Logo

জাতীয়

তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন : ভারত-বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন মোড়

Icon

দিল্লি প্রতিনিধি

প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:০৬

তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন : ভারত-বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন মোড়

দেড় যুগের দীর্ঘ নির্বাসন ভেঙে অবশেষে দেশে ফিরেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তাঁর এই প্রত্যাবর্তনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যেমন নতুন গতি সঞ্চার হয়েছে, তেমনি বিষয়টি গভীর আগ্রহের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে প্রতিবেশী ভারতও। আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে যখন দেশজুড়ে নির্বাচনী উত্তাপ বাড়ছে, তখন প্রায় সব জরিপেই বিএনপিকে এগিয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানের দেশে ফেরা অনেক বিশ্লেষকের কাছেই এক ‘গেম চেঞ্জার’ ঘটনা।

তারেক রহমান দীর্ঘ ১৭ বছর বিদেশে অবস্থান করলেও ভার্চুয়াল মাধ্যমেই তিনি দলীয় নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ থাকায় দলের কার্যকর নেতৃত্ব অনেকটাই তারেক রহমানের হাতেই ছিল। এবার তাঁর সরাসরি উপস্থিতি বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি ও নির্বাচনী প্রস্তুতিকে আরও দৃঢ় করবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শ্যাম কুমার মনে করেন, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন নির্বাচন প্রক্রিয়ার জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বাংলাদেশের খবরকে বলেন, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন এই মুহুর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঘটনা। বাংলাদেশের নির্বাচন প্রস্তুতির ক্ষেত্রে এটি শেষ পাজলের টুকরো। তাঁর ফিরে আসার মধ্য দিয়ে বিএনপি সম্পূর্ণভাবে মাঠে নামার বার্তা দিল। এবং সবচেয়ে বড় কথা বাংলাদেশের ডানপন্থীগ্রুপগুলোর জন্য বড় ধাক্কা। 

শ্যাম কুমারের মতে, শুধু দেশীয় রাজনীতি নয়, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের কাছেও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত। কারণ, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এই বাংলাদেশে যেভাবে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছিল। মবক্রেসি বেড়ে গিয়েছিল। এবং এসব করছে ডানপন্থী গ্রুপগুলোই। ইউনূস সরকারের সবচেয়ে বড় সংকট তৈরি করেছে, হরকাতুল জিহাদসহ বহু মিলিট্যান্ট লিডারদের মুক্তি দিয়ে। এটা বাংলাদেশের জন্য যেমন ঝুকিপূর্ণ, ভারতের জন্যে তো বটেই, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্যেও ঝুকিপূর্ণ। 

একই সুরে কথা বলেছেন জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের ফেলো আশিষ কুমার। তাঁর মতে, দীর্ঘ ১৭ বছর পর দেশে ফিরে তারেক রহমানের সামনে একদিকে যেমন বদলে যাওয়া বাংলাদেশকে নতুন করে বোঝার সুযোগ তৈরি হবে, তেমনি সাধারণ মানুষও তাঁকে নতুনভাবে মূল্যায়ন করার সুযোগ পাবে। 

আশিষ কুমার বাংলাদেশের খবরকে বলেন, গত দেড় দশকে বাংলাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। এই সময়ে একটি নতুন প্রজন্ম রাজনীতিতে আগ্রহী হয়েছে, যাদের প্রত্যাশা ও দৃষ্টিভঙ্গি আগের তুলনায় ভিন্ন। তারেক রহমান দেশে ফিরে এসব পরিবর্তনের সঙ্গে সরাসরি পরিচিত হতে পারবেন এবং বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে নিজের রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ করতে পারবেন। একই সঙ্গে জনগণও দেখবে, দীর্ঘ প্রবাসজীবনে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা, নেতৃত্বের ধরন এবং রাষ্ট্র পরিচালনা সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গিতে কী ধরনের পরিণত পরিবর্তন এসেছে। আশিষ কুমারের মতে, এই পারস্পরিক পুনরাবিষ্কারের প্রক্রিয়াই আগামী দিনের রাজনীতিতে তারেক রহমানের ভূমিকা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

ভারতের দৃষ্টিতে কেন গুরুত্বপূর্ণ

তারেক রহমানের দেশে ফেরা ভারতীয় নীতিনির্ধারক ও কূটনৈতিক মহলেও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। ঐতিহাসিকভাবে বিএনপি ও ভারতের সম্পর্ক সবসময় মসৃণ ছিল না। তবুও বর্তমান প্রেক্ষাপটে ভারত বিএনপিকে তুলনামূলকভাবে একটি উদার ও গণতান্ত্রিক বিকল্প হিসেবে দেখছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। নয়াদিল্লির প্রত্যাশা, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনে বিএনপি কর্মীরা উজ্জীবিত হবে এবং দলটি সরকার গঠন করলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে।

তবে নির্বাচনী মাঠ পুরোপুরি সরল নয়। ছাত্রদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি) অভিযোগ করেছে, বিএনপি নাকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ-এর কিছু নেতাকর্মীকে দলে ভেড়াচ্ছে। এসব অভিযোগ নির্বাচনী রাজনীতির উত্তাপ আরও বাড়িয়েছে।

ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলি তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনকে রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া অসুস্থ থাকায় বাস্তবে দলের নেতৃত্ব অনেকটাই তারেক রহমানের ওপর নির্ভরশীল ছিল। তিনি বিদেশে থেকেও কার্যকর নেতৃত্ব দিয়েছেন। অনলাইনে হলেও তাঁর নেতৃত্ব বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছে, বলেন রিভা গাঙ্গুলি।

রিভা গাঙ্গুলির মতে, বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ডানপন্থী শক্তির উত্থান। এই প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানকে তিনি একজন তুলনামূলকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ নেতা হিসেবে দেখছেন। এই মুহূর্তে তারেক রহমান এমন একজন নেতা, যাঁর মাধ্যমে রাজনৈতিক উত্তাপ কিছুটা কমতে পারে, মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, নির্বাচন তারিখ ঘোষণার পর পুরো দেশই এখন নির্বাচনী আবহে। অতীতের অভিজ্ঞতা টেনে এনে রিভা গাঙ্গুলি স্বীকার করেন, একসময় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী-এর জোট ভারতের জন্য ইতিবাচক ছিল না। তবে পরিস্থিতি বদলেছে। এখন বিএনপি জামায়াত থেকে আলাদা, রাজনৈতিক বাস্তবতাও ভিন্ন, বলেন তিনি।

রিভা গাঙ্গুলির ভাষায়, প্রতিবেশী বদলানো যায় না—বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কও সেই বাস্তবতার মধ্যেই গড়ে উঠতে হবে। তাঁর ধারণা, তারেক রহমান নেতৃত্বে এলে বিএনপি আগের তুলনায় বেশি বাস্তববাদী অবস্থান নেবে এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে চলমান উত্তেজনা কমানোর চেষ্টা করবে।

সব মিলিয়ে, তারেক রহমানের দেশে ফেরা শুধু বিএনপির জন্য নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির জন্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সামনে নির্বাচন—এই প্রত্যাবর্তন শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার পালাবদলে রূপ নেয় কি না, সেদিকেই এখন তাকিয়ে আছে দেশ ও আন্তর্জাতিক মহল- এমনটাই মনে করছেন এই কুটনীতিক। 

সিয়াম/আইএইচ

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

ভারত তারেক রহমান

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর