মফস্বল সাংবাদিকদের শ্রমে-ঘামে ঢাকার সম্পাদকদের বৃহস্পতি তুঙ্গে
প্রকাশ: ০১ মে ২০২৫, ১৫:৫৩

নিয়ন মতিয়ুল
সকালে উঠেই প্রিয়জন সাংবাদিক মোস্তফা সবুজের (Mostafa Shabuj-গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনে মফস্বল থেকে যুক্ত হওয়া একমাত্র সদস্য) ‘মহান মে দিবস উপলক্ষে’ লেখাটা চোখে পড়ল। উপসংহারে সবুজ বলেছেন, মফস্বল সাংবাদিকতায় নৈরাজ্য ও অমানবিক পরিস্থিতি একটা পরিকল্পিত ও কাঠামোগত সন্ত্রাস। যার সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও সরকারগুলো জড়িত। ...কিছুটা চমকে গেলাম। এমন গভীরভাবে তো কখনও ভাবিনি।
লেখাটি পড়ে সাংবাদিকতার কিছু জনশ্রুতির কথা মনে পড়ছে। দেশের আধুনিক ধারার সাংবাদিকতার জনক হিসেবে পরিচিত বিরাট মাপের এক সম্পাদক সম্পর্কে কথিত আছে, তিনি নাকি মফস্বল সাংবাদিকতায় চাঁদাবাজিরও জনক। জেলায় জেলায় তিনি রিপোর্টাদের অফিস করার সুযোগ দিতেন। সেই অফিস থেকে যা কামায় হতো তার ফিফটি ফিফটি নিতেন।
আরেক প্রবলমাপের দেশীয় গদিসম্পাদক নিজেকে নিউইয়র্ক টাইমসের সম্পাদক ভাবতেন। তিনি নাকি ঢাকার বাইরে যত ইভেন্ট করতেন সব মফস্বল প্রতিনিধিদের টাকায়। কেউ গোস্ত কিনে দিতেন। কেউ র্যাফেল ড্রর পুরস্কার সংগ্রহ করে দিতেন। কেউ আবার কোনো রিসোর্ট ভাড়া করে দিতেন। বছর শেষে মফস্বল প্রতিনিধিরা বিজ্ঞাপনের যে কমিশন পেতেন তার ওপরও নাকি ভাগ বসাতেন।
বহু জনপ্রিয় পত্রিকার ফাউন্ডার দাবিদার এক বিশাল সম্পাদক নাকি নিজের বেতন ধরেন সাড়ে তিন থেকে চার লাখ টাকা। আর নিজের হাউজের রিপোর্টার-সহ-সম্পাদকদের বেতন ধরেন ১০-১৫ হাজার টাকা। মফস্বলে ৬৪ জেলার মধ্যে ১৫ জেলায় দয়াপরবশ হয়ে দেন ১ থেকে দেড় হাজার টাকা করে!
বিগ বাজেটের কোনো হাউজ খুলতে গেলেই যার ডাক পড়ে, তেমন এক বাঘা সম্পাদক নাকি গণমাধ্যমের পিপি (প্রজেক্ট প্রোফাইল) জমা দেওয়ার আগেই নিজের একাউন্টে এক দেড় কোটি ঢুকিয়ে নিতেন। এরা নাকি পিপিতে টোটাল স্যালারি শিটে মফস্বলে বরাদ্দ রাখেন নামমাত্র ৫-১৫ শতাংশ। ঢাকা অফিসে দেন ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা। আর মফস্বলে দয়া করে দেন ৫-১০ হাজার।
গজিয়ে ওঠা অনেক সম্পাদককে দেখা যায় সুশাসন আর গণতন্ত্রের বদলে গণমাধ্যমকে রাজনৈতিক নীতি-আদর্শ প্রচারের ভাগার বানাতে উদগ্রীব। এরা সামন্তযুগের ‘জি জাহাপনা মার্কা’ রাজকবিদের মতো। ‘প্রশ্ন নয়, প্রশংসা করতে এসেছি’ প্রজেক্টের উদ্যোক্তা হওয়ায় এদের গণ্ডি শুধুই রাজসভা (সচিবালয়)। যে কারণে মফস্বলে ফ্রি সার্ভিস চায় তারা।
বিনিয়োগকারী বেশিরভাগ মালিকপক্ষই এখন অন্য গণমাধ্যমের আগ্রাসন ঠেকাতে নিজেদের গণমাধ্যম হাউজ তৈরির জন্য দাগি সম্পাদক-সাংবাদিকদের ভাড়া করেন। কিছু না দেখেই ব্র্যান্ড সম্পাদকদের পিপি পাস করে দেয় তারা। আর সম্পাদকেরাও এখন আর মোনাজাত উদ্দিনদের খোঁজেন না। তারা মফস্বলে দলদাস, চাঁদাবাজদের সন্ধান করতে চান। যারা বেতন চান না, চান স্বীকৃতি।
মফস্বলে বেতন বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করতে পারতেন বিভাগ আর জেলা সাংবাদিকদের ভোটে নির্বাচিত ঢাকার ইউনিয়ন নেতারা। কিন্তু তারা তো অধিকাংশই অখ্যাত পত্র-পত্রিকার কর্মী। যারা নিজেরাই ভালো বেতন পান না (বাসস, বিটিভি ব্যতীত)। তাছাড়া তাদের বেশিরভাগই রাজনৈতিক সাংবাদিক, সরলভাষায় দলদাস। সরকার বা মালিকপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করার মতো মেরুদণ্ড তাদের থাকে না।
নগণ্য এক সংবাদকর্মী হিসেবে কয়েকটি হাউজে গিয়ে দেখেছি, মফস্বলে কম বেতন দেওয়ার ক্ষেত্রে যতটা না দায়ি মালিকপক্ষ, তারচেয়ে বেশি দায়ি সংবাদ ব্যবস্থাপকদের সংকীর্ণতা। এরমধ্যে রয়েছে প্রবলরকম শ্রেণীচরিত্র। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় পাস করা কিংবা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বেশিরভাগ সাংবাদিকই হীনমন্যতায় ভোগেন। মফস্বলে কম বেতন দেওয়াটাকে তাই তারা উপভোগ করেন!
(বেতন বৈষম্য: ১ মে, ২০২৫। এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা)
লেখক : সাংবাদিক