আগুনে নাশকতার গন্ধ, নির্বাচন-পূর্ব অস্থিতিশীলতার শঙ্কা
প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ১৫:৩৬
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে শনিবার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ছবি : বাংলাদেশের খবর
- কেপিআই এলাকায় নিরাপত্তা ও প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন
- নির্বাচনের আগে সংবেদনশীল স্থাপনায় অগ্নিকাণ্ড রহস্যজনক
- ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ডে নাশকতার শঙ্কা, সরকারের গভীর পর্যবেক্ষণ
রাজধানী থেকে বন্দরনগরী— দেশের দুই গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় পরপর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিরাপত্তা, ব্যবস্থাপনা ও নাশকতার সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জনমনে তৈরি হচ্ছে নির্বাচন-পূর্ব অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির শঙ্কা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে এমন শঙ্কা প্রকাশ করছে দেশের বিভিন্ন মহল ও শ্রেণি-পেশার মানুষরা।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে শনিবার (১৮ অক্টোবর) দুপুরে যে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, তার ধোঁয়া এখনও মিলিয়ে যায়নি। এর দু’দিন আগে চট্টগ্রামের রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলের (সিইপিজেড) একটি পোশাক কারখানায় ভয়াবহ আগুনে কোটি টাকার পণ্য পুড়ে গেছে।
পরপর দুটি বড় অগ্নিকাণ্ডের এই ধারাবাহিকতা নিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এগুলো নিছক দুর্ঘটনা নয়, বরং পরিকল্পিত নাশকতার গন্ধ রয়েছে। তাদের মতে, সময়, স্থান এবং ক্ষতির ধরন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এর পেছনে কোনো সংগঠিত চক্রের পরিকল্পিত তৎপরতা থাকতে পারে, যা দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত।
তবে জনমনে সৃষ্ট শঙ্কাকে একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছে না সরকারও। শনিবার রাতে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, জনমনে সৃষ্ট শঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছে না সরকার। বরং সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে চলমান পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে সরকার। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাদের তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। নাশকতার প্রমাণ মিললে কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে সরকার।
অগ্নিনিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহমেদ খান বলছেন, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর একটি কেপিআইভুক্ত (Key Point Installation) এলাকা— যেখানে সার্বক্ষণিক মনিটরিং, নিরাপত্তা স্ক্যানিং এবং ফায়ার ইউনিটের প্রস্তুতি থাকা উচিত।
তার মতে, এমন সুরক্ষিত এলাকায় বড় আগুন লাগা এবং তা নিয়ন্ত্রণে আনতে দীর্ঘ সময় লাগা অস্বাভাবিক।
শুধু তাই নয়, যে স্থাপনাগুলোতে সর্বোচ্চ সতর্কতা থাকা উচিত, সেখানে এমন দুর্ঘটনা ঘটলে সেটা কেবল গাফিলতি নয়— বরং ইচ্ছাকৃত দুর্বলতা বা নাশকতার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
তিনি মনে করেন, বিমানবন্দরের মতো জায়গায় আগুন নেভাতে দীর্ঘ সময় লেগে যাওয়া প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া এবং অ্যালার্ম সিস্টেমের কার্যকারিতা নিয়েও বড় প্রশ্ন তোলে।
বিমানবন্দর ফায়ার ইউনিটের কাজ সাধারণত তাৎক্ষণিক। কিন্তু এই ঘটনায় বিলম্ব ও সমন্বয়ের অভাব চোখে পড়ার মতো। ফায়ার অ্যালার্ম বাজেনি, প্রাথমিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা তেমন কার্যকর হয়নি— ফলে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে।
ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বাংলাদেশের খবরকে বলেন, এতে হয়তো প্রযুক্তিগত ত্রুটি ছিল, অথবা কেউ সচেতনভাবে প্রতিরোধ ব্যবস্থা অকার্যকর করে রেখেছিল। উভয় ক্ষেত্রেই এটি বড় ধরনের নিরাপত্তা ব্যর্থতা।
অগ্নিকাণ্ডের শিকার দুই স্থাপনাই দেশের অর্থনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। একদিকে বিমানবন্দর, অন্যদিকে রপ্তানি খাতের পোশাক শিল্প— দুটি খাতই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মুখ। নির্বাচন-পূর্ব সময়কে লক্ষ্য করেই কেউ অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে চায়— এমনটা উল্লেখ করে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মাহমুদ হোসেন বলেন, যেভাবে সংবেদনশীল অবকাঠামোয় পরপর ঘটনা ঘটছে, তাতে এর পেছনে রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক বার্তা দেওয়ার উদ্দেশ্য থাকতে পারে। এই ধরনের নাশকতা দেশের ভাবমূর্তি ও বিনিয়োগ পরিবেশে ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে।
সংশ্লিষ্ট মহল বলছে, এখন প্রয়োজন ফরেনসিক ও সিসিটিভি-নির্ভর পূর্ণাঙ্গ তদন্ত। আগুনের সূত্রপাত কোথা থেকে, কোন দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করা হয়েছে, কারা প্রথম ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে— এসব প্রশ্নের উত্তর মিললে বোঝা যাবে এটি দুর্ঘটনা না পরিকল্পিত আগুন। তদন্তে প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর জোর দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহমেদ খান আরও বলেন, প্রতিটি বড় আগুনের ঘটনার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন। কেবল রিপোর্টে দায়সারা তদন্ত করলে সত্য প্রকাশ পাবে না।
ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা শাহজাহান শিকদার বাংলাদেশের খবরকে বলেন, চট্টগ্রামের ইপিজেডে আগুন লাগা ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা সনদ ছিল না, পাশাপাশি পর্যাপ্ত খোলা জায়গাও ছিল না।
ফায়ার সার্ভিসের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এমন জায়গায় প্রস্তুতির অভাবকে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কাজে লাগিয়ে ভয়াবহতা বাড়াতে পারে। তারা মনে করেন, গাফিলতির আড়ালে পরিকল্পিত ফাঁকফোকর লুকিয়ে থাকতে পারে, যা তদন্ত সাপেক্ষে জানা যাবে।
এমএইচএস



