জুলাই আন্দোলন
আহতদের চিকিৎসায় অগ্রাধিকার, তবুও শত অভিযোগ
প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:২৮
-67b57a2057865.jpg)
ছবি : সংগৃহীত
জুলাই আন্দোলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে সারাদেশে স্বৈরাচার হাসিনার বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে এসেছিল কয়েক কোটি ছাত্র-জনতা। গণ-আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। কিন্তু হাসিনার পতন এতটা সহজ ছিল না। এর বিনিময়ে দিতে হয়েছে বহু ছাত্র-জনতার জীবন। সরকারি হিসাব অনুযায়ী এ আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন এক হাজার ৪২৩ জন
এবং আহত হয়েছেন ২২ হাজারের বেশি মানুষ। নিহত পরিবারগুলোকে ইতিমধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সহায়তা করছে একই সাথে আহতদের চিকিৎসায় সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তবুও জুলাই আন্দোলনে আহতরা সুচিকিৎসা না পাওয়ার অভিযোগ তুলছেন।উন্নত চিকিৎসার দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাস ভবন ঘেরাও থেকে শুরু করে সড়ক অবরোধের মত অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে।
চিকিৎসা দেশে-বিদেশে
জুলাই আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসায় সরকার দেশে ও বিদেশে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে।দেশে চিকিৎসার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে (বিএসএমএমইউ) ডেডিকেটেড করা হয়েছে। এছাড়া জুলাই আন্দোলনে আহত হয়ে সবচেয়ে বেশি রোগী আসা ঢাকার তিন বিশেষায়িত হাসপাতাল-জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) চলছে আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা।এসব হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায় আন্দোলনে আহত অনেকে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আবার কেউ কেউ চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরে গেছেন। আবার অনেকে নিয়মিত চেকআপসহ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে আসছেন।
আন্দোলনে গুরুতর আহত ৩৮ জনকে এখন পর্যন্ত উন্নত চিকিৎসার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জন্য পাঠানো হয়েছে। বেশ কয়েকজনকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠানোর কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। একই সাথে যুক্তরাষ্ট্র,রাশিয়া,চীন, সিঙ্গাপুর এবং থাইল্যান্ড চিকিৎসকদের দেশে নিয়ে এসে আহতদের চিকিৎসা পরামর্শ নিচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।সবশেষ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) আন্দোলনে আহত ৯৬ জনকে চিকিৎসা দিয়েছেন।আন্দোলনে চোখে গুরুতর আহত রোগীদের জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং বাংলাদেশ আই হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে গেছেন সিঙ্গাপুর থেকে আসা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল।
অভিযোগ স্পষ্ট ও ব্যবস্থা নিচ্ছে মন্ত্রণালয়
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসায় অগ্রাধিকার দেওয়ার পরও রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীরা উন্নত চিকিৎসার দাবিতে রাজপথে নেমে আসছেন। রাজধানীর কয়েকটি হাসপাতালে ঘুরে আহতদের সাথে কথা বলে তাদের অভিযোগ ও ক্ষোভের বিষয়ে জানা যায়।
জুলাই আন্দোলনে উত্তরায় আহত হয়ে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) চিকিৎসাধীন আসিফ বলেন, আমার বাম পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে গিয়েছিল।আমি দীর্ঘদিন এখানে চিকিৎসাধীন রয়েছি।প্রথম দিকে নিয়মিত সিনিয়র চিকিৎসকরা এসে তদারকি করলেও দিন যত যাচ্ছে সিনিয়র চিকিৎসকরা কম আসছেন।
আন্দোলন চলাকালে মুন্সিগঞ্জে পুলিশের ছোড়া ছড়ার গুলিতে মাথায় গুরুতর আহত হন রিজন হোসেন। তিনি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।তিনি বলেন, আমার মাথায় এখনও চারটি ছড়ার গুলি রয়েছে।এগুলোর অসহনীয় ব্যথা নিয়ে দিন পাড় করছি। চিকিৎসকরা বলছেন দেশে এগুলোর অপারেশন করানো সময়সাপেক্ষ। আমি উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতে চাই।
রাজধানীর একটি হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন মীর আলী (ছদ্মনাম)। তার স্ত্রী বলেন, মীর আলীকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হবে।কিন্তু দিন যত যাচ্ছে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেছি। তারা জানিয়েছেন বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। দ্রুত সময়ের মধ্যে তাকে তারা বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠাবেন।
অন্যদিকে জুলাই আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে এ,বি,সি,ডি চারটি ক্যাটাগরি করা হয়েছে।যেখানে অনেকে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ তুলছেন। ‘এ’ ক্যাটাগরিতে অতিগুরুতর আহত, যাদের আজীবন সাহায্যের আওতায় আনতে হবে, তাদের রাখা হয়েছে। ‘এ’ ক্যাটাগরিতে যারা থাকবে-উভয় হাত/পাবিহীন, সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন, সম্পূর্ণভাবে মানসিক বিকারগ্রস্ত এবং কাজ করতে অক্ষম বা অনুরূপ আহত ব্যক্তি। ‘বি’ ক্যাটাগরিতে থাকবে-গুরুতর আহত, যাদের দীর্ঘদিন সাহায্য দিতে হবে, এক হাত/পা বিচ্ছিন্ন, আংশিক দৃষ্টিহীন, মস্তিষ্কে গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত বা অনুরূপ আহত ব্যক্তি। ‘সি’ ক্যাটাগরিতে আছেন-আহত যারা এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন কিংবা সুস্থ হতে আরও চিকিৎসা প্রয়োজন এবং স্বাভাবিক কার্যক্রম করতে সক্ষম হবেন। যেমন: শ্রবণশক্তি/দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত, গুলিতে আহত বা অনুরূপ আহত ব্যক্তি। ‘ডি’ ক্যাটাগরি হচ্ছে-সাধারণ আহত, যারা আহত হওয়া সত্ত্বেও ইতোমধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করেছেন এবং স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে সক্ষম ব্যক্তি।
আহতদের চিকিৎসা ও অভিযোগ নিয়ে
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান(প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদা) বলেন, জুলাই আন্দোলনে আহত যোদ্ধাদের সুচিকিৎসা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব মনে করি। আহতদের যথাযথ চিকিৎসার ব্যাপারে আমাদের পক্ষ থেকে আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। আহতদের চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ পেলেই তদন্ত করে ব্যবস্থা নিচ্ছি।
আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন ক্যাটাগরি নিয়ে তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে এ, বি, সি, ডি নামে চারটা ক্যাটাগরি করা হয়েছে। আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলতে চাই এটা আমরা বিজ্ঞানসম্মত ভাবে তৈরি করেছি। আহত যোদ্ধাদের সেটা নিয়ে কোন আপত্তি থাকলে তারা রিভিউ করতে পারে এবং আমরা আমাদের এক্সপার্ট টিম দিয়ে সেটা বিবেচনা করব।
আহতদের চিকিৎসা নিয়ে সম্প্রতি স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম বলেন, ‘আমরা যখন দায়িত্ব গ্রহণ করি তখন প্রধান উপদেষ্টার আমাদের উপর নির্দেশ ছিল আহতদের ব্যাপারে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া। সেটা আমরা পালন করার চেষ্টা করেছি এবং করে যাচ্ছি।আমরা বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল নিয়ে এসেছি।গুরুতর আহতদের উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের চেষ্টা ছিল যে ছেলেগুলো হাত,পা, চোখ হারিয়েছে তাদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবাটা দেয়া। যখন দায়িত্বটা গ্রহণ করি তখন ডলার সংকট ছিল।তবুও আমরা আহতদের চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠিয়েছি, বিদেশি চিকিৎসকদল নিয়ে এসেছি।চিকিৎসা বাবদ দেশে ও বিদেশে অনেক টাকা ব্যয় হয়ে গেছে। আহতদের চিকিৎসার বিষয়ে আমাদের কোন কার্পণ্য নেই। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে যেভাবে হোক আহতদের সুস্থ করে তোলা।’
এসআইবি/এমআই