দৃষ্টিপাত
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : নক্ষত্রের মতো উচ্চারিত তিনি
প্রকাশ: ০৮ মে ২০২৫, ১৯:৪০

আজ পঁচিশে বৈশাখ—বাংলা সাহিত্যের অমূল্য রত্ন, আমাদের জাতীয় চেতনার প্রধানতম রূপকার, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। ১২৬৮ বঙ্গাব্দের এই দিনে (৭ মে, ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দ) কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন এই অনন্য প্রতিভা মানুষ, যাঁর স্পর্শে বাংলা সাহিত্য পেয়েছিল এক নতুন রূপ, নতুন প্রাণ।
রবীন্দ্রনাথ কেবল কবি ছিলেন না, ছিলেন এক বিপুল বোধের বহ্নিশিখা। তাঁর চরণে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি অর্জন করেছে অনন্য উচ্চতা, পেয়েছে নান্দনিকতা ও বুদ্ধিদীপ্ততার স্বরূপ।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য শুধু একটি ভাষার গৌরব নয়, বরং একটি জাতির চেতনা। তাঁর কাব্যে, গল্পে, নাটকে, প্রবন্ধে, চিত্রে, গানে—প্রতিটি রচনায় ধ্বনিত হয়েছে মানুষের মুক্তি, সমাজের বিবর্তন, অস্তিত্বের সন্ধান, প্রেম ও প্রকৃতির নিবিড় সংলাপ।
তিনি বাংলা ছোটগল্পের জনক, আধুনিক কবিতার রূপকার। ‘সমাপ্তি’ গল্পে জীবনের নীরব উত্তরণ, ‘পোস্টমাস্টার’-এ সম্পর্কের গভীর অথচ অস্পষ্ট বিষণ্নতা—গল্পে ফুটে ওঠে দার্শনিক সংবেদনা।
কবিতায় রবীন্দ্রনাথ যেন সময়েরও ঊর্ধ্বে। তিনি একাধারে কান্তার প্রেমিক, মহাজাগতিক আত্মার সন্ধানী। ‘আমি যে তোমায় জানি, সে তো কেউ জানে না।/ তুমি মোর পানে চাও, সে তো কেউ মানে না।’—এইভাবে আত্মত্যাগে প্রেমকে মহিমাময় করেন। আবার কখনও বলেন, ‘যে আছে মাটির কাছাকাছি / সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি।’—মানবিক নিঃস্বতার মধ্যেও দেখেন ঈশ্বরের অনুগ্রহ।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে স্বাধীনতার গভীর বোধ আছে, আছে শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে জাগরণের ঘোষণা। তাঁর অমর পঙ্ক্তি—
‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া, / বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া।’ কিংবা ‘দুর্বলেরে রক্ষা করো, দুর্জনেরে হানো, / নিজেরে দীন নিঃসহায় যেন কভু না জানো’ এ যেন জাতির আধ্যাত্মিক ও সামাজিক মুক্তির আহ্বান।
পরাধীনতার পরিপ্রেক্ষিতে লিখেছিলেন ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’, যেখানে তিনি কল্পনা করেছিলেন এমন এক স্বদেশ—যেখানে মানুষ স্বাধীন, যুক্তি উন্মুক্ত, ভাষা সত্যনিষ্ঠ। এই কল্পনা ছিল এক নবজাত রাষ্ট্রচিন্তার বীজ। তিনি লিখেছেন, ‘সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান। / সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ। / মুক্ত করো ভয়, আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।’
তিনি বলেন, ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে / কখন আপনি তুমি / এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী!’ এই অনুভব আমাদের জাতীয় সত্তার উৎসস্থল।
রবীন্দ্রসাহিত্য, বিশেষত রবীন্দ্রসংগীত শক্তি-উৎস হয়ে উঠেছিল ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে। তাঁর গান মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জুগিয়েছে, প্রেরণা দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর তাঁর ‘আমার সোনার বাংলা’ তাই স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ কেবল সাহিত্যিক ছিলেন না; তিনি ছিলেন এক দার্শনিক চেতনার নির্মাতা। তাঁর ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে যেমন আছে পাশ্চাত্য উপনিবেশবাদী লালসার বিরুদ্ধে কঠিন সমালোচনা, তেমনি ‘ধর্ম ও মানবতা’ প্রবন্ধে আছে অসাম্প্রদায়িক, উদারতাবাদী মানবধর্মের বার্তা।
তিনি ছিলেন এক পরিপূর্ণ শিল্পমানব—গান রচনা করেছেন দুই হাজারের বেশি, সুর দিয়েছেন, গেয়েছেন। ছিলেন আঁকিয়েও। বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি শিক্ষা ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন রচনা করলেন।
আজও প্রতিটি সংকটে, প্রতিটি অনিশ্চয়তায়, তাঁর লেখা আমাদের শক্তি জোগায়। রবীন্দ্রনাথ আছেন—নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল ও চিরস্থায়ী প্রত্যয় আর সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি হয়ে, আমাদের সমস্ত অনিবার্যতায়। তিনি সময়-কালের ঊর্ধ্বে। তিনি মানুষের হৃদয়ে, চিন্তায়, সংস্কৃতিতে উচ্চারিত হতে থাকেন—প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে।
এই মহান স্রষ্টার জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে নিজেদেরও নতুন করে নির্মাণের অনুপ্রেরণা নিই।
মেহেদী হাসান শোয়েব : লেখক, প্রকাশক, বিতার্কিক; শিফট ইনচার্জ, বাংলাদেশের খবর
- বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bkeditorial247@gmail.com