Logo

জাতীয়

একই দিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট : বাড়তি চাপে ইসি

সাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া

সাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া

প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৫, ১৫:১৮

একই দিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট : বাড়তি চাপে ইসি

গ্রাফিক্স : বাংলাদেশের খবর

বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থায় এবার যুক্ত হতে যাচ্ছে একটি নতুন অভিজ্ঞতা— একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং গণভোট। দেশের ইতিহাসে এর আগে তিনবার গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে, তবে সেগুলো সবই স্বতন্ত্র আয়োজন ছিল। তাই ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের দিনই চারটি প্রশ্নে গণভোট আয়োজনের সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সামনে একটি নতুন প্রশাসনিক, প্রযুক্তিগত ও লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে।

সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ঘোষণা দেন, ভোটাররা একই দিনে নিজেদের সংসদ সদস্য নির্বাচনের পাশাপাশি দেশের চারটি মৌলিক প্রশ্নে মতামত জানাবেন। এই ঘোষণার পর থেকেই নির্বাচন কমিশন একযোগে দুই ভোট আয়োজনের প্রাক-প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে।

এক কেন্দ্রে দুই ভোট : ব্যবস্থাপনায় বাড়তি সতর্কতা
ইসি কর্মকর্তাদের মতে, একই কেন্দ্রে সংসদ নির্বাচন এবং গণভোট পরিচালনা করতে হলে বর্তমান কেন্দ্র বিন্যাস ও স্টাফিং প্যাটার্নে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে।

ব্যালট বাক্স আলাদা করে কেনার পরিকল্পনা নেই। বিদ্যমান স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সই ব্যবহার হবে; তবে সংসদ নির্বাচনের আলাদা ব্যালট এবং গণভোটের ব্যালট স্পষ্টভাবে চিহ্নিত রাখা হবে।

বেশিরভাগ কেন্দ্রে ভোটারের চাপ বেশি হওয়ায় অতিরিক্ত বুথ স্থাপন এবং সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বাড়ানোর বিষয়ে কমিশনের অভ্যন্তরে আলোচনা চলছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ‘দুটি ভোট পুরোপুরি ভিন্ন পদ্ধতিতে গ্রহণ ও গণনা করতে হয়। তাই ভোট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের ধরনও আলাদা হবে।’

গণভোটে ভোট গণনার সময় তুলনামূলক বেশি লাগে। ব্যালটে সাধারণত ‘হ্যাঁ-না’ ধরনের উত্তর থাকলেও প্রতিটি ব্যালট যাচাই করতে হয় হাতে ধরে। তাই ভোট শেষে গণনা কাজ দ্রুত শেষ করতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আগাম মহড়া, সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন এবং ‘চেকলিস্ট’ সরবরাহ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

প্রবাসীদের পোস্টাল ব্যালট : সবচেয়ে জটিল অংশ
প্রথমবারের মতো বিদেশে থাকা বাংলাদেশিরা পোস্টাল ব্যালটে শুধু সংসদ নির্বাচন নয়, গণভোটেও অংশ নিতে পারবেন। এই অংশটাই ইসির কাছে সবচেয়ে বড় প্রযুক্তিগত ও প্রশাসনিক পরীক্ষা বলে মনে করছেন সাবেক কর্মকর্তারা।

ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী বলেন, ‘দুটি আলাদা ব্যালট প্রস্তুত, সেগুলো বিদেশে পাঠানো, সময়মতো ফেরত আনা এবং আলাদাভাবে গণনা— সব মিলিয়ে এটিই এই নির্বাচনের সবচেয়ে কঠিন কাজ।’

এ ধরনের পোস্টাল ব্যালটে ব্যালট মুদ্রণ, কনস্যুলার অফিসের মাধ্যমে প্রেরণ, ডাকবিভাগের সমন্বয়, ফেরত আসা ব্যালট সংরক্ষণ এবং গোপনীয়তা রক্ষাসহ একাধিক ধাপ রয়েছে। এসব দফায় সামান্য গড়বড়ও পুরো গণভোটের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে— তাই কমিশন আগাম চিত্র বিশ্লেষণ করে একটি সমন্বিত নির্দেশনা প্রস্তুত করছে।

নিরাপত্তা, লজিস্টিক ও ব্যয়— সকল প্রান্তে বাড়তি চাপ
একই দিনে দুটি ভোট হওয়ায় নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বাড়তি সতর্কতা নিতে হবে। ভোটারদের ভিড় বেশি হওয়ার পাশাপাশি ব্যালটের সংখ্যা দ্বিগুণ, কর্মকর্তাও বেশি— এসব কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কেন্দ্রভেদে অতিরিক্ত মোতায়েনের প্রয়োজন হতে পারে।

নিরাপত্তা, পরিবহন, ব্যালট মুদ্রণ, সচেতনতামূলক প্রচারণা— সব ক্ষেত্রেই ইসি ও সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বয় প্রয়োজন হবে।

ইসির প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮০০ কোটি টাকা। পৃথক দিনে গণভোট হলে ব্যয় আরও কয়েকশ কোটি টাকা বাড়ত। একই দিনে ভোটগ্রহণ করায় ব্যয় কিছুটা কমলেও, মাঠপর্যায়ে সমন্বয়ের চাপ দ্বিগুণ হয়ে যাবে— বলছে কমিশন সূত্র।

প্রচার ও সচেতনতা বাড়াতে গণভোট সংক্রান্ত ‘জনসচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন’-এর ব্যয় প্রচলিত নির্বাচনী ব্যয়ের তুলনায় প্রায় ২০–২৫ শতাংশ বেশি হতে পারে বলে অনুমান করছে সংশ্লিষ্ট বিভাগ।

প্রযুক্তির ব্যবহার : ই-ট্রেনিং ও রিয়েল-টাইম মনিটরিংযয়ের পরিকল্পনা
কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণে প্রথমবারের মতো অনলাইন-ভিত্তিক ‘ই-ট্রেনিং মডিউল’ চালু রাখতে চায় ইসি, যাতে সব পর্যায়ের কর্মকর্তারা একই নির্দেশনা পেতে পারেন।

এছাড়া ভোটের দিন রিয়েল-টাইম মনিটরিংয়ের জন্য ডেটা সেন্টারের সক্ষমতা বাড়ানো এবং জেলা নির্বাচন কার্যালয় থেকে কেন্দ্রভিত্তিক রিপোর্টিং আরও দ্রুত করার পরিকল্পনা রয়েছে।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া : কেউ সন্তুষ্ট, কেউ সংশয়ী
একই দিনে গণভোট আয়োজনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান ভিন্ন ছিল। জামায়াতে ইসলামী ও কয়েকটি ছোট দল দীর্ঘদিন ধরে দাবি করছিল— গণভোট আলাদা দিনে অনুষ্ঠিত হোক। বিপরীতে বিএনপি ও তাদের শরিক দলগুলো চাইছিল নির্বাচনের দিনেই গণভোট হোক, যাতে জনগণের অংশগ্রহণ বেশি হয়।

শেষ পর্যন্ত বিএনপির মতই বিবেচনায় আসে। তবে কিছু রাজনৈতিক দল বলছে— দুটি ভোট একদিনে হলে ভোটারদের বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে। অন্যদিকে সরকারের পক্ষে যুক্তি— একদিনে হলে ব্যয় কমবে এবং জনসাধারণের ঝামেলাও কমবে।

প্রধান উপদেষ্টার গণভোট ঘোষণার পর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, ‘প্রজ্ঞাপন পাওয়ার পর কমিশন বিস্তারিত প্রক্রিয়া ঘোষণা করবে। সবকিছুই স্বচ্ছ ও ভোটারসহায়ক রাখতে চাই।’

মাঠপর্যায়ের প্রস্তুতি : কেন্দ্র চিহ্নিতকরণ শুরু 
জেলা ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ইতোমধ্যে বৈঠক করে সম্ভাব্য কেন্দ্রসংখ্যা, বুথের ক্ষমতা, ভোটার চাপ এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি বিশ্লেষণের নির্দেশ দিয়েছে কমিশন। অনেক এলাকায় বিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানের কক্ষ কম, সেখানে অস্থায়ী বুথ বাড়ানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। 

শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেও কেন্দ্র ব্যবহারের তালিকা চাওয়া হয়েছে, যাতে আগাম বরাদ্দ নিশ্চিত করা যায়।

ইসি সূত্র বলছে, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হতে পারে। ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে। একই দিনে চারটি প্রশ্নে গণভোটও অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থায় এই ‘দ্বৈত ভোটগ্রহণ’ এক নতুন মাত্রা যোগ করছে। ইসির লক্ষ্য— একই দিনে দুই ধরনের ভোট যেন নির্বিঘ্নে, শান্তিপূর্ণভাবে এবং স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন হয়।

এসআইবি/এমএইচএস 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

গণভোট সংসদ নির্বাচন নির্বাচন কমিশন

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর