
উত্তরাধিকার সূত্রে অন্তর্বর্তী সরকার অনেকগুলো সমস্যা নিয়ে দায়িত্ব নিয়েছে। ফলে বিগত ছয় মাসে তাদের যেটা মূল কাজ, তারা সেটি এখনো শুরু করতে পারেনি। সামগ্রিকভাবে দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভালো না, দেশি-বিদেশি দুটোই। আবারও সক্রিয় হচ্ছে অপরাধের অর্থনীতি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বেশ খারাপ। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে অনেক ক্ষেত্রে তাদের অলস মনে হচ্ছে, কোথাও মনে হচ্ছে অগোছালো। মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতিসহ গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোয় এখনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নানান মহল থেকে তোলা দাবির বিষয়ে মনে হয় সরকারের একটা ভীতি আছে। গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলেও এর গতি মন্থর। সরকারের কার্যক্রম প্রকৃত মৌলিক সংস্কারগুলো থেকে অনেক দূরে। তবে, আগামী ছয় মাসে সরকার যদি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগ পরিস্থিতি উন্নতি, মুদ্রা ও রাজস্বনীতি উন্নতি, প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজগুলো শুরু এবং গণহত্যার বিচার কাজগুলো আশানুরূপ ভালো করতে পারে, তবে গত ছয় মাসের সমস্যা মানুষ বড় করে দেখবে না।
এদিকে জনজীবনে নাভিশ্বাস তুলে দিচ্ছে মূল্যস্ফীতি। মূলধনের প্রবাহ কমে গিয়ে শ্লথ হয়ে পড়েছে বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি। আসছে না দেশি-বিদেশি নতুন বিনিয়োগ। বাড়ছে দারিদ্র্য ও কর্মহীনতা। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে বাংলাদেশে আত্মঘাতী জনতুষ্টিবাদ বড় ধরনের অস্থিতিশীলতার কারণ হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।
জুলাই আন্দোলন চলার সময় এইচএসসি ও সমমানের কিছু বিষয়ে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এলে স্থগিত হওয়া পরীক্ষা বাতিল করে অটোপাসের দাবিতে আন্দোলনে নামে এইচএসসি ও সমমান পর্যায়ের পরীক্ষার্থীরা। ক্ষমতা গ্রহণের ওই মাসেই সরকারও অটোপাসের দাবি মেনে নেয়। সেই সঙ্গে সামনে আসতে থাকে একের পর এক দাবি।
এর মধ্যে অনেকগুলোর যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হলে তা শেষ পর্যন্ত মেনে নেওয়া হয়। রাজনীতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, রাষ্ট্রে দীর্ঘদিন ধরে অচলায়তনে রূপ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার পরিবর্তে জনতুষ্টি অর্জন করতে গিয়ে দাবিগুলো মেনে নেওয়া হয়েছে। এসব কারণে সরকারের কার্যক্রম প্রকৃত মৌলিক সংস্কারগুলো থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাসের কার্যক্রম প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, 'ছয় মাসে তাদের যেটা মূল কাজ তারা সেটি এখনো শুরু করতে পারেনি। সংস্কারের কাজগুলো শুরু করেছে এটা খারাপ না। এটা যদি সম্পন্ন করতে পারে তাহলে ভালো। আর দ্রুত নির্বাচনটা যদি করে ফেলতে পারে সেটা ভালো। তাদের ব্যর্থতা যদি বলি, সেটা হচ্ছে 'ল অ্যান্ড অর্ডার' কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।'
রাজধানী ঢাকা এখন বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নগরীগুলোর অন্যতম। প্রায় প্রতিদিনই একিউএয়ারের বৈশ্বিক বায়ুমান সূচকে সবচেয়ে দূষিত বাতাসের নগরীর তালিকায় শীর্ষে উঠছে ঢাকা। আবার জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে থাকা দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। দেশের নদীগুলোর দূষণ এখন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। পরিবেশ ও জলবায়ুগত সংকট মোকবিলায় অন্তর্বর্তী সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নেবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছিল। যদিও এখন পর্যন্ত পলিথিনের ব্যবহার বন্ধের ঘোষণা ছাড়া আর কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ তেমন একটা দেখা যায়নি। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ বলেন, 'নানান মহল থেকে তোলা দাবির বিষয়ে মনে হয় সরকারের একটা ভীতি আছে। যৌক্তিক দাবির সঙ্গে অযৌক্তিক দাবিও কিছু ক্ষেত্রে মেনে নেওয়া হয়। বিশেষ করে ছাত্ররা যদি কোনো দাবি করে তখন বিচার-বিবেচনা করে না। আবার যৌক্তিক অনেক দাবি পূরণ হচ্ছে না। হত্যাকাণ্ডের বিচারের বিষয়টাও পরিষ্কার না। যেখানে অনেকগুলো মামলা হয়েছে খুব পাইকারি মামলা, দুর্বল মামলা।
এটিও একটি দুর্বলতার জায়গা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বেশ খারাপ। আরেকটি হলো দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় জোরজবরদস্তি, মব ভায়োলেন্স, চাঁদাবাজি একটি অগ্রাধিকারের মধ্যে থাকা দরকার ছিল সেটি নেই।
এসব ক্ষেত্রে ছয় মাসের মধ্যে দুর্বলতা প্রকাশ করছে সরকারের। কিছু পদক্ষেপ খুব চিন্তার বিষয়। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কিছু পদক্ষেপ, যেমন টেন্ডার ছাড়া এলএনজি আমদানির চুক্তি করা, দায় মুক্তি আইনের অধীন প্রকল্পগুলোর চুক্তি অব্যাহত রাখা, রামপালে সুন্দরবন ধ্বংসকারী বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল হবে না বলে এটি আগেই ঘোষণা করা; এগুলো একটু উদ্বেগের বিষয়। সে কারণে ছয় মাসের প্রত্যাশার সঙ্গে কিছু অসংগতি রয়েছে। তবে কমিশন গঠন করা ভালো কাজ ছিল। কমিশনের রিপোর্ট জমা হয়েছে এটা ভালো কাজ। এগুলোর ভিত্তিতে সরকারের ভূমিকা যথাযথ হওয়া দরকার।' তিনি বলেন, সেটি সরকারের ভূমিকার ওপর নির্ভর করবে। এখনো সরকারের করণীয় আছে অনেক কিছু। কিন্তু সরকার এ রকম দুর্বল থাকলে তো হবে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের অলস মনে হচ্ছে, কোথাও মনে হচ্ছে অগোছালো। কোথাও কোথাও রহস্যজনক মনে হচ্ছে। এ সরকার তো একটা গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এসেছে। এগুলো থেকে বের হতে হবে।
ক্ষমতা গ্রহণের ছয় মাসে মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি, বিনিয়োগসহ গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোয় এখনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়নি অন্তর্বর্তী সরকার। সেই সঙ্গে রয়েছে কর্মসংস্থানের সংকট। গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় এখন মূল্যস্ফীতির হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। এখানে মূল্যস্ফীতির হার এখনো ১০ শতাংশের কাছাকাছি। দেশের অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মোট ইস্যুকৃত মূল্যমানের বেশির ভাগই এখনো ব্যাংক খাতের বাইরে। অভ্যুত্থানের। পর কিছুদিন থেমে থাকার লক্ষণ দেখালেও এখন আবারও সক্রিয় হচ্ছে অপরাধের অর্থনীতি। চলমান অর্থনৈতিক সংকটের লাগাম টানতে না পারলে আশাবাদী হওয়া যাবে না বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান। তার মতে, এ সরকার বেশ কিছু অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ নিয়েই ক্ষমতায় এসেছে। বিশেষ করে আমাদের মূল্যস্ফীতির সমস্যা ছিল সেটি এখনো আছে।
সামগ্রিকভাবে দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভালো না। দেশি-বিদেশি দুটোই। সুতরাং উত্তরাধিকার সূত্রে অন্তর্বর্তী সরকার এ সমস্যাগুলো নিয়েই এসেছে।
আমাদের আশা ছিল অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়গুলোকে অ্যাড্রেস করবে ভালোভাবে। কিন্তু কিছু জায়গায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া আমার। যেমন মূল্যস্ফীতির বিষয়ে এখনো কোনো বড় সাফল্য দেখিনি। জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। এটা যতটুকু সরকারের সাফল্য তার চেয়ে বেশি সিজনাল ইফেক্ট আমি বলব। সামনের দিনগুলোয় বিশেষ করে রোজার সময় মূল্যস্ফীতি কতটা নিয়ন্ত্রণে থাকবে আমার সন্দেহ আছে। এর বড় কারণ হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় যে রকম সমন্বয় দরকার ছিল সেটি আমি দেখিনি।' দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও খুব একটা উন্নতি ঘটেনি। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে অপহরণ, চুরি, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ বেড়েছে। পুলিশ বাহিনীকে কাজে ফেরানো গেলেও এখনো কার্যকরভাবে সক্রিয় করে তোলা যায়নি। মব জাস্টিস, হেফাজতে মৃত্যু এমনকি কর্তব্য পালনকালে পুলিশের ওপর হামলার মতো ঘটনাগুলোও বেড়েছে।
ছয় মাসের মূল্যায়নে ভালো-মন্দ দুই দিক রয়েছে উল্লেখ করে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও প্রচার বিভাগীয় সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, 'আমরা দেখি ভালো-মন্দ, সফলতা-ব্যর্থতা দুটিই আছে। কারণ সরকারকে প্রথম তো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির দিকে নজর দিতে হয়েছে। সেটা মোটামুটি, তারা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা হলেও উন্নতি করতে পেরেছে। তার ওপর পতিত স্বৈরাচারের দোসররা আন্দোলনের মাধ্যমে কিছুটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করার চেষ্টা করেছে। সেটি প্রতিহত করতে পেরেছে। তার ওপর যে ২৮ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে সে ব্যাপারে অগ্রগতি আনতে পেরেছে। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণের জায়গায় তাদের দুর্বলতা বা ব্যর্থতা রয়েছে। ট্যাক্স, ভ্যাট এগুলো বসিয়েছে যা স্বার্থবিরোধী। সরকারের সংস্কারের জন্য যে ঘোষণা সেটিও বেশি গতি পায়নি। আরও গতি পাওয়া দরকার ছিল।
আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, গত ছয় মাসে সরকারের কাজের মূল্যায়ন করলে আমরা দেখি; দেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলার উন্নতি ঘটাতে তাদের সাফল্য উল্লেখযোগ্য পর্যায়ের না। অর্থনীতিতে গতি আনার চেষ্টা করলেও দ্রব্যমূল্যসহ নানা বিষয়ে জনগণ সরকারের প্রতি সন্তুষ্ট না। গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলেও এর গতি মন্থর। সংস্কার কমিটিগুলোর প্রস্তাব পর্যালোচনা করে একটি জাতীয় ঐকমত্যে পৌঁছানোর জন্য সরকার কাজ শুরু করেছে। নির্বাচন কমিশনও তাদের পরিকল্পনামাফিক কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। গত ছয় মাসের সমস্যাকে মানুষ বড় করে দেখবে না যদি আগামী ছয় মাসে সরকার আশানুরূপ ভালো করতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রত্যেক উপদেষ্টা যদি একটি করে ভালো কাজ করতে পারেন তাহলেই অনেক বড় পরিবর্তন সংঘটিত হবে বলে আশাবাদী জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। কছেশ দিন আগে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, হয়তো রাতারাতি সব বদলানো সম্ভব নয়। তবে সরকারের আরও কঠোর হওয়া প্রয়োজন। উপদেষ্টারা অনেক রক্তের বিনিময়ে এ জায়গাটা পেয়েছেন। তাই প্রত্যেক উপদেষ্টা যদি একটি করে ভালো কাজ করেন, তাহলেই অনেক বড় পরিবর্তন হবে এবং উপকার হতো। এ প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি। শুধু সবার সদিচ্ছা দরকার। এ পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে বলে আমরা আশাবাদী এবং এ বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, ততদিন মানুষ তাদের (উপদেষ্টাদের) স্মরণে রাখবে।
এটিআর/