Logo

মতামত

দৃষ্টিপাত

মে দিবসের ভাবনা

মেহেদী হাসান শোয়েব

মেহেদী হাসান শোয়েব

প্রকাশ: ০১ মে ২০২৫, ০৯:৩০

মে দিবসের ভাবনা

প্রতি বছর ১ মে বিশ্বজুড়ে পালিত হয় মহান মে দিবস—শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের এক ঐতিহাসিক দিন। বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের আন্দোলনের মধ্যে এই দিনটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত। শিকাগো শহরের 'হে মার্কেট' বিক্ষোভ, যা ১৮৮৬ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, শ্রমিক আন্দোলনের চিরকালীন স্মৃতিচিহ্ন হয়ে আছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শ্রমিকরা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই দিনটিতে প্রতিবাদ, আলোচনা, এবং নানান কার্যক্রম পরিচালনা করে। বাংলাদেশের জন্যও দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমাদের অর্থনীতি প্রধানত শ্রমনির্ভর। শ্রমিকদের কষ্টার্জিত ঘামে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেশের মূল অর্থনৈতিক ভিত্তি, যার মধ্যে তৈরি পোশাক শিল্প, প্রবাসী আয়, কৃষি উৎপাদন অন্যতম। তবুও, আজও শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা পায়নি।

১৮৮৬ সালের ১ মে, যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের ‘হে মার্কেট’ বিক্ষোভে অংশ নিয়ে শ্রমিকরা কাজের সময়সীমা ৮ ঘণ্টায় সীমিত করার, নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং সম্মানজনক মজুরির দাবিতে রাস্তায় নামে। পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারায় অনেক শ্রমিক। এই আত্মত্যাগ বিশ্ব শ্রমিক আন্দোলনের মাইলফলক হয়ে ওঠে, যা আজও সারা পৃথিবীর শ্রমিক আন্দোলনের প্রেরণা।

বাংলাদেশে মে দিবস সরকারি ছুটি হিসেবে পালিত হয়। তবে প্রশ্ন ওঠে—আমরা কি শুধুই মিছিল, মিটিং, বক্তৃতা ইত্যাদির মধ্যেই দিবসটির তাৎপর্যকে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি? প্রকৃত সমস্যা নিয়ে আলোচনা এবং তার সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ কতটুকু নেওয়া হয়?

বাংলাদেশ গত দুই দশকে শ্রমনির্ভর অর্থনীতিতে অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করেছে। তৈরি পোশাক খাত বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক হিসেবে নিজেদের স্থান করে নিয়েছে। বৈদেশিক রেমিট্যান্স, কৃষিপণ্য উৎপাদন, নির্মাণ, সেবাখাত—সবকিছুতেই শ্রমিক শ্রেণির অবদান সুস্পষ্ট। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো অর্থ ছিল ২৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি, যা জাতীয় অর্থনীতির জন্য বিরাট অবলম্বন।

তবে, এই অগ্রগতির বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে শ্রমিকদের দুর্দশা, বৈষম্য এবং অবহেলার দীর্ঘ ইতিহাস। গার্মেন্টস খাতে ৩৮ লাখ শ্রমিক কাজ করলেও তাদের বেতন কাঠামো এখনও অনেকাংশে জীবনযাত্রার উপযোগী নয়। ২০২৩ সালের শেষে ঘোষিত সর্বনিম্ন মজুরি ১২,৫০০ টাকা—যা ঢাকার মতো শহরে বসবাসের জন্য যথেষ্ট অপ্রতুল। অধিকাংশ শ্রমিকই নিয়মিত তাদের বেতন পায় না, তাদের বেতন-ভাতার দাবিতে প্রায়শই আন্দোলনে নামতে হয়।

বাংলাদেশে গার্মেন্টস শ্রমিকরা প্রায়ই তাদের মজুরি নিয়ে আন্দোলন করেছে। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনা যেমন একটি মর্মান্তিক উদাহরণ, যেখানে ১,১৩৪ জনের বেশি শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেন। এই ঘটনায় সারা বিশ্বে শ্রমিক অধিকার নিয়ে আলোচনা শুরু হয় এবং বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে নতুন আইন প্রণীত হয়। তবে, ছোটখাটো কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও পরবর্তী বছরগুলোতে শ্রমিকদের প্রতি কর্মস্থলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নয়ন এবং তাদের অধিকারের বিষয়ে বড় কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন কার্যত হয়নি।

বাংলাদেশে প্রায় ৮৫% শ্রমিক আনুষ্ঠানিক খাতের বাইরে কাজ করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী,  অপ্রাতিষ্ঠানিক এই শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি। তারা সামাজিক সুরক্ষা, ছুটি, চিকিৎসা সুবিধা পায় না, বিশেষত গৃহশ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, দিনমজুরদের তো একেবারে আইনি সুরক্ষাও নেই। বিশালসংখ্যক শ্রমিকের প্রতি রাষ্ট্রের এ রকম অবহেলার বিষয়টি উদ্বেগের। ২০২৪ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি দিন গড়ে ৫ জন শ্রমিক কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় শিকার হন, যাদের মধ্যে অনেকেই মৃত্যুবরণ করেন।

ফলে এ কথা বলাই যায় যে, আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি অনুযায়ী শ্রমিকের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে কার্যকর পদক্ষেপ এখানে নেই। 

মে দিবসে যখন শ্রমিকরা মিছিল বা বক্তৃতা শোনেন, তখন তাদের সামনে একাধিক ভাবনা দাঁড়িয়ে থাকে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, তারা কি সত্যিই তাদের দিনটিকে সম্মানিত মনে করেন? বহু শ্রমিক জানেন না মে দিবসের প্রকৃত তাৎপর্য। তারা হয়তো জানেন, এটি নিছকই একটি ছুটির দিন। তাদের জন্য এই দিনটি কেবল একটি বিরতি—একটু স্বস্তির মুহূর্ত, একটা দিন কাজে না গিয়ে পরিবারকে সময় দিতে পারেন। সবার বা সব পেশার শ্রমিকদের বেলায় সেটুকুও হয় না। আর তার চেয়েও নির্মম বাস্তবতা হলো—এই দিবস উদযাপনের পরেও তাদের বেতন-ভাতা বা কাজের পরিবেশে কোনো পরিবর্তন আসে না।

বাংলাদেশে মে দিবস পালিত হয় মোটামুটি উৎসবমুখর পরিবেশে। মঞ্চ হয়, ব্যানার টাঙানো হয়, বক্তৃতা দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে শ্রমিকদের অভিজ্ঞতা এই অনুষ্ঠানে কতটা স্থান পায়? অনেক সময় আমরা শুধুমাত্র একটি বাহ্যিক আড়ম্বরের মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের প্রতি সম্মান দেখানোর চেষ্টা করি। কিন্তু তাদের প্রকৃত সমস্যা সমাধান হয় না। এমনকি শ্রমিকদের সমস্যা-সংকটকে নিয়ে রাজনীতিও হয়! তবে ভাগ্য ফেরে না তাদের।  

প্রতিবছর রাজনৈতিক দল ও সরকারপন্থী শ্রমিক সংগঠনগুলো নিজেদের উপস্থিতি দেখানোর প্রতিযোগিতায় নামে, কিন্তু আলোচনা হয় কেবল শ্লোগান নিয়ে। অনেক শ্রমিক জানেন না মে দিবসের প্রকৃত তাৎপর্য, কারণ তারা রাজনৈতিক সচেতনতা বা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। অনেক গার্মেন্টস শ্রমিকের কাছে মে দিবস মানে শুধুমাত্র একটি ছুটির দিন। অনেক ক্ষেত্রে ওভার টাইম বা বিশেষ ব্যবস্থায় উৎপাদন চালু রাখার নামে সব শ্রমিক সেই ছুটিটুকুও উপভোগ করতে পারেন না।

বাংলাদেশে শ্রমিক রাজনীতি অনেক সময় রাজনৈতিক দলগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকে। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনগুলি প্রাসঙ্গিক শ্রমিক দাবির বদলে দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত থাকে। ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) বাংলাদেশকে সতর্ক করেছিল যে, শ্রমিকদের অধিকার হরণের বিষয়ে যথেষ্ট অগ্রগতি না হলে তা আন্তর্জাতিক রপ্তানিতে তা প্রভাব ফেলতে পারে।

অবশ্য কেবল বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের অনেক দেশেও শ্রমিকদের অধিকার এবং মে দিবস পালনে এখনও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, উন্নত দেশগুলো যেমন আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অস্ট্রেলিয়াতে মে দিবস পালনের প্রক্রিয়া একটু আলাদা। সেখানে শ্রমিকদের অধিকার এবং কাজের পরিবেশ উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তবে অনেক ক্ষেত্রেই মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে শ্রমিকরা এখনও লড়াই করছে।

উদাহরণস্বরূপ, জার্মানিতে শ্রমিকরা মে দিবসে প্রতিবাদী মিছিলের মাধ্যমে নিজেদের অধিকার নিয়ে আরও সচেতনতা সৃষ্টি করতে চেষ্টা করেন। সেখানে শ্রমিকদের জন্য উচুঁ মজুরি, স্বাস্থ্যকর কর্মস্থল এবং সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা রয়েছে। জার্মান শ্রমিকদের একটি বড় অংশ ট্রেড ইউনিয়ন সদস্য। সরকার প্রতিনিয়ত শ্রমিকদের স্বার্থে নীতি তৈরি করে, তবে সম্প্রতি সেখানেও অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করা শ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা বাড়ানোর দাবি উঠেছে। এই ব্যবস্থাগুলোর সফলতা, অন্য দেশে কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হওয়া, বিশেষত বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে, তা এখনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

অন্যদিকে, অস্ট্রেলিয়া-তে শ্রমিকদের জন্য বেতন, কর্মঘণ্টা এবং শ্রমিকের নিরাপত্তা নিয়ে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। কিন্তু এখনও সেখানে কিছু সংস্থা, বিশেষত কৃষি ক্ষেত্রের শ্রমিকরা তাদের শ্রমের ন্যায্য মূল্য পান না এবং এ বিষয়ে যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ রয়েছে।

সময় এসেছে কিছু বাস্তব পরিবর্তনের পথে হাঁটার। মে দিবস উদযাপন করতে হবে বাস্তবসম্মত ও কার্যকরী পদক্ষেপের মাধ্যমে। কিছু প্রস্তাব দেওয়া হলো :

ন্যায্য মজুরি নির্ধারণ : শ্রমিকদের জীবনযাত্রার ব্যয় অনুযায়ী ন্যূনতম মজুরি হালনাগাদ করা জরুরি। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকা শহরের জন্য এটি ২০,০০০ টাকা হতে পারে।

সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা : কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ বা পঙ্গুত্বের শিকার শ্রমিকদের জন্য বাধ্যতামূলক বীমা ও ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। জাতীয়ভাবে একটি শ্রমিক নিরাপত্তা তহবিল তৈরি করা জরুরি, যাতে কর্মস্থলে দুর্ঘটনার শিকার শ্রমিকরা দ্রুত ক্ষতিপূরণ পায়। এছাড়া, গার্মেন্টস খাতে শিশু কর্মী নিযুক্তি বন্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে এবং মহিলা শ্রমিকদের জন্য মাইক্রোক্রেডিট সুবিধা বাড়াতে হবে।

ট্রেড ইউনিয়ন স্বাধীনতা : শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার অধিকার আইনের মাধ্যমে সুরক্ষিত করতে হবে। মালিকপক্ষ বা প্রশাসনের চাপের বাইরে, শ্রমিকদের সংগঠন গঠন ও তাদের দাবি আদায়ের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।

নারী শ্রমিক সুরক্ষা : গার্মেন্টস এবং অন্যান্য খাতে কাজ করা নারী শ্রমিকদের জন্য কর্মস্থলে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র, স্যানিটারি সুবিধা এবং হয়রানি প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

অনানুষ্ঠানিক খাতকে অন্তর্ভুক্ত করা : দিনমজুর, রিকশাচালক, গৃহশ্রমিক—এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় আনতে হবে।

কারিগরি প্রশিক্ষণ ও পুনরায় দক্ষতা উন্নয়ন (Reskilling) : শ্রমিকদের ডিজিটাল স্কিল, অটোমেশন এবং গিগ-ইকোনমির মতো বিষয়গুলোর উপর প্রশিক্ষণ প্রদান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মে দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, শ্রমিক শুধু উৎপাদনের যন্ত্র নয়, তিনি এই সমাজের সম্মানিত নাগরিক। উন্নয়ন মানে শুধু বড় বড় ভবন, রপ্তানির গ্রাফ বা জিডিপি বাড়ানো নয়—এটি মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন। আর সেই উন্নয়নের প্রথম দাবি হলো, শ্রমিকের ঘাম ও শ্রমকে মূল্য দেওয়া। 

আজকের মে দিবসে কেবল কথার ফুলঝরি নয়, চাই শ্রমিকবান্ধব নীতি, কার্যকর আইন প্রয়োগ এবং সর্বোপরি শ্রমিকের প্রতি সম্মান। তাহলেই এই মহান দিনটি তার প্রকৃত মর্যাদা পাবে।

মেহেদী হাসান শোয়েব : লেখক, প্রকাশক, বিতার্কিক; শিফট ইনচার্জ, বাংলাদেশের খবর

  • বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bkeditorial247@gmail.com
Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর