ঢাকা, গাজীপুর ও নরসিংদীকে নাড়া দেওয়া সাম্প্রতিক একাধিক ভূমিকম্প দেশের নগর অবকাঠামোর ভয়াবহ দুর্বলতাকে নতুন করে উন্মোচিত করেছে। রাজধানী ও গাজীপুরে ২১ লাখের বেশি ভবন থাকলেও মাত্র ৩ হাজার ২৫২টির ভূমিকম্প সহনক্ষমতা যাচাই করেছে রাজউক- যার মধ্যে শত শত ভবন রেট্রোফিটিংয়ের প্রয়োজন এবং ৪২টি ভবন অপসারণের সুপারিশ করা হয়েছে।
একই সঙ্গে রাজউক রাজধানীতে প্রায় ৩০০ ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করেছে। ভবন নির্মাণে দীর্ঘদিনের অনিয়ম, অনুমোদনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, নিরাপত্তা বিধি লঙ্ঘন এবং কাঠামোগত ত্রুটিকে বিশেষজ্ঞরা এই বিপর্যয়-শঙ্কার মূল কারণ হিসেবে দেখছেন।
এর মধ্যেই নরসিংদীতে টানা তিন দফা ভূমিকম্পে মানুষের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে; ঘরবাড়িতে ফাটল, শতাধিক আহত এবং খোলা মাঠে রাত কাটানো মানুষের সংখ্যা বেড়েছে।
ভূতাত্ত্বিক জরিপে দেখা গেছে, মাটির ফাটলগুলো মূলত জলাশয়ের ধারে ‘লিকুইফ্যাকশন’-এর প্রভাবে সৃষ্টি, যা বড় কোনো ফাটলরেখার লক্ষণ নয়- তবু বড় ভূমিকম্পের শঙ্কা অস্বীকার করছেন না বিশেষজ্ঞরা। শিক্ষা ও সরকারি ভবনেও ফাটল শনাক্ত হওয়ায় জরুরি মূল্যায়ন শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন- দুর্নীতি, নজরদারির অভাব ও নগর পরিকল্পনার বিশৃঙ্খলা দূর না করলে ভবিষ্যতের বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না; এখনই কঠোর সংস্কার, সমন্বিত পরিকল্পনা ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনকে দ্রুত নিরাপদ করার উদ্যোগ নিতে হবে।
ঢাকা-গাজীপুরে ২১ লাখ ভবনের মাত্র ৩২৫২টির ভূমিকম্প সহনক্ষমতা নির্ণয় : ঢাকা ও গাজীপুর মহানগরে ২১ লাখেরও বেশি ভবন থাকলেও সেগুলোর মধ্যে মাত্র ৩ হাজার ২৫২টির ভূমিকম্প সহনক্ষমতা ও ঝুঁকি নির্ণয় করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। গতকাল সোমবার দুপুরে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ (আইইবি)-এ রাজউক আয়োজিত ‘ভূমিকম্প ঝুঁকি হ্রাসে প্রস্তুতি ও করণীয় বিষয়ক’ মতবিনিময় সভায় এ তথ্য জানান রাজউকের নির্বাহী প্রকৌশলী খন্দকার মো. ওয়াহিদ সাদিক। তিনি জানান, রাজউক ঢাকা ও গাজীপুরে ৩ হাজার ২৫২টি ভবনের ভূমিকম্প সহনক্ষমতা ও ঝুঁকি নির্ণয় করেছে। ভবনের ভূমিকম্প ঝুঁকি নিরূপণে এফইএমএ-৩১০ গাইডলাইন অনুসরণ করা হয়েছে।
এর মধ্যে ২ হাজার ৭০৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ২০৭টি হাসপাতাল, ৩৬টি থানা ও ৩০৭টি অন্য ভবনসহ মোট তিন হাজার ২৫২টি ভবনের র্যাপিড ভিজ্যুয়াল অ্যাসেসমেন্ট (আরভিএ) সম্পন্ন করেছে। এ ভবনগুলোর মধ্যে ৫৬৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পাঁচটি হাসপাতাল, তিনটি ফায়ার স্টেশন ও অন্য তিনটিসহ মোট ৫৭৯টি ভবনের প্রিলিমিনারি ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসেসমেন্ট (পিইএ) সম্পন্ন করেছে।
১৮৭টি ভবনের ডিটেইলড ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসেসমেন্ট (ডিইএ) সম্পন্ন করেছে। যার মধ্যে ৯৪টি স্কুল, ৭৮টি কলেজ, ১১টি বিশ্ববিদ্যালয় ও চারটি হাসপাতাল ভবনসহ মোট ১৮৭টি ভবন রেট্রোফিটিংয়ের সুপারিশ করেছে। ঢাকা ও গাজীপুরে ৪২টি ভবন অপসারণের সুপারিশ করেছে রাজউক।
রাজধানীর ৩০০ ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করল রাজউক : এদিকে একই অনুষ্ঠানে রাজউক চেয়ারম্যান মো. রিয়াজুল ইসলাম বলেন, রাজধানীতে প্রায় ৩০০টি ছোট-বড় ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করা হয়েছে। রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, সমন্বিতভাবে কাজ না করা গেলে ভূমিকম্প পরবর্তী পরিস্থিতি সামলানো সম্ভব না। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
যথাযথ নিয়ম মেনেই ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয় জানিয়ে রিয়াজুল ইসলাম বলেন, রাজউকে অর্থের বিনিময়ে কোনো কাজ হয় না।
এদিকে সভায় ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবিলায় ছয় মাস থেকে এক বছরের সমন্বিত পরিকল্পনা করে বাস্তবায়নের দিকে এগোনোর ব্যাপারে মত দিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, ভূমিকম্প ঝুঁকি নিরূপণে সরকারি দফতরগুলোর পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন ফার্মকে সার্ভের দায়িত্ব দিতে হবে। উপদেষ্টা বলেন, ভূমিকম্প ঝুঁকি এড়াতে ছয় মাস থেকে এক বছরের সমন্বিত পরিকল্পনা করে বাস্তবায়নে আগাতে হবে। প্রকৃতি বারবার ছাড় দেবে না।
সভায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান জানিয়েছেন, পরিকল্পিত নগর বাস্তবায়নে রাজউকের ক্ষমতা বাড়াতে দ্রুতই পদক্ষেপ নেবে সরকার। তিনি বলেন, রাজউকের ক্ষমতা বাড়াতে দ্রুতই পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
নগর উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ঢাকার প্রায় ৭০ শতাংশ ভবন অন্তত একটি বড় নিরাপত্তা আইন লঙ্ঘন করে নির্মিত হয়েছে। অনেক ভবনের অনুমোদিত তলার সংখ্যা অতিক্রম করে অতিরিক্ত তলা যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া খরচ কমাতে ভিত্তি নকশায় পরিবর্তন করা হয়। ফলাফল, এসব ভবন মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পও সহ্য করতে অক্ষম।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, ‘প্রতিটি বিপর্যয় আমাদের সংস্কারের সুযোগ দেয়, কিন্তু রাজউক কখনো এসব থেকে শিক্ষা নেয় না। তারা তদন্ত করে, রিপোর্ট দেয়, তারপর ভুলে যায়। আর এই সময়েই হাজার হাজার অনিরাপদ ভবন বেড়ে ওঠে।’
ভূমিকম্পে ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তথ্য চেয়েছে সরকার : ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তথ্য চেয়েছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর। আর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তরফে চাওয়া হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তথ্য।
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী (রুটিন দায়িত্ব) তারেক আনোয়ার জাহেদী স্বাক্ষরিত চিঠি পাঠানো হয়েছে অধিদপ্তরের জেলা পর্যায়ের নির্বাহী প্রকৌশলীদের। চিঠিতে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তথ্য ও একাধিক ছবিসহ প্রতিবেদন সোমবারের মধ্যে পাঠাতে বলা হয়েছে।
এদিকে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তথ্য চেয়ে গত রোববার বিভাগীয় উপপরিচালকদের চিঠি দিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার পরিচালক মিরাজুল ইসলাম উকিল স্বাক্ষরিত চিঠিতে বৃহস্পতিবারের মধ্যে তথ্য চাওয়া হয়েছে।
ভূমিকম্পে সচিবালয়ে নতুন ভবনের বিভিন্ন স্থানে ফাটল : ভূমিকম্পের কারণে সচিবালয়ে নতুন নির্মিত ১ নম্বর ভবনের বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে। সচিবালয়ের পশ্চিম-উত্তর প্রান্তে অবস্থিত এ ভবনে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অফিস করেন।
ফাটলের কারণে এ ভবনে অফিস করা কোনো কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের আতঙ্কের কথা জানিয়েছেন। তবে গণপূর্ত বিভাগের প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, এক নম্বর ভবনে ইটের নির্মিত ৫ ইঞ্চি দেওয়ালের কিছু কিছু স্থানে ফাটল ধরেছে। অন্য কয়েকটি ভবনেও এমন ফাটল রয়েছে। এটি ভবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয়। শিগগিরই এ ফাটল মেরামত করা হবে।
গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মুনতাসির মামুন বলেন, এক নম্বর ভবনের ফাটল আমরা দেখেছি। বিশেষজ্ঞরা এটি পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করেছেন। ইটের তৈরি ৫ ইঞ্চি পুরু দেওয়ালে এই ফাটলগুলো দেখা দিয়েছে। পিলারসহ ভবনের যে মূল স্ট্রাকচার সেখানে এমন কোনো ফাটল দেখা যায়নি। তাই যে ফাটলগুলো দেখা দিয়েছে, সেগুলো ভবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয়।
মাটিতে ফাটল নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই : ভূমিকম্পের কারণে নরসিংদী জেলার বিভিন্ন এলাকার মাটিতে যে ফাটল দেখা দিয়েছে, তা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর (জিএসবি) বলছে, ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল বা কেন্দ্রস্থলের ফল্টলাইনের (ফাটলরেখা) কারণে ওই সব ফাটল সৃষ্টি হয়নি। অগভীর এসব ফাটল নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ভূমিকম্পের ভূতাত্ত্বিক প্রভাব মূল্যায়নের জন্য গত শনিবার জিএসবির তিন সদস্যের বিশেষজ্ঞ দল ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল নরসিংদীর বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে। তারা অন্তত তিনটি জায়গায় মাটির ফাটল পরীক্ষা করে দেখেছে। এসব ফাটল ৪ মিটার থেকে সর্বোচ্চ ৩০ মিটার পর্যন্ত দীর্ঘ এবং অগভীর।
জিএসবির বিশেষজ্ঞ দল শনিবার সরেজমিনে নরসিংদীর বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছে। তাদের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, যেসব এলাকার ফাটল দেখা গেছে, সেগুলোর প্রতিটির পাশে জলাশয় রয়েছে। ভূমিকম্পের সময় জলাশয়ের পানির চাপের কারণে আশপাশের মাটি আলগা হয়ে ফাটল তৈরি হয়েছে।
জিএসবির উপপরিচালক মো. মাহমুদ হোসেন খান বলেন, নরসিংদীতে ফাটলের কারণ হলো ‘লিকুইফ্যাকশন’ বা ভূমি তরলীকরণ। ভূমিকম্পের তরঙ্গ যখন জলাশয়ের নিকটবর্তী ভরাট করা আলগা ও শুষ্ক বালুর স্তরে আঘাত করে, তখন কম্পনের কারণে পার্শ্ববর্তী পুকুর বা খালের পানি তীব্র বেগে আনুভূমিকভাবে ওই বালুর স্তরে প্রবেশ করে। একপর্যায়ে মাটি তার ভার বহনক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং সাময়িকভাবে ঘন তরলের মতো আচরণ শুরু করে। ভার বহনক্ষমতা হারানো এই তরলীকৃত মাটির ওপর থাকা ভূপৃষ্ঠের স্তর তখন ধসে পড়ে বা ফেটে যায়।
বিকেপি/এমবি

