অজ্ঞাতনামা লাশ, হেফাজতে মৃত্যু আর মব : মানবাধিকারের ৩ সংকট
ডিজিটাল ডেস্ক
প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৯
দেশে গত দেড় বছরে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে গুম–খুনের অভিযোগ খুব একটা শোনা না গেলেও মানবাধিকার সংগঠক ও সংস্থাগুলোর কাছে বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে অজ্ঞাতনামা লাশের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, কারা ও নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু এবং মব সন্ত্রাস।
তাদের অভিযোগ, এই সময়ে মব সন্ত্রাসের মাধ্যমে দেশজুড়ে মাজার, দরগা ও বাউলদের ওপর অব্যাহত হামলা ও নিপীড়নের মতো ঘটনা ক্রমাগত বাড়লেও এর বিরুদ্ধে দৃশ্যমান পদক্ষেপ খুব একটা চোখে পড়েনি।
যদিও আগের সরকারের সময়ে ঘটা গুম–খুনের বিষয়ে বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার এবং র্যাবসহ বিভিন্ন বাহিনীতে থাকা সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা ও কিছু পুলিশ কর্মকর্তার বিচার চলছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। গুম-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদেও স্বাক্ষর করেছে সরকার।
এর আগে আওয়ামী লীগ আমলে এই মানবাধিকার ইস্যুতেই র্যাব ও এর ছয়জন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ওই সময়ে সরকারি বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে গুম ও খুনের অভিযোগে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও সোচ্চার হয়ে উঠেছিল।
মানবাধিকার সংগঠক ও অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত গুম কমিশনের সদস্য নূর খান লিটন বলছেন, মানবাধিকারের কোনো কোনো ক্ষেত্রে গত দেড় বছরে উন্নতি হলেও সামগ্রিক পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়, বরং প্রতিদিনই পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)-এর সম্পাদক সাইদুর রহমান বলছেন, এখন সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো ‘অজ্ঞাতনামা লাশ’। পাশাপাশি মব সন্ত্রাস দেশজুড়ে মানবাধিকার পরিস্থিতিকে নাজুক করে তুলেছে।
যদিও সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলছেন, গুম–খুনের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থার পাশাপাশি সংস্কারের দিক থেকে মানবাধিকার বিষয়ে অনেকগুলো পদক্ষেপ এ সরকার নিয়েছে। তার আশা, পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার এসে এগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিলে মানবাধিকার সংস্কৃতির ক্রমাগত উন্নতি হবে।
অজ্ঞাত লাশ, কারা হেফাজতে মৃত্যু ও মব
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ঠিক এক বছরের মাথায় চলতি বছরের জুলাইয়ের শেষে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছিল, অন্তর্বর্তী সরকার মানবাধিকার রক্ষার চ্যালেঞ্জিং কর্মসূচি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হচ্ছে।
সংস্থাটি তখন তাদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছিল, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে যে ভীতি, দমন-পীড়ন ও গুমের মতো ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটত, তার কিছুটা অবসান ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার কথিত রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনে নির্বিচার আটক করছে। মানবাধিকার সুরক্ষায় তারা এখনো কাঠামোগত সংস্কার আনতে পারেনি।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছিল, উচ্ছৃঙ্খল জনতার সহিংসতা (মব ভায়োলেন্স), রাজনৈতিক সহিংসতা এবং রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য চরমপন্থী গোষ্ঠীর— বিশেষ করে নারী অধিকার, সমকামী, উভকামী ও ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিবিরোধী ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের হাতে সাংবাদিকদের হয়রানি উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলছে।
সেই পরিস্থিতির এখনো কোনো উন্নতি হয়নি বলে বলছে দেশের মানবাধিকার সংগঠন ও সংস্থাগুলো।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ১০ মাসে মব সহিংসতা ও গণপিটুনির ২৫৬টি ঘটনায় কমপক্ষে ১৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার, রাজনৈতিক কর্মী থেকে শুরু করে চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারীরা এই সহিংসতার শিকার হয়েছেন।
অক্টোবরের শেষে মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ জানিয়েছে, শেখ হাসিনার শাসনামলের অবসানের পর থেকে রাজনৈতিক সহিংসতায় অন্তত ২৮১ জন নিহত হয়েছেন।
এছাড়া তাদের হিসেবে, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর—২০২৪ সালের ৯ আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত— অন্তত ৪০ জন বিচারবহির্ভূতভাবে এবং আরও ১৫৩ জনকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়েছে।
এসব হত্যাকাণ্ডের অনেকগুলোতে পুলিশ ও সেনাসদস্যদের জড়িত থাকার সম্ভাবনার কথাও বলা হয়েছে অধিকারের প্রতিবেদনে।
মানবাধিকার সংগঠক সাইদুর রহমান বলছেন, গত দেড় বছরে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতির জন্য অনেকাংশে দায়ী ‘কথিত মব’। বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং দরগা–মাজার–বাউলদের ওপর হামলা ও নির্যাতনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে এই মব।
তিনি বলেন, সোমবার বাউল শিল্পী আবুল সরকারের জামিন হয়নি আদালতে, এবং মানিকগঞ্জ আদালতপাড়ায় একদল আইনজীবী ‘একটা একটা বাউল ধর— ধইরা ধইরা জবাই কর’ স্লোগান দিয়েছেন। মানবাধিকার পরিস্থিতি কেমন, এ ঘটনাই তা পরিষ্কার করে দেয়।
চলতি বছরের শুরুতেই প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছিল, ২০২৪ সালের ৪ আগস্টের পর থেকে পরবর্তী পাঁচ মাসে সারাদেশের ৪০টি মাজারে ৪৪ বার হামলার অভিযোগ পেয়েছিল পুলিশ। এসব হামলায় মাজারে ভাঙচুর, সম্পত্তি লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটেছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, অন্তর্বর্তী সরকার দেশের ধর্মীয় স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় এবং সারাদেশে মাজার–দরগাহর নিরাপত্তায় পুলিশ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি বলে মনে করছেন মানবাধিকার সংগঠকরা। বরং কুমিল্লায় সেপ্টেম্বরে একটি গ্রামেই চার মাজারে হামলা হয়েছিল।
ওই একই মাসে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে ‘তৌহিদি জনতা’ পরিচয়ে নুরুল হক ওরফে ‘নুরাল পাগলা’র কবর, বাড়ি ও দরবার শরিফে হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় মরদেহ কবর থেকে তুলে মহাসড়কে নিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় হামলাকারীরা, যা দেশজুড়ে আলোড়ন তৈরি করে।
নূর খান লিটন বলছেন, গত দেড় বছরে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে গুম কিংবা ক্রসফায়ার না হলেও হেফাজতে মৃত্যু, বিচারবহির্ভূত হত্যা, সংখ্যালঘু নির্যাতন, ‘স্বৈরাচারের দোসর’ ট্যাগ দিয়ে মানুষকে হেনস্তা, নিপীড়ন এবং মব সন্ত্রাসের মাধ্যমে নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ নিয়মিতই পাওয়া যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ঢাকার আশেপাশে এখন প্রায় প্রতিদিন লাশ পাওয়া যাচ্ছে। আগে বুলেটবিদ্ধ লাশ পাওয়া যেত, এখন বুলেটবিদ্ধ না হলেও লাশ পাওয়া যাচ্ছে— যা নতুন শঙ্কার সৃষ্টি করেছে।
সাইদুর রহমানও বলেন, অজ্ঞাতনামা লাশ এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি পাওয়া যাচ্ছে, যার অর্থ— কোনো না কোনোভাবে হত্যাকাণ্ড বা খুনের ঘটনা বেড়েছে।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)-এর হিসেবে, শুধু অক্টোবর মাসেই অজ্ঞাতনামা লাশ পাওয়া গেছে ৬৬টি, এবং এর আগে সেপ্টেম্বর মাসে এই সংখ্যা ছিল ৫২।
সংস্থাটি বলছে, এসব অজ্ঞাত লাশের বেশিরভাগই নদী বা ডোবায় ভাসমান অবস্থায়, মহাসড়ক বা সড়কের পাশে, সেতুর নিচে, রেললাইনের পাশে, ফসলি জমিতে ও পরিত্যক্ত স্থানে পাওয়া যায়।
এর মধ্যে কিছু মৃতদেহ গলাকাটা, বস্তাবন্দি ও রক্তাক্ত অবস্থায়, কিংবা শরীরে আঘাতের চিহ্নসহ পাওয়া গেছে।
নৌ-পুলিশকে উদ্ধৃত করে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত এক বছরে শুধু খুলনা অঞ্চলের নদ–নদী থেকে মোট ৫০টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, যার মধ্যে ২০টির পরিচয় পরে জানা গেছে।
চলতি বছরের আগস্টেই ঢাকার কেরানীগঞ্জে বুড়িগঙ্গা নদীর আলাদা আলাদা স্থান থেকে নারী ও শিশুসহ অজ্ঞাত চারজনের লাশ উদ্ধারের ঘটনা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। এই চারজনের মধ্যে দুজনের হাত বাঁধা অবস্থায় ছিল।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ৮ আগস্টের পর থেকে চলতি বছর নভেম্বর পর্যন্ত ১৫ মাসে কারা হেফাজতে মারা গেছেন অন্তত ১১২ জন। এর মধ্যে গত বছরের ডিসেম্বরে বগুড়া কারাগারে পরপর চারজন আওয়ামী লীগ নেতার মৃত্যুর ঘটনা আলোচনায় এসেছিল।
অন্যদিকে এমএসএফ জানিয়েছে, চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত গত এক বছরে তাদের কাছে কারা হেফাজতে ১১৯ জনের মৃত্যুর তথ্য আছে। এছাড়া এই সময়ে পুলিশ হেফাজতে ২১ জন, রাজনৈতিক সহিংসতায় ১০৬ জন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যায় প্রাণ হারিয়েছেন ২৬ জন।
মানবাধিকার সংগঠক সাইদুর রহমান বলছেন, ৫ আগস্টের আগে উদ্বেগ ছিল বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, খুন, রিমান্ডে নির্যাতন, কারা হেফাজতে নিহত হওয়া, অজ্ঞাত লাশ পাওয়া, সভা–সমাবেশে বাধা এবং ভোট না হওয়া নিয়ে।
তার ভাষায়, ৫ আগস্টের পর সবার আশা ছিল এগুলো কমবে। বাস্তবতা হলো— গুম–খুন কমলেও অজ্ঞাত মৃত্যু বেড়েই চলেছে। আর সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে মবের দ্বারা। অর্থাৎ মানবাধিকার নিয়ে মানসিকতা, আচরণ ও চর্চায় কোনো পরিবর্তন আসেনি।
নূর খান লিটনও বলছেন, পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে; কিন্তু তা প্রতিরোধে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ তারা দেখছেন না।
তিনি বলেন, সারা দেশে হাজার হাজার মামলা হচ্ছে, যার সাথে অনেকের যুক্ত থাকার সম্ভাবনা নেই। মামলা নিয়ে বাণিজ্য হচ্ছে। সরকার জেনেও দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিচ্ছে না। প্রতিনিয়ত লাশ পাওয়া যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলের নামে বাড়িঘর–ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দখল হচ্ছে। মামলার খসড়া পাঠিয়ে টাকা দাবির মতো ঘটনাও ঘটছে। বাউল সংস্কৃতি–কর্মীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। সব মিলিয়ে দীর্ঘ স্বৈরশাসনের কুফল ও ফ্যাসিবাদী মনন রয়ে গেছে।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল যা বলছেন
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলছেন, সংস্কারের দিক থেকে মানবাধিকার বিষয়ে অনেক পদক্ষেপ সরকার নিয়েছে, যা পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার এসে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবে বলে তার বিশ্বাস।
আর সেটি হলে মানবাধিকার সংস্কৃতির ক্রমাগত উন্নতি নিশ্চিত হবে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, গুম–খুনের মতো মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। গুম-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করা হয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে— মানবাধিকার একটি সংস্কৃতির বিষয়। এটি হঠাৎ করে বা জাদুর মতো একদিনে ভালো করে ফেলা সম্ভব নয়।
এমএইচএস

