Logo

জাতীয়

শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ছিলেন ফটোগ্রাফিক মেমোরির অধিকারী

Icon

এস ডি সুব্রত

প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:২২

শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ছিলেন ফটোগ্রাফিক মেমোরির অধিকারী

শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এক অবিস্মরণীয় নাম। একে ফজলুল হকের পুরো নাম আবুল কাশেম ফজলুল হক। তিনি ছিলেন কলকাতা করপোশনের প্রথম বাঙালি মুসলমান,  বাংলার প্রধানমন্ত্রী, পূর্বপাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, পুর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। প্রবল সাহস, প্রবাদতুল্য দানশীলতা, তুলনারহিত স্মৃতিশক্তি, ঋজু দীর্ঘদেহ, ভরাট জলদ গম্ভীর কণ্ঠস্বর তাকে রীতিমত কিংবদন্তী চরিত্রে পরিণত করেছে। তাকে নিয়ে রচিত হয়েছে আশ্চর্য সব গল্পকাহিনি। এর কিছু সত্য কিছু সাধারণ মানুষ ভালোবেসে রচনা করেছে মনের মাধুরী মিশিয়ে।

এ কে ফজলুল হক ছিলেন ফটোগ্রাফিক মেমরির অধিকারী। একবার যা পড়তেন বা দেখতেন বা শুনতেন তা কখনও ভুলতেন না। শোনা যায়, শিশু ফজলুল হক এক বই দুইবার পড়তেন না। তাই ছেলেবেলায় যে পড়া হয়ে যেত তা নাকি ছিঁড়ে ফেলতেন। তিনি ছিলেন দীর্ঘদেহী। যেমন দৈর্ঘ্যে তেমনি প্রস্থে। গায়ে ছিল প্রচণ্ড শক্তি। এক কিলে নারিকেল ছিলতে পারতেন, মুখের ভেতর পুরে দিতেন আস্ত আম। বাজারের সবচেয়ে বড় কাঁঠাল শেষ করতেও তার দ্বিতীয়জনের প্রয়োজন হতো না। এসব কারণেই প্রচলিত হয়েছে, খালি হাতে একবার বাঘ শিকার করেছিলেন বলেই নাকি তার নামের আগে যুক্ত হয়ে যায় ‘শের-ই-বাংলা’। এ নিয়ে দ্বিমত রয়েছে । আবুল কাশেম ফজলুল হক বাগ্মী হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন।

১৯১৬ সালে লক্ষ্ণৌ শহরে লীগ কংগ্রেসের যুক্ত অধিবেশনে তিনি যে প্রস্তাব উত্থাপন করেন, তাই বিখ্যাত ‘লক্ষ্ণৌ চুক্তি’ নামে অভিহিত হয়। ১৯১৮ সালে ফজলুল হক লিখিত ভারত মুসলিম লীগের দিল্লী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। সেখানে সভাপতি হিসেবে তার দেওয়া ভাষণ ইতিহাসের এক স্বর্ণ অধ্যায় হয়ে রয়েছে। ১৯৪০ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশনে জ্বালাময়ী বক্তৃতায় প্রথম পাকিস্তান প্রস্তাব পেশ করেন। 

তার বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে পাঞ্জাববাসীরা তাকে ‘শের-ই-বঙ্গাল’ উপাধি দেয়। ‘শের-ই-বঙ্গাল’ অর্থ বাংলার বাঘ। সেই থেকে তিনি শেরে বাংলা নামে পরিচিত। তিনি জীবনে আরো অনেক উপাধি পেয়েছেন। ১৯৫৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান তাকে ‘হিলাল-ই-পাকিস্তান’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রহিত হয়ে গেল। ব্রিটিশের এই হীন বিশ্বাসঘাতকতা স্যার সলিমুল্লাহর প্রাণে শেলসম বিদ্ধ হলো। তিনি এমন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দরবার পরিত্যাগ করে চলে এলেন এবং উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের শত অনুরোধ সত্ত্বেও দিল্লি ত্যাগ করে বাংলায় ফিরে এলেন। 

স্যার সলিমুল্লাহ জীবন্মৃত অবস্থায়  শেষযাত্রার অপেক্ষা করছিলেন। স্যার সলিমুল্লাহর একমাত্র চিন্তা হলো, তাঁর  পর মুসলিম বাংলার কান্ডারিবিহীন তরণির হাল কে ধরবে? কিন্তু ১৯১১ সালেই যখন ফজলুল হক ব্রিটিশের অন্যায়ের প্রতিবাদে চাকরির মাথায় পদাঘাত করে হাইকোর্টে ওকালতি শুরু করার বাসনা প্রকাশ করলেন, তখন মুসলিম বাংলায় পড়ে গেল কী অপূর্ব সাড়া! স্যার সলিমুল্লাহর আনন্দের সীমা রইল না। দাসত্বের শৃঙ্খল ছিন্ন করে ফজলুল হক কলকাতায় আসছেন শুনে কলকাতায় জাগল বিপুল সাড়া। শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে সারা কলকাতা যেন আনন্দে ফেটে পড়ল। 

দূরদর্শী নেতা স্যার সলিমুল্লাহর নির্দেশে নবাব আবদুল লতিফ, নবাব সেরাজুল ইসলাম, মি. আবুল কাসেম, নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী, মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মওলানা বেলায়েত হোসেন প্রমুখ কলকাতার যাবতীয় মুসলিম প্রধানের উদোগে শিয়ালদহ স্টেশন হলো লোকে লোকারণ্য। নেতৃত্বহীন সমাজ নেতা পাবে বলে জনগণ সেদিন দলে দলে ছুটে এসেছিল শিয়ালদহ স্টেশনে। ক্ষণজন্মা ফজলুল হক দেশ ও সমাজের জন্য পাগল না হয়ে দয়ামায়া, প্রেমবর্জিত, স্বার্থপর জীবন যাপন করতে পারলে এবং জীবনভর শুধু ওকালতি করলে তিনি অবাধে কোটি কোটি টাকা ব্যাংকে জমা করে, শেষ বয়সে অবসরকালে দাবা খেলার মতো বেশ আরাম-আয়েশ-বিলাসে ডুবে থেকেও রাজনীতির দাবা খেলায় হাতযশ দেখাতে পারতেন; কিন্তু ফজলুল হকের ভাগ্যলিপি ছিল অন্যরূপ।

ফজলুল হকের চাকরিত্যাগ, কলকাতা আগমন, হাইকোর্টে যোগদান সেদিনকার একটা ঐতিহাসিক ব্যাপার। তাঁর ওজস্বিনী বাগ্মিতায়, সাহস ও বীরত্বে শুধু স্যার সলিমুল্লাহই আশ্বস্ত হলেন না, মুসলমান সমাজেও দেখা দিল এক নবজাগরণ, নবচেতনা, নবপ্রাণচাঞ্চল্য, নব-আশা, নব-আকাক্সক্ষা এবং সর্বোপরি দুর্জয় সাহস। দূরদর্শী নেতা স্যার সলিমুল্লাহর ইঙ্গিতেই স্যার হাসান ইমাম, আলী ইমাম, মওলানা আকরম খাঁ প্রমুখ কলকাতার মুসলিম প্রধানগণ ফজলুল হককে নাগরিক সংবর্ধনা জ্ঞাপন এবং নেতৃত্ব বরণের জন্য সেদিন পাঁচ-ছয় হাজার টাকা চাঁদা আদায় করে এক বিরাট আয়োজন করলেন। সে নাগরিক সংবর্ধনায় মুসলিম বাংলার অবিসংবাদিত নেতা স্যার সলিমুল্লাহ স্বয়ং সভাপতিত্ব করেন। ফজলুল হক বিপদ দেখলে যদি সাবমেরিনের মতো ডুব দেবেন, তবে মসিবতের সামনে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াবে কে? ফজলুল হক যদি স্বার্থপর অর্থগৃধ্নু হবেন, তবে দান করে অন্যের দেনার ভারে দেউলিয়া হবে কে? 

ফজলুল হক যদি কঞ্জুস হবেন, তবে শত শত ছাত্রের সাহায্যের জন্য নিজের টাকা উজাড় করে আবার কাবুলির কাছে ঋণ করে পালিয়ে বেড়াবে কে? ফজলুল হক কৃপণ হলে, হূদয়হীন হলে স্কুল-মাদ্রাসা, কলেজ প্রতিষ্ঠায় অজস্র টাকা দান করবে কে? ফজলুল হক সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন হলে হিন্দু-ব্রাহ্মণের কন্যাদায় উদ্ধার করবে কে? ফজলুল হক অহংকারী হলে দীন-দরিদ্রের দরদি হতো কে? গরিবের মা-বাপ হতো কে? ভিক্ষুকদের নিয়ে একই সঙ্গে বসে খেত কে? এ কথা চিরসত্য যে ফজলুল হক হূদয়হীন ওকালতি এবং স্বার্থান্বেষী রাজনীতি করতে পারলে তাঁর মতো বিরাট প্রতিভাশালী ব্যক্তিকে জীবনে অত দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হতো না। 

১৯১৩ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কাউন্সিলের ঢাকা বিভাগীয় কেন্দ্রের শূন্য পদে সদস্য নির্বাচনের ব্যবস্থা হলো। তখনকার দিনে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার ছিল না। খাজনা ও সেসের ভিত্তিতেই ছিল ভোটাধিকার। ভোটারদের শতকরা ৯৫ জনই ছিল হিন্দু। অধিকন্তু বঙ্গভঙ্গ রহিতের পর হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের ভেতর যথেষ্ট তিক্ততা দেখা দিয়েছিল। কোনো মুসলমানই এ নির্বাচনে পদপ্রার্থী হতে সাহস করল না। কিন্তু দুঃসাহসী ফজলুল হক স্যার সলিমুল্লাহর ইঙ্গিতে তাঁরই মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনসংগ্রামে অবতীর্ণ হলেন। ওকালতি ব্যবসা তুলে রেখে ফজলুল হক রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। শক্তিশালী প্রতিদ্ব›দ্বী রায়বাহাদুর কুমার মহেন্দ্র মিত্রকে পরাজিত করে ফজলুল হক তাঁর অপরাজেয় রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। মুসলমান হয়ে বর্ণহিন্দুর ভোটে বর্ণহিন্দু প্রার্থীকে পরাজিত করে নির্বাচনে জয়ী হওয়া একমাত্র ফজলুল হকের পক্ষেই সম্ভব হয়েছে। ১৯১৩ সালে ৪০ বছর বয়সেই জাতি-ধর্মনির্বিশেষে বাংলার জনগণের কাছে ফজলুল হক কত জনপ্রিয় নেতা ছিলেন, তা আজকের দিনে ধারণা করা যায় না।

বঙ্গীয় আইনসভায় প্রবেশ করে প্রথম অধিবেশনেই ফজলুল হক সারগর্ভ বক্তৃতা দান করেন, তা আইনসভায় এমন বিস্ময় সৃষ্টি করেছিল যে বাংলার লাট লর্ড কারমাইকেল সভাপতির উচ্চাসন থেকে নেমে এসে ফজলুল হকের সঙ্গে করমর্দন করেন এবং ভারতের তদানীন্তন সেরা বাগ্মী স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি ও বিপিনচন্দ্র পাল তাঁর বাগ্মিতার ভূয়সী প্রশংসা করেন। ১৯১৩ সালে স্যার সলিমুল্লাহ যখন বঙ্গীয় মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট, তখন ফজলুল হক হলেন তাঁর সেক্রেটারি। এই সময় ফজলুল হক অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগেরও ছিলেন যুগ্ম সম্পাদক। এই বছরই তিনি মি. মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তাঁর লীগে যোগদানের ব্যবস্থা করেন। ১৯১৪ সালে ইউরোপে প্রথম মহাযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠার আগেই স্যার সলিমুল্লাহ কলকাতায় প্রাণত্যাগ করেন। অতঃপর মুসলিম বাংলার নেতৃত্বের গুরুদায়িত্বভার সম্পূর্ণভাবে এসে পড়ল দেশদরদি ফজলুল হকের স্কন্ধে।

১৯৪৬ সালের ৯ই এপ্রিল দিল্লিতে মুসলিম লীগের নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্যদের এক কনভেনশনে জিন্নাহর পরামর্শে অবিভক্ত বাংলার তখনকার প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী ‘লাহোর প্রস্তাবে’র কয়েকটি শব্দ বদলে দিয়ে এক পাকিস্তানের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলছেন যে লাহোরে প্রস্তাবে মিস্টার হক পাকিস্তান শব্দটিই উল্লেখ করেননি। তবে তিনি মুসলিম এলাকাগুলো নিয়ে রাষ্ট্রসমূহের কথা বলেছেন। অন্যদিকে জিন্না ও সোহরাওয়ার্দির তৎপরতায় সামনে এককেন্দ্রিক পাকিস্তানের ধারণা সামনে চলে আসার পর দেশভাগে আর মিস্টার হকের তেমন কোন তৎপরতা দেখা যায় না। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সাতাশতম বার্ষিক অধিবেশনে তখনকার বাংলার নেতা ও প্রধানমন্ত্রী আবুল কাশেম ফজলুল হক প্রস্তাব উত্থাপন করেন যে ‘যেসব অঞ্চলে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, যেমন ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল এবং পূর্বাঞ্চল-সেগুলো একই দলভুক্ত হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠন করতে পারে, যেখানে গঠনকারী প্রতিটি ইউনিট হবে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ।

বিকেপি/এমবি

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর