শতাংশ নাগরিক মনে করেন, পানি, বর্জ্য ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার দুর্বলতা এখনো উন্নয়ন পরিকল্পনার বড় ঘাটতি।
৯২ শতাংশ নাগরিকের মতে, দক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনই কক্সবাজারে আস্থা পুনঃস্থাপনের একমাত্র পথ। ৭৪ শতাংশ বলেছেন, স্থানীয় সরকারকে হতে হবে জবাবদিহিমূলক ও স্বচ্ছ।
সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রেও ৯১.৮ শতাংশ নাগরিক চান স্বচ্ছতা ও দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ।
জরিপে প্রায় ৬০ শতাংশ উত্তরদাতা বলছেন, পাহাড় ও বালিয়াড়ি দখলমুক্ত করা ছাড়া টেকসই পর্যটন সম্ভব নয়। নদী, খাল, জলাভূমি সংরক্ষণ ও আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ওপরও জোর দিয়েছেন অধিকাংশ অংশগ্রহণকারী।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কক্সবাজার ও আশপাশের এলাকার ভারসাম্য রক্ষা না হলে পর্যটন খাত নিজেই টিকে থাকতে পারবে না।
মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। ৬৭.২ শতাংশ মনে করেন, প্রকল্পটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে এবং ৬০.৪ শতাংশ বলছেন, এটি শিল্পায়নের নতুন গতি এনেছে।
তবে ৮৪.৩ শতাংশ নাগরিকের মতে, প্রকল্পটি পরিবেশে গুরুতর প্রভাব ফেলেছে— বায়ু দূষণ, জীববৈচিত্র্যের ক্ষয় ও সামাজিক অস্থিরতা তার মধ্যে অন্যতম। ভূমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ নিয়েও ৫৬.৭ শতাংশ উদ্বেগ জানিয়েছেন।
৮৮.১ শতাংশ নাগরিক মনে করেন, কক্সবাজারে মাদক, ছিনতাইসহ অপরাধ দ্রুত বাড়ছে। পর্যটক নিরাপত্তা নিয়ে ৬৩.৪ শতাংশ বলছেন, এখনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই।
নিরাপত্তা উদ্যোগে স্থানীয় অংশগ্রহণ কম— এমন মত দিয়েছেন ৫০.৭ শতাংশ। তারা মনে করেন, জনবল, সরঞ্জাম ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পরিবেশ ছাড়া নিরাপত্তা টেকসই হবে না।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ককে ছয় লেনে উন্নীত করার দাবি জানিয়েছেন ৭৬.১ শতাংশ উত্তরদাতা। তাদের মতে, দুর্ঘটনা হ্রাস, বাণিজ্য প্রবাহ বৃদ্ধি ও যোগাযোগের উন্নতির জন্য এটি অপরিহার্য।
গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে আলোচকরা বলেন, বড় প্রকল্প ও সরকারি বাজেটের ওপর নির্ভর করে উন্নয়ন টেকসই হয় না। প্রকৃত পরিবর্তন সম্ভব জনগণের অংশগ্রহণ, সুশাসন ও পারস্পরিক প্রতিশ্রুতির সমন্বয়ে।
বিশেষজ্ঞরা আরও মনে করেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, নিরাপত্তাহীনতা ও দুর্বল অবকাঠামো—এ তিন কারণেই বাংলাদেশের পর্যটন খাত বারবার পিছিয়ে পড়েছে। অনেক প্রকল্প সময়মতো শেষ না হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমছে।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কক্সবাজার কমিউনিটি অ্যালায়েন্সের প্রধান সমন্বয়ক মুহিব্বুল মুক্তাদির তানিম। উপস্থিত ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য ও জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ, সাবেক এমপি ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ সহিদুজ্জামানসহ কক্সবাজারের শিক্ষক, ডাক্তার, স্থপতি, আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী ও ছাত্র প্রতিনিধিরা।
আলোচনায় হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘কক্সবাজারের উন্নয়ন নিয়ে আজ যে সমস্যাগুলো উঠে এসেছে, তা রাজনৈতিক ভেদাভেদ ছাড়িয়ে সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করতে হবে। আগামীর নির্বাচিত সরকারের কাছে এ জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করে একটি সমাধান খুঁজে বের করা সময়ের দাবি।’
এমএএস/এমবি