বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশিদের ভিসা দিচ্ছে না কেন?
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৫, ১৬:৪৮
বিদেশে পড়তে যেতে লম্বা সময় ধরে চেষ্টা করেছেন, পেয়েছেন স্কলারশিপও। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ভিসা না পাওয়া কারণে যেতে পারেননি। এমন ঘটনা ঘটেছে অনেক বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সঙ্গেই। তেমনই একজন তানজুমান আলম ঝুমা।
এক বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি হাঙ্গেরি ও যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। স্কলারশিপ পেয়েও শুধু ভিসা জটিলতার কারণে দুই দেশের কোনোটিতেই যেতে পারেননি।
তানজুমান আলম ঝুমা বলেন, ‘অক্টোবর মাসে বুদাপেস্টে আবেদন করি। জানুয়ারিতে সেটি আমার জন্য ‘না’ হয়ে আসে। পরে জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আবেদন করি। মোটামুটি গত বছর অক্টোবর থেকে এই নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় এক বছরের বেশি সময় আমার এর পেছনে গেছে।’
শুধু শিক্ষার্থী ভিসাই নয়, বহুদেশ ভ্রমণকারী বা কাজের জন্য শ্রমিক ভিসাও সহজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনকি ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলো থেকেও, যেখান থেকে আগে সহজে ভিসা পাওয়া যেত, এখন অনেক ক্ষেত্রে ভিসা দেওয়া হচ্ছে না বলে খাত সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন।
অথচ ভারতের পর্যটন ভিসা ছাড়া কার্যত কোনো দেশই বাংলাদেশের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভিসার অপব্যবহার করে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে, যার ফলে বাংলাদেশের বিশ্বাসযোগ্যতা কমেছে। এছাড়া দেশের বাইরে রাজনৈতিক দলের কর্মী ও সমর্থকদের প্রকাশ্য বিবাদেও দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে পাসপোর্টের র্যাংকিংয়ে নিচে নেমে যাওয়া কথাটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে বলে মনে করছেন অনেকে।
কোন দেশগুলো ভিসা দিচ্ছে না?
কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা না থাকার পরও বাংলাদেশিদের ভিসা দিচ্ছে না বেশ কয়েকটি দেশ। বিদেশে পড়তে, কাজ করতে বা বেড়াতে আগ্রহীদের অনেকেই এমন অভিযোগ জানিয়েছেন। পর্যটন খাত সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, দেশগুলো ভ্রমণসহ বিভিন্ন ধরনের ভিসা দিচ্ছে না।
ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব)-এর সভাপতি মো. রাফেউজ্জামান বলেন, “ইন্ডিয়া, ইউএই, কাতার, বাহরাইন, ওমান, উজবেকিস্তান, সৌদি আরব, ভিয়েতনাম এই সব দেশ আমাদের ভিসা দিচ্ছে না।” তিনি আরও বলেন, “থাইল্যান্ডের ভিসা অনেক বেশি সময় নেয়। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার ভিসার রেশিও কম। ফিলিপাইনের ভিসা অনেক সময় নিচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ার ভিসা ফি অনেক। এমনকি অ্যারাইভাল ভিসা দেওয়া শ্রীলঙ্কার ইলেকট্রনিক ভিসা হয়ে উঠছে দুই-তিন দিনে।”
২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর ভারতের সরকার ভারতীয় পর্যটন ভিসা স্থগিত করে। দেশটির এই সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিক হিসেবে দেখা হলেও, ঘোষণা ছাড়াই ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার অনেক দেশ থেকে সব ধরনের ভিসা পাওয়াই কঠিন হয়ে উঠেছে।
পর্যটন ব্যবসায়ীরা বলছেন, এতগুলো দেশের ভিসা নিয়ে জটিলতা খুব দীর্ঘমেয়াদি নয়। পর্যটন ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন সেলিম বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছরই বাংলাদেশিদের জন্য পাঁচ-ছয় লাখ ভি১, ভি২ ভিসা দিয়ে থাকে। কিন্তু এ বছর দু’লাখের বেশি ভিসা দেয়নি।” তিনি আরও বলেন, “ইউএস, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা ২০২৩-২৪ সালে অনেক ভিসা দিয়েছে। পাসপোর্টের মেয়াদ পর্যন্ত ভিসা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ বছর কোনো ভিসা দেওয়া হচ্ছে না।”
কেন ভিসা দেওয়া হচ্ছে না?
ভিসা জটিলতার কারণে অনেকেই দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে দায়ী করছেন। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এর মূল আরও গভীরে। অনিয়মিত পথে বাংলাদেশিদের বিভিন্ন দেশে প্রবেশ এবং সহজলভ্য দেশের ভিসা নিয়ে অন্য দেশে যাওয়ার প্রবণতা দেশগুলোর প্রশাসনের চোখে পড়েছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, “ভিসা পাওয়ার সুযোগ বা অপব্যবহার করে অনেকে অনিয়মিতভাবে যাচ্ছে। সে কারণে দেশগুলো সতর্ক হচ্ছে। যেমন – ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ভ্রমণ ভিসা নিয়ে শ্রমিক ভিসায় রূপান্তর করছে। প্রতিবেশী দেশ থেকে ভিসা নিয়ন্ত্রণের কারণে আরও সতর্কতা দেখা দিয়েছে। যার কারণে অল্পসংখ্যক মানুষের ‘অনিয়মিত’ কর্মকাণ্ডের ফলে অনেকেই ভোগান্তি পেয়ে যাচ্ছে।”
সরাসরি কোন্দল বা বিবাদে জড়ানোর ঘটনা দেশের ভাবমূর্তিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যা ভিসা জটিলতায় প্রকাশ পাচ্ছে।
পাসপোর্ট র্যাংকিংয়ের কথাও আসে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের তথ্যমতে, দুর্বলতম পাসপোর্ট তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। বিশ্বের ৩৮টি দেশে বাংলাদেশি নাগরিকরা ভিসা ছাড়াই যেতে পারেন, তবে এসব দেশ আফ্রিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের এবং ভ্রমণের প্রবণতাও কম। রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতায় অবৈধ অভিবাসনের চেষ্টা বেড়েছে।
সমাধান কি আছে?
গত বছর ডিসেম্বরে ভারতের ভিসা সীমিত থাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো ভিসা সেন্টার দিল্লি থেকে অন্য দেশে সরানোর জন্য কূটনীতিকদের অনুরোধ করা হয়। তিন মাস পর মার্চে ঢাকা থেকেও নয়টি দেশের ভিসা প্রক্রিয়া শুরু হয়, তবে জটিলতা দেখা দেয়।
সংবাদমাধ্যমে ভিসা জটিলতার কথা স্বীকার করেছেন পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা। তবে কার্যকর কোনো উদ্যোগ এখনও দেখা যাচ্ছে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের ভ্রমণ ভিসার জটিলতা পুরোপুরি রাজনৈতিক। নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত পরিস্থিতি বদলানো কঠিন। তবে ভারত ছাড়া অন্যান্য দেশে কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব। অসৎ উপায়ে যারা বিদেশে মানুষ পাঠাচ্ছেন বা যাচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির আরও বলেন, “দেশের ভেতরে যথোপযুক্ত আইনি প্রক্রিয়ায় সমাধান দৃশ্যমান করা গেলে, ভিসা প্রক্রিয়ার বর্তমান জটিলতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।”
সূত্র : বিবিসি বাংলা

