গতকাল ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে বাংলাদেশ। ভূমিকম্পের ফলে পুরান ঢাকায় ভবনের রেলিং ধসে তিনজন, নারায়ণগঞ্জে দেয়াল ধসে এক শিশু ও নরসিংদীতে বাসার দেওয়াল চাপা পড়ে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সবার মনে। এর আগে ২০২৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তুরষ্ক-সিরিয়ায় আঘাত হানা শক্তিশালী ভূমিকম্প আতঙ্ক ছড়ায় বিশ্ববাসীর মনে। ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্প ও তার কয়েকটি আফটারশক (মূল ভূমিকম্পের পর পুনরায় ভূকম্পন)-এর কারণে নিহতের সংখ্যা ৪০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয় লাখ-লাখ মানুষ। ভূমিকম্পের এই ভয়াবহ চিত্র দেখে অনেক ভূমিকম্পপ্রবণ দেশই সেসময় চিন্তিত হয়ে উঠে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে।
এদিকে সা¤প্রতিক সময়গুলোতে বাংলাদেশে স্বল্প ও মাঝারি মাত্রার বেশ কিছু ভূমিকম্প হয়েছে। তবে এগুলোর কোনোটিতেই দৃশ্যমান ক্ষয়ক্ষতি ঘটেনি। ভূমিকম্পের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় অবস্থান হওয়ায় বিশেষজ্ঞরা বারবারই সতর্কবার্তা দিচ্ছেন দুর্যোগের পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করতে। তবে ভূমিকম্প দুর্যোগ মোকাবেলায় মজবুত ও নিরাপদ ভবন বানাতে সঠিক পরিকল্পনার বিকল্প নেই। ভবন নির্মাণের সময় মান নিয়ন্ত্রণের বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। সরকারিভাবে জাতীয় ভবন নির্মাণ নীতিমালা তো মানতেই হবে, সেই সঙ্গে ভবনটি যথাযথ নিরাপদ ও মজবুত হচ্ছে কি না, সে ভাবনাও মাথায় রাখতে হবে।
ভূমিকম্পের ক্ষতি কেমন হয়
দুর্বলভাবে তৈরি ভবনের কারণেই ভূমিকম্পে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। বাংলাদেশে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় থেকে শুরু করে বন্যা পর্যন্ত বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিভিন্ন ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। অতীতে ভয়াবহ ভূমিকম্পে নানা দুর্যোগ দেখা গেছে।
গত শতাব্দীতে এ অঞ্চলে বেশ কয়েকটি বড় ঘটনা ঘটেছে। ঐতিহাসিক তথ্য থেকে বলা যায়, বাংলাদেশ বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। সা¤প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে স্বল্প ও মাঝারি মাত্রার বেশ কিছু ভূমিকম্প হয়েছে। সেই হিসাবে বাংলাদেশে নিকট ভবিষ্যতের যেকোনো সময় ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। ২০১০ সালের হাইতি ও চিলির ভূমিকম্পের তুলনা করলে ভূমিকম্পের ঘটনায় কাঠামোগত ব্যর্থতার কারণে মানবিক ক্ষতি বেশি হতে দেখা যায়। ২০২৩ সালে তুরস্কে ভূমিকম্পে ভবনধসের মাধ্যমে প্রায় ৫৩ হাজার ৫০০ মানুষ নিহত হয়। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দুর্বলভাবে ভবন নির্মাণের কারণে সেসব এলাকায় দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু বেশি হয়।
নিরাপদ ভবন নির্মাণে যা খেয়াল রাখবেন
বাংলাদেশে নিরাপদ, শক্তিশালী এবং ভূমিকম্প প্রতিরোধী কাঠামো উন্নয়নের জন্য একটি বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন। ভৌগোলিকভাবে ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় বাংলাদেশের বড় বড় শহর ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে রয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ছাড়াও পুরোনো, দুর্বল কাঠামোগত ভবন এই ঝুঁকিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য একটি কার্যকর বৈজ্ঞানিক ও বাস্তবসম্মত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। একটি শক্তিশালী ও ভূমিকম্প-সহনীয় নগরী গড়ে তুলতে হলে নতুন ভবন নির্মাণে নজর দিতে হবে। একই সঙ্গে বিদ্যমান ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও সামগ্রিক প্রস্তুতি গড়ে তোলাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
বিদ্যমান কাঠামোর মূল্যায়ন ও অগ্রাধিকার নির্ধারণ
ভূমিকম্প-সহনশীলতার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো শহরের বিদ্যমান ভবনের কাঠামোগত মূল্যায়ন। এর মাধ্যমে কোন ভবনগুলো দুর্বল, সেটা জানা যাবে। এতে ভবনটি মাঝারি, দুর্বল, নাকি তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী, তা চিহ্নিত করতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় সরকারিভাবে কার্যকর কর্তৃপক্ষকে মনোযোগ দিতে হবে। প্রাথমিক মূল্যায়নের মাধ্যমে বিভিন্ন ভবনের ফ্যাক্টর অব সেফটি (এফওএস) জানতে হবে। বিশদ প্রকৌশলগত মূল্যায়ন (ডিইএ) করতে হবে।
জায়গা নির্বাচন
ভবন নির্মাণের জন্য মাটি পরীক্ষা ও স্থানের সঠিক নির্বাচন করতে হবে ভিত্তির সুরক্ষার জন্য। একটি ভূমিকম্প-সহনীয় কাঠামোর প্রথম ধাপ হলো মাটি পরীক্ষা বা সয়েল টেস্ট। ভবন যেখানে নির্মাণ করা হবে, সেখানে মাটির ধরন, ভারবহনের ক্ষমতা এবং ভূমিকম্পের সময় প্রতিক্রিয়া (যেমন তরলীকরণ) সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরি। নরম মাটি বা ভরাট করা জমিতে ভূমিকম্পের প্রভাব বেশি হয়। অভিজ্ঞ ভূতাত্ত্বিক ও প্রকৌশলীদের দ্বারা মাটির পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করে উপযুক্ত স্থানে ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। যদি স্থানটি দুর্বল হয়, তবে মাটিকে শক্তিশালী করার জন্য বিশেষ পদ্ধতি (যেমন পাইল ফাউন্ডেশন) অবলম্বন করতে হবে।
নকশা
একটি ভূমিকম্প-সহনীয় বাড়ির মূল ভিত্তি হলো সঠিক নকশা। বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুসরণ করে অভিজ্ঞ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ও স্থপতিদের দ্বারা নকশা প্রণয়ন অত্যাবশ্যক। নকশার সময় বিভিন্ন মৌলিক বিষয় বিবেচনা করতে হয়। ভূমিকম্পের সময় অনিয়মিত আকারের ভবনগুলো বেশি ঝুঁকিতে থাকে। বর্গাকার বা আয়তাকার নকশা ভূমিকম্পের শক্তিকে সমানভাবে বিতরণ করতে সাহায্য করে। দেয়াল ও কলামের বিন্যাস এমন হওয়া উচিত, যাতে ভবনের ওজন ও ভূমিকম্পের শক্তি সমানভাবে নিচে নেমে আসে। কাঠামোকে যথেষ্ট শক্তিশালী হতে হবে, যাতে এটি উল্লম্ব ও অনুভূমিক-উভয় ভার (ভূমিকম্পের ধাক্কা) সহ্য করতে পারে। একই সঙ্গে উপাদানগুলোতে প্রয়োজনীয় নমনীয়তা থাকতে হবে, যাতে ভূমিকম্পের সময় কিছুটা বিকৃত হলেও যেন ভেঙে না পড়ে। রিইনফোর্সড কংক্রিটের (আরসি) সঠিক ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খাটো বা ছোট কলাম ভূমিকম্পের সময় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নকশার সময় এ ধরনের কলাম এড়িয়ে চলা উচিত। পাশাপাশি থাকা ভবনগুলোর মধ্যে পর্যাপ্ত ফাঁকা জায়গা রাখতে হবে, যাতে ভূমিকম্পের সময় তারা একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা না খায়।
মানসম্মত নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার
নকশা যতই ভালো হোক না কেন, নির্মাণসামগ্রীর মান ভালো না হলে বিপদ বাড়তে পারে। ভবন নির্মাণে উচ্চ-টানের (হাই-টেনসাইল) রড ব্যবহার করা উচিত। রড যেন মানসম্পন্ন হয়। রডে যেন মরিচা না ধরে থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। রডের সঠিক ব্যাস ও পরিমাণ নকশা অনুযায়ী হতে হবে। ভবন নির্মাণে ভালো মানের সিমেন্ট ব্যবহার করা অত্যাবশ্যক। সিমেন্টের গুণগত মান কংক্রিটের শক্তি নির্ধারণ করে। এ ছাড়া পরিষ্কার, সঠিক গ্রেডের বালু ব্যবহার করতে হবে। শক্তিশালী খোয়া ব্যবহার করতে হবে। এতে কংক্রিটের সঠিক মিশ্রণ এবং শক্তি নিশ্চিত হবে। কংক্রিটের মিশ্রণ যেন সঠিক অনুপাতে হয়, তা খেয়াল রাখতে হবে।
সঠিক নির্মাণপ্রক্রিয়া ও তদারকি
নির্মাণপ্রক্রিয়া চলাকালে প্রতিটি ধাপে সঠিক তদারকি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফাউন্ডেশনের কাজ অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে করতে হবে। পুরো ভবনের ভিত্তি হিসেবে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। মাটির ধরনের ওপর ভিত্তি করে উপযুক্ত ফাউন্ডেশন (যেমন স্ট্রিপ, ম্যাট বা পাইল) নির্মাণ করতে হবে। কলাম ও বিমের রড বাঁধাই এবং কংক্রিট ঢালাইয়ের সময় প্রকৌশলীর নির্দেশনা কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে। কলাম ও বিমের সঠিক অ্যালাইনমেন্ট ও আচ্ছাদন নিশ্চিত করা জরুরি। কলাম, বিম এবং স্ল্যাবের সংযোগস্থল সঠিকভাবে নির্মাণ করা অত্যন্ত জরুরি। বৈদ্যুতিক ও প্লাম্বিং লাইন বসানোর সময় কাঠামোর কোনো দুর্বলতা তৈরি হচ্ছে কি না, খেয়াল রাখতে হবে।
বিকেপি/এমবি

