বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই নির্বাচন দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। স্বাধীনতার পর প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালে। এরপর পর্যায়ক্রমে আরও এগারোটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে— যার বেশিরভাগেরই স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক উঠেছে।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় নির্বাচনকে সাধারণ জনগণের আশা ও অংশগ্রহণের প্রতীক হিসেবে দেখা হলেও বাস্তবে রাজনৈতিক উত্তেজনা, সরকার ও বিরোধী দলের দ্বন্দ্ব এবং ভোটকে প্রভাবিত করার অভিযোগ প্রায় সব নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত থেকেছে। কখনো জোরালো গণতান্ত্রিক দাবি, কখনো রাজনৈতিক টানাপোড়েন, বর্জন, বিতর্ক ও সহিংসতা— সব মিলিয়ে নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
১৯৭৩ সালের প্রথম নির্বাচন থেকে ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচনেই ছিল আলাদা প্রেক্ষাপট, আলাদা উত্তাপ ও আলাদা বিতর্ক।
বর্তমান বাংলাদেশের শাসনক্ষমতায় থাকা অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণায় ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
এমন পরিস্থিতিতে ফিরে দেখা যাক স্বাধীন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষাপট, অংশগ্রহণ ও ফলাফল।
প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন : ১৯৭৩
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে পুনর্গঠন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা ছিল অত্যন্ত উচ্চ। এক বছরের মধ্যে সংবিধান প্রণয়ন ও দ্রুত নির্বাচনের আয়োজন ছিল সরকারের অন্যতম বড় পদক্ষেপ। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর নতুন সংবিধান কার্যকর হয় এবং এর অধীনে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (মোজাফফর), ন্যাপ (ভাসানী), সিপিবি, জাসদসহ মোট ১৪টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়; প্রার্থী ছিলেন ১,০৮৯ জন। বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা তখন ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে সংবিধান ও ‘মুজিববাদ’কে জনসমর্থনের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরে, আর বিরোধী দলগুলো ‘গণতান্ত্রিক ও খাঁটি সমাজতান্ত্রিক সংবিধান’ প্রণয়নের অঙ্গীকার করে।
৩০০ আসনের মধ্যে ১১টিতে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু নিজে চারটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দুটি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পান। নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৫৫.৬২ শতাংশ। মোট বৈধ ভোটের ৭৩.২০ শতাংশ পায় আওয়ামী লীগ, ৮.৩৩ শতাংশ ন্যাপ (মোজাফফর), ৬.৫২ শতাংশ জাসদ এবং ৫.৩২ শতাংশ ন্যাপ (ভাসানী)।
চূড়ান্ত ফলে ২৮৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৮২ আসনে জয়ী হয়; বিরোধী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পান মাত্র ৭টি আসন। বিরোধীদলীয় নেতা আতাউর রহমান খানের বিজয় ছিল উল্লেখযোগ্য। তবে ভোট গণনায় অনিয়ম ও বিরোধীদের বিজয় রোধের অভিযোগও ওঠে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদকে জয়ী ঘোষণার ঘটনা নিয়ে তখন বিতর্ক তৈরি হয়।
দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন : ১৯৭৯
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে দেশের ক্ষমতার পালাবদল শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন এবং ২০ আগস্ট সামরিক আইন জারি করেন। একই বছরের ২৪ আগস্ট তিনি সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে জিয়াউর রহমানকে নিয়োগ দেন। পরবর্তী বছরগুলোতে একের পর এক অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান দেশের ক্ষমতার কেন্দ্রে উঠে আসেন।
১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর জিয়াউর রহমান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তিনি জনগণের আস্থা যাচাই করতে ১৯৭৭ সালের ৩০ মে গণভোট আয়োজন করেন। সরকারিভাবে ঘোষিত ফল অনুযায়ী, তিনি প্রায় ৯৯ শতাংশ ভোটে সমর্থন পান। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭৮ সালের ৩ জুন অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিয়া মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানীকে পরাজিত করে নির্বাচিত হন।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পর জিয়া রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নিজের জনপ্রিয়তা জোরদার করতে রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নেন। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেন। তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের মূল ভিত্তি ছিল ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’, যার মাধ্যমে তিনি জাতিগত ও ধর্মীয় বৈচিত্র্যের মধ্যে জাতীয় ঐক্যের ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।
১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিএনপি ছাড়াও আওয়ামী লীগের দুই অংশ— একটি মালেক উকিলের নেতৃত্বে এবং অন্যটি মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে—সহ মোট ২৯টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। মোট প্রার্থী ছিলেন ২,১২৫ জন।
সামরিক শাসনের অধীনে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে বিএনপি বিপুল বিজয় অর্জন করে। ৩০০টি আসনের মধ্যে দলটি পায় ২০৭টি আসন। আওয়ামী লীগ (মালেক) পায় ৩৯টি আসন, আওয়ামী লীগ (মিজান) মাত্র ২টি, জাসদ ৮টি, মুসলিম লীগ–আইডিএল (ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ) জোট ২০টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হন ১৬টি আসনে।
ভোটার উপস্থিতি ছিল ৫০.৬২ শতাংশ। ভোটের হিসাবে, বিএনপি পায় ৪১.১৬ শতাংশ, আওয়ামী লীগ (মালেক) ২৪.৫৫ শতাংশ, আওয়ামী লীগ (মিজান) ২.৭৮ শতাংশ, জাসদ ৪.৮৪ শতাংশ এবং মুসলিম লীগ–আইডিএল জোট পায় ১০.০৮ শতাংশ ভোট।
তবে নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দলগুলো গুরুতর অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ তোলে। আওয়ামী লীগ (মালেক) অভিযোগ করে, নির্বাচন ছিল পূর্বপরিকল্পিত ‘নীলনকশা’ অনুযায়ী সাজানো। তাদের দাবি ছিল, গোয়েন্দা সংস্থার জরিপ ও পরিকল্পনা অনুযায়ী আগেই ফল নির্ধারিত হয়েছিল।
বিতর্ক ও সমালোচনা সত্ত্বেও ১৯৭৯ সালের এই নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় সৃষ্টি করে। এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গণভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং সামরিক শাসনের প্রেক্ষাপটে নতুন রাজনৈতিক ধারার সূচনা ঘটে।
তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন : ১৯৮৬
১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সেনাবাহিনীর তৎকালীন প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। এর পর থেকেই সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন এবং এরশাদের অবৈধ ক্ষমতা দখলের প্রতিবাদে জনমত গড়ে উঠতে থাকে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় তিনি ১৯৮৫ সালে একটি গণভোট আয়োজন করেন এবং দাবি করেন যে ৯৪ শতাংশ ভোটার তাঁর পক্ষে রায় দিয়েছেন।
তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ প্রথমে ১৯৮৪ সালে ঘোষণা করা হলেও আন্দোলনের মুখে তা দু’বার পরিবর্তন করা হয় এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৮৬ সালের ৭ মে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮৫ সালের ১৭ মে বিচারপতি চৌধুরী এ টি এম মাসুদকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার করে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়।
১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি এরশাদ জাতীয় পার্টি গঠন করেন এবং এ দলসহ ২৮টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নেয়। তবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সাতদলীয় জোট নির্বাচন বর্জন করে। মোট ২,১৫৪ জন মনোনয়নপত্র জমা দিলেও চূড়ান্ত প্রার্থী ছিলেন ১,৫২৭ জন। জাতীয় পার্টি ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেয়, আওয়ামী লীগ ২৫৬ আসনে এবং ৪৫৩ জন ছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী।
ভোটার সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ৭৮ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭৯ জন; ভোটের হার ৬০.৩৭ শতাংশ।
ফলাফলে এরশাদের দল জাতীয় পার্টি জয় পায় ১৫৩টি আসনে। আওয়ামী লীগ পায় ৭৬টি, জামায়াতে ইসলামী ১০টি, কমিউনিস্ট পার্টি এবং ন্যাপ (ভাসানী) ৫টি করে, মুসলিম লীগ ও জাসদ (রব) ৪টি করে, বাকশাল, ওয়ার্কার্স পার্টি এবং জাসদ (শাহজাহান সিরাজ) ৩টি করে, ন্যাপ (মোজাফফর) ২টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৩২টি আসনে জয়লাভ করেন।
তৃতীয় জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে ১৯৮৬ সালের ১০ জুলাই। স্পিকার ছিলেন সামসুল হুদা চৌধুরী এবং ডেপুটি স্পিকার এম কোরবান আলী। প্রায় ১৭ মাস পর, ১৯৮৭ সালের ৬ ডিসেম্বর এই সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।
চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন : ১৯৮৮
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল এক বিতর্কিত ও একতরফা নির্বাচন। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে ক্ষমতায় ছিলেন। তবে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ অধিকাংশ প্রধান রাজনৈতিক দল নির্বাচনটি বর্জন করে। তাদের অভিযোগ ছিল— এরশাদ সরকারের অধীনে কোনো অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। বড় রাজনৈতিক দলগুলো না থাকায় নির্বাচন ছিল প্রায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন। দেশের সর্বত্র ভোটারদের মধ্যে আগ্রহ ও উৎসাহ ছিল খুবই কম। অনেক কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি ছিল অল্পসংখ্যক। সরকারি হিসেবে ভোটার উপস্থিতি দেখানো হয় ৫১.৮১ শতাংশ, কিন্তু বিদেশি সংবাদমাধ্যম ও পর্যবেক্ষকদের মতে বাস্তবে ভোট পড়েছিল এর অর্ধেকেরও কম।
এই নির্বাচনে অংশ নেয় আটটি রাজনৈতিক দল। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল এরশাদের জাতীয় পার্টি (জাপা), যারা ২৫১টি আসনে জয়লাভ করে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। বিএনপি থেকে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেওয়া মওদুদ আহমদ সংসদ নেতা নির্বাচিত হন এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
অন্যদিকে বিরোধী আসনে বসে সম্মিলিত বিরোধী দল (কপ), যারা ১৯টি আসনে জয়ী হয়। এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ২৫টি আসন, জাসদ (সিরাজ) ৩টি আসন এবং ফ্রিডম পার্টি ২টি আসন লাভ করে।
তবে এই নির্বাচনকে জনমুখী বা গণতান্ত্রিক বলা যায়নি, কারণ জনগণের অংশগ্রহণ ছিল সীমিত এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার উপর সরকারের প্রভাব ছিল ব্যাপক। ফলে সংসদ কার্যত এরশাদ সরকারের নিয়ন্ত্রণেই পরিচালিত হয়।
এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের অসন্তোষ ক্রমেই বাড়তে থাকে। বিশেষ করে একতরফা নির্বাচন এবং স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার কারণে রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসমাজ এক হয়ে ওঠে। এরশাদ সরকারের মেয়াদ চলাকালীন দুই বছর সাত মাসের মধ্যেই গণআন্দোলনের ঢেউ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৯০ সালের দিকে বিরোধী দলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে বৃহত্তর আন্দোলনের প্রস্তুতি নেয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আটদলীয় জোট, বিএনপির নেতৃত্বে সাতদলীয় জোট এবং বাম ঘরানার দলগুলোর পাঁচদলীয় জোট— এই তিনটি জোট একে অপরের সঙ্গে সমন্বয় করে সরকারের পতনের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়।
১৯৯০ সালের ১০ অক্টোবর এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ছাত্রদল নেতা নূর হোসেন জেহাদ গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। তার মৃত্যুর পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এর পরপরই ২৪টি ছাত্র সংগঠন একত্র হয়ে ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য’ গঠন করে, যা পরবর্তী সময়ে গণআন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্বে পরিণত হয়।
জেহাদের শাহাদত বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন মোড় এনে দেয়। সারাদেশে এরশাদবিরোধী মিছিল, ধর্মঘট ও বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে। জনতার ক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয় সরকার।
১৯৯০ সালের ১৯ নভেম্বর তিনটি রাজনৈতিক জোট— আটদলীয়, সাতদলীয় ও পাঁচদলীয়— পৃথকভাবে সমাবেশ করে, কিন্তু একই দাবিতে একমত হয়। তারা সম্মিলিতভাবে একটি ‘তিন জোটের রূপরেখা’ ঘোষণা করে, যেখানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের দাবি তোলা হয়।
পরবর্তীতে ২৭ নভেম্বর ১৯৯০ গণতন্ত্রকামী চিকিৎসক ডা. শামসুল আলম খান মিলন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। এই হত্যাকাণ্ড জনরোষ আরও বাড়িয়ে তোলে এবং আন্দোলন সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে।
অবশেষে, তীব্র গণআন্দোলন, রাজনৈতিক ঐক্য ও ছাত্রদের কঠোর আন্দোলনের মুখে ৪ ডিসেম্বর ১৯৯০ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
এরশাদের পদত্যাগের পর ‘তিন জোটের রূপরেখা’ অনুযায়ী বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং তার হাতেই রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়।
পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন : ১৯৯১
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে এই সরকার সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন আয়োজন করে।
এর আগে সামরিক শাসক এরশাদের পতনের পর গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন চালায়। সেই ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আটদলীয়, বিএনপির নেতৃত্বে সাতদলীয় এবং বামপন্থী পাঁচদলীয় জোট নির্বাচনে অংশ নেয়।
নির্বাচনী প্রচারণায় আওয়ামী লীগ ১৯৭২ সালের সংবিধান পুনর্বহাল এবং সংসদীয় ব্যবস্থা চালুর অঙ্গীকার করে। শেখ হাসিনা উত্তরাঞ্চলে যমুনা সেতু নির্মাণের আশ্বাস দেন এবং জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী মন্তব্য করেন।
অন্যদিকে খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগকে ‘বিদেশি প্রভাবের’ বিরুদ্ধে সতর্ক করে ধানের শীষে ভোট দিতে আহ্বান জানান।
নির্বাচনের দিন প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ভোটার শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দেন। সহিংসতার কোনো ঘটনা ঘটেনি। ফলাফলে কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও বিএনপি সর্বাধিক ১৪০টি আসনে জয় পায়। আওয়ামী লীগ ৮৪টি, জাতীয় পার্টি ৩৫টি এবং জামায়াতে ইসলামী ১৮টি আসন লাভ করে।
ফল প্রকাশের পর শেখ হাসিনা অভিযোগ করেন, কারচুপি ও কালো টাকার প্রভাব ছিল। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতা ড. কামাল হোসেন দলের আত্মতুষ্টি ও দুর্বল প্রচারণাকে পরাজয়ের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
পরবর্তীতে জামায়াতে ইসলামী বিএনপিকে সমর্থন জানালে ১৯৯১ সালের ২০ মার্চ খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করে এবং পরে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তিত হয়।
ষষ্ঠ ও সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন : ১৯৯৬
একই বছর দুবার জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে একবারই ঘটেছে এবং সেটি ১৯৯৬ সালে। এর মধ্যে প্রথম নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয় ওই বছরের ১৫ই ফেব্রুয়ারি।
খালেদা জিয়ার সরকারের অধীনে আয়োজিত ওই নির্বাচনটি আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল বর্জন করেছিল। ফলে একতরফা ওই ভোটে বিপুল বিজয় পেলেও ক্ষমতায় টিকতে পারেনি বিএনপি।
বিরোধী দলগুলো ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোট বর্জন করলেও এর প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল আরও দুই বছর আগে—১৯৯৪ সালে মাগুরা জেলার একটি উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলগুলোর মধ্যে সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়। ওই উপনির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী জয়লাভ করলে আওয়ামী লীগ ব্যাপক ভোট কারচুপির অভিযোগ তোলে।
এরপর আওয়ামী লীগ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। বিএনপি প্রথমে সেই দাবি নাকচ করলেও আওয়ামী লীগের আন্দোলন ক্রমে জোরদার হয় এবং জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়।
এর মধ্যে পঞ্চম সংসদের মেয়াদ শেষ হয় এবং ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া যুক্তি দিয়েছিলেন যে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে নির্বাচন করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।
ফলাফল অনুযায়ী, বিএনপি ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৯টিতে জয়ী হয়, বাকি ১১টি আসনে স্বতন্ত্র ও ফ্রিডম পার্টি জয় পায়। কিন্তু এই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই কম, এবং ব্যাপক সহিংসতা ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে।
বিরোধী দলগুলো সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করে আন্দোলন শুরু করে। আওয়ামী লীগ টানা ১০৮ ঘণ্টার অসহযোগ আন্দোলন দেয়, ফলে দেশজুড়ে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় দেশি-বিদেশি চাপের মুখে খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিল সংসদে তোলার ঘোষণা দেন।
১৯৯৬ সালের ২৪ মার্চ বিলটি সংসদে পাস হয়। তবে বিরোধীরা আন্দোলন অব্যাহত রাখে, কারণ তারা আশঙ্কা করেছিল বিএনপি হয়তো ক্ষমতা ছাড়বে না। এ অবস্থায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে ৩০ মার্চ সংসদ ভেঙে দিয়ে পদত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
পরে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়।
তার অধীনেই ১৯৯৬ সালের ১২ জুন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয় সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে ৫৭২ জন প্রার্থী ৮১টি রাজনৈতিক দলের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ভোটের উপস্থিতি হার ছিল ৭৫.৬০ শতাংশ।
এ নির্বাচন ছিল দীর্ঘদিন পর এমন একটি ভোট, যেখানে সব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। এর ফলে দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় গণতান্ত্রিক স্বচ্ছতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় সূচিত হয়।
নির্বাচনের ফলাফলে আওয়ামী লীগ ১৪৬টি আসন জিতে সরকার গঠন করে এবং শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিরোধী দলের নেতা হিসেবে দাঁড়ান খালেদা জিয়া, যিনি বিএনপিকে নেতৃত্ব দেন। বিএনপি এই নির্বাচনে মোট ১১৬টি আসন লাভ করে।
বাকি আসনগুলোতে জাতীয় পার্টি পায় ৩২টি, জামায়াত ৩টি, এবং ইসলামী ঐক্যজোট, জাসদ (রব) এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা প্রতিটি ১টি করে আসন লাভ করেন।
অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন : ২০০১
বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে এম এ সাঈদের নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে অষ্টম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০০১ সালের ১ অক্টোবর। এ নির্বাচনে আরপিওর নতুন বিধান অনুসারে সশস্ত্র বাহিনী আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। ভোটার ছিলেন ৭ কোটি ৪৯ লাখ ৪৬ হাজার ৩৬৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৩ কোটি ৮৫ লাখ ৩০ হাজার ৪১৪ জন এবং নারী ৩ কোটি ৬২ লাখ ৯৩ হাজার ৪১৪ জন। ভোট দেন ৫ কোটি ৬১ লাখ ৮৫ হাজার ৭০৭ জন (৭৫.৫৯ শতাংশ) ভোটার। প্রার্থী ছিলেন ১ হাজার ৯৩৯ জন। ৫৪টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি (নাফি) ও ইসলামী ঐক্যজোট এ নির্বাচনে জোটবদ্ধভাবে অংশ নেয়।
বিএনপি ২৫২টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১৯৩ আসনে জয়ী হয়। আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনে প্রার্থী দিয়ে জয়ী হয় ৬২টি আসনে। এরশাদের জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ২৮১ আসনে লড়ে জয়ী হয় ১৪টি আসনে। জামায়াত ৩১ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১৭টি লাভ করে। ৪৮৬ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে জয়ী হন ছয়জন। ইসলামী ঐক্যজোট সাত আসনে লড়ে লাভ করে দুটি আসন। এছাড়া কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) একটি করে আসন লাভ করে।
ভোটপ্রাপ্তি ছিল—বিএনপি ৪০.৯৭%, আওয়ামী লীগ ৪০.১৩%, জামায়াত ৪.২৮%, ইসলামী জাতীয় ঐক্যজোট ৭.২৫% এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী ৪.০৬%। ৩৮ আসনে ৪৬ জন নারী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন। শেখ হাসিনা পাঁচটি আসনে লড়ে চারটিতে বিজয়ী হন। খালেদা জিয়া পাঁচ আসনে লড়ে পাঁচটিতেই জয়ী হন। রওশন এরশাদ দুই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে একটিতে জয়ী হন। গঠিত সংসদ পূর্ণ মেয়াদে স্থায়ী হয়।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন : ২০০৮
২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর বিএনপি সরকার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে সংবিধানে বড় সংশোধনী আনে। অভিযোগ ছিল, সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে নিজেদের পছন্দের প্রধান বিচারপতিকে বসানোর চেষ্টা করেছিল।
এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। সংঘাতময় এক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে সেনাবাহিনী। জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। ড. ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হলেও কার্যত এটি সেনাবাহিনী দ্বারা পরিচালিত হয়। সরকার বলেছিল, সাধারণ নির্বাচন দুই বছর পর্যন্ত স্থগিত থাকতে পারে, কারণ নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন এবং ছবি সংযুক্ত ভোটার তালিকা তৈরি করা প্রয়োজন।
সেনাবাহিনীর সহায়তায় দুর্নীতি দমন কমিশন রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়ী নেতাদের ওপর অভিযান চালায়। অভিযোগ ওঠে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেত্রীদের রাজনীতির বাইরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে এটি সফল হয়নি।
২০০৭ সালের জুনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে সেনাসদস্যদের দ্বারা প্রহার করা হয়। এর ফলে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন অঞ্চলে তীব্র ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। আন্দোলনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার বুঝতে পারে, নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখা যাবে না।
অগস্ট ২০০৭ থেকে নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করে। ২০০৮ সালের ১৫ জুলাই প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা নির্বাচন রোডম্যাপ ঘোষণা করেন। রোডম্যাপ অনুযায়ী জুলাইয়ে খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ এবং সংশোধনের সুযোগ, সেপ্টেম্বর থেকে নির্বাচনী সংস্কার নিয়ে সংলাপ, অক্টোবরের মধ্যে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০০৮ সালের ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। ভোট কেন্দ্রে বিশাল উৎসাহ দেখা যায় এবং কোনো রাজনৈতিক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়নি। ভোটার উপস্থিতি ছিল ৮৬.২৯ শতাংশ। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৩০ আসন পায় এবং ৪৮.১৩ শতাংশ ভোট অর্জন করে। বিএনপি মাত্র ৩০ আসন পায়, ভোটের হার ৩২.৪৯ শতাংশ। জামায়াতে ইসলামী ৩৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও মাত্র ২টি আসনে জয়লাভ করে, ভোট পায় ৪.৬০ শতাংশ। নির্বাচনের ফলাফলে আওয়ামী লীগের বিশাল ব্যবধান সবাইকে চমকে দেয়। সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন লিখেছেন, প্রাথমিক ধারণা ছিল ফলাফলের ব্যবধান ৪০–৫০ আসনের মধ্যে হবে, কিন্তু বাস্তবতা অনেক বেশি। বিএনপি ফলাফল মেনে নিতে পারেনি এবং কারচুপির অভিযোগ তোলে।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন : ২০১৪
বাংলাদেশের ইতিহাসে একতরফা নির্বাচনের অন্যতম নজির হলো দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, যা অনুষ্ঠিত হয় ৫ জানুয়ারি ২০১৪। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং তাদের মিত্র জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ফলে ৩০০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ১৫৪টি আসনে প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন, আর ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় ১৪৬টি আসনে।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকারের সময় উচ্চ আদালতের রায়ে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়। বিএনপি ও সমমনা দলগুলো এই সিদ্ধান্তকে সমালোচনা করে।
নির্বাচনের একতরফা চরিত্র এবং ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে হওয়ায় এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা দেশে-বিদেশে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল। বিএনপি এবং সমমনা দলগুলো ২০১২ সাল থেকে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করছিল, কিন্তু আওয়ামী লীগ তাদের দাবি উপেক্ষা করে নির্বাচনের দিকে এগোতে থাকে।
২০১৩ সালের ২৬ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী নেতা খালেদা জিয়াকে সংলাপের প্রস্তাব দেন। যদিও বিএনপি হরতাল চালাচ্ছিল, খালেদা জিয়া সংলাপের প্রস্তাবকে স্বাগত জানান। যদিও শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক কোনো সমঝোতা হয়নি।
নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও জোটভুক্ত দলগুলোসহ মাত্র ১২টি দল। নির্বাচনের আগে ভারতের কূটনৈতিক সমর্থনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
নির্বাচনের ফলাফল ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪ আসনে প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন, ভোট গ্রহণ হয় ১৪৬ আসনে, এবং ফলাফল অনুযায়ী আওয়ামী লীগ ২৩৪, জাতীয় পার্টি ৩৪, ওয়ার্কার্স পার্টি ৬, জাসদ (ইনু) ৫, তরীকত ফেডারেশন ২, জাতীয় পার্টি (জেপি) ২, বিএনএফ ১ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ১৬ আসন পায়। যেখানে ভোটারের ভোটের হার ছিল ৪০.০৪%। ভোট ও নির্বাচনপূর্ব সহিংসতায় মোট ১৪২ জন নিহত হন, যার মধ্যে নির্বাচনের দিন নিহত ১৯ জন। নির্বাচনের আগে ২৫ নভেম্বর থেকে ভোটের আগের দিন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ১২৩ জন।
নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তৃতীয় দফা সরকার গঠিত হয়। জাতীয় পার্টিকে সংসদে বিরোধী দল হিসেবে ঘোষণা করা হলেও, দলের কিছু নেতা মন্ত্রী হন এবং এরশাদকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূত বানানো হয়। ফলে জাতীয় পার্টি সরকারের অংশ নাকি বিরোধী দল, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন : ২০১৮
২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। তবে এ নির্বাচনকে ঘিরে দেশের ভেতরে ও বাইরে নানা প্রশ্ন, অভিযোগ ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
২০০৮ সালের পর প্রথমবারের মতো এই নির্বাচনে প্রায় সব রাজনৈতিক দল অংশ নেয়, যা নির্বাচনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে ভোট অনিয়ম, কারচুপি ও কেন্দ্র দখলের অভিযোগ ওঠে। অনেক পর্যবেক্ষক ও বিরোধী দল একে “নিয়ন্ত্রিত” ও “একতরফা” নির্বাচন বলে আখ্যা দেন।
ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর। নির্বাচন পরিচালনা করে কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। মোট ২৯৯টি আসনে ভোট হয়; একটি আসন স্থগিত ছিল। নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নেয়, যেখানে ১,৮৬৩ জন দলীয় প্রার্থী এবং ১২৮ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
মোট ভোটার ছিলেন ১০ কোটি ৪২ লাখ ৩৮ হাজার ৩৬৫ জন, এর মধ্যে নারী ভোটার ৫ কোটি ১৬ লাখ ৬৬ হাজার ৩১২ জন। ৬টি আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণ করা হয়। প্রদত্ত ভোটের হার ছিল ৮০ শতাংশ।
ভোটের ফলাফল ছিল প্রায় একপাক্ষিক— আওয়ামী লীগ ২৫৯টি, বিএনপি ৬টি, গণফোরাম ২টি, জাসদ ২টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ৩টি, তরিকত ফেডারেশন ১টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী ৩টি আসনে জয়ী হন। মোট আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও তাদের জোটসঙ্গীরা মিলে ২৮৮টি আসনে জয়লাভ করে। অন্যদিকে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট পায় মাত্র ৭টি আসন, বাকি ৩টি যায় অন্যান্যদের দখলে।
ভোটশেষে দেখা যায়, বহু কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে, এবং অনেক জায়গায় ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর বাইরের কেউ কোনো ভোটই পাননি। পরবর্তীতে সুজনের এক পর্যালোচনায় দেখা যায়, ৭৫টি আসনের ৫৮৬টি কেন্দ্রে বৈধ সব ভোটই গিয়েছে নৌকা মার্কার প্রার্থীর পক্ষে।
টিআইবি (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) ৫০টি আসন পর্যবেক্ষণ করে জানায়, তার মধ্যে ৪৭টিতেই অনিয়ম পাওয়া গেছে।
ভোট শেষে ফলাফল প্রকাশের আগেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন ও ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে। ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেন একে “প্রহসনের নির্বাচন” বলে উল্লেখ করেন এবং বাতিলের দাবি জানান। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘এবারের নির্বাচন প্রমাণ করেছে, ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল।’
সবশেষে, সব অভিযোগ ও সমালোচনার মাঝেও আওয়ামী লীগ তৃতীয়বারের মতো এককভাবে সরকার গঠন করে, আর এই ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন এখনও বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত নির্বাচনগুলোর একটি হিসেবে বিবেচিত।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন : ২০২৪
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, যা পরিচালনা করে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ ২৮টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়, আর বিএনপিসহ ১৬টি দল নির্বাচন বর্জন করে।
বিএনপি অনুপস্থিত থাকলেও ভোটের আগে ও চলাকালে সহিংসতায় অন্তত ১৫ জন নিহত এবং ২,২০০ জনের বেশি আহত হন।
নির্বাচনের ফলাফলে আওয়ামী লীগ পেয়েছে ২২৪টি আসন, জাতীয় পার্টি ১১টি, জাসদ ১টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ১টি, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ১টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী ৬২টি আসন পেয়েছেন। এর মধ্যে ৫৯ জনই আওয়ামী লীগ ঘরানার স্বতন্ত্র প্রার্থী। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের আধিক্যে অনেক আসনে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা যায়। তথাকথিত ‘কিংস পার্টি’গুলোর ভরাডুবি ঘটে।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী ভোট পড়েছে ৪১.৮%, যদিও বিশ্লেষকদের মতে প্রকৃত হার ছিল আরও কম।
বিতর্কিত এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। তবে সরকার গঠনের সাত মাস পর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন। এর মাধ্যমে ১৬ বছরের আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনের অবসান ঘটে।
এসআইবি/এমএইচএস


