-6821e336b0c50.jpg)
আজ ১২ মে, আন্তর্জাতিক নার্স দিবস। মানবসেবার মহান ব্রত নিয়ে যারা মানুষের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের সম্মান জানাতেই বিশ্বব্যাপী দিনটি পালিত হয়। বাংলাদেশেও দিবসটি নানা আয়োজনে পালিত হলেও দেশের নার্সদের পেশাগত অবস্থান ও বাস্তবতা এখনও খুব একটা আশানুরূপ নয়। নানা বৈষম্য, অবমূল্যায়ন ও সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়েই দেশের হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্বপূর্ণ এই পেশাজীবীরা কাজ করে যাচ্ছেন।
সমাজের প্রতি নার্সদের অবদান ও মানুষের সেবায় যেভাবে তারা কাজ করেন তা সবার সামনে তুলে ধরতে এ দিনটি পালন করে বিশ্ব। আধুনিক নার্সিং পেশার রূপকার ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের জন্মদিন উপলক্ষ্যে এ দিবস পালন শুরু হয়।
বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন (বিএনএ) ১৯৭৪ সাল থেকে বাংলাদেশে দিবসটি পালন করে আসছে। অতীতে ঢাকায় স্বল্প পরিসরে দিবসটি পালিত হলেও বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন ইনস্টিটিউশনে দিবসটি উদযাপন করা হচ্ছে।
বছর নার্স দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় শক্তিশালী নার্স নেতৃত্বের বিকল্প নেই- বিশ্ব স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে নার্সিং খাতে বিনিয়োগ বাড়ান ও নার্সদের অধিকার সংরক্ষণ করুন।
নার্সিং এমন একটি পেশা যা সাধারণ জনগণের স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত। এ পেশার মাধ্যমে ব্যক্তিগত, পারিবারিক কিংবা সামাজিকভাবে কোনো রোগী বা ব্যক্তির স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার এবং জীবনযাত্রার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। এ পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত, দক্ষ কিংবা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি নার্স বা সেবিকা নামে পরিচিত। সাধারণত নারীরাই নার্সিং পেশায় বেশি জড়িত থাকেন। তবে এখন অনেক পুরুষও এ পেশায় যুক্ত হচ্ছেন।
বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদফতরের মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে রেজিস্টার্ড নার্স আছেন ৭৬ হাজার ৫১৭ জন। আর মিডওয়াইফ আছেন ছয় হাজার ২৮৫ জন। এর মধ্যে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন ৪২ হাজারের বেশি নার্স ও মিডওয়াইফ। এ ছাড়াও বেসরকারিভাবে কাজ করছেন ৩০ হাজার।
বাংলাদেশে নার্সিং বিভাগের প্রধান সমস্যা হলো জনবল সংকট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, একজন নার্সের জন্য সর্বোচ্চ ৫-৬ জন রোগীর সেবা দেওয়ার মানদণ্ড নির্ধারণ করা হলেও বাস্তবে দেখা যায়, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে একজন নার্সকে ১৫-২০ জন রোগীর দায়িত্ব পালন করতে হয়। ফলে সেবার মান কমে যায় এবং নার্সদের শারীরিক-মানসিক চাপ অনেক বেড়ে যায়। অনেক সময় রাতদিন ডিউটি করতে গিয়ে তারা পরিবার ও ব্যক্তিগত জীবনেও উপেক্ষিত থাকেন।
নার্সদের বৈষম্য নিয়ে সর্বশেষ কর্মসূচি
পাঁচ দফা দাবিতে টানা সাতদিন ধরে সারাদেশের সরকারি-বেসরকারি নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে যাচ্ছেন। চলমান এই আন্দোলনের অংশ হিসেবে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।
একইসঙ্গে বুধবার (৭ মে) বরিশাল নার্সিং কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে রাজধানীর শেরে বাংলা নগরের নার্সিং কলেজ প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছেন ঢাকাস্থ শিক্ষার্থীরা।
ঢাকা নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থী মো. আবুল হোসেন ইমন গণমাধ্যমকে জানান, বর্তমানে দেশের ৩২টি সরকারি ও ১৫৪টি বেসরকারি নার্সিং কলেজের চার বছর মেয়াদি স্নাতক ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থীরা একযোগে এই কর্মসূচি পালন করছেন।
তাদের পাঁচ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নীতিমালা অনুসরণ করে নার্সিং কলেজে শিক্ষকদের নিয়োগ, স্নাতক ডিগ্রিধারী নার্সদের নবম গ্রেডে সরাসরি নিয়োগ, সংযুক্ত ডিপ্লোমাধারী নার্সদের নিজ নিজ কর্মস্থলে প্রত্যাবর্তন, ইন্টার্ন নার্সদের ভাতা ২০ হাজার টাকায় উন্নীতকরণ, ডিপ্লোমা ডিগ্রির পরিবর্তে তিন বছর মেয়াদি স্নাতক ডিগ্রির প্রবর্তন এবং বেসরকারি নার্সিং কলেজগুলোর জন্য টিউশন ফি ও শিক্ষকদের ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, বরিশাল নার্সিং কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় তারা গভীর উদ্বিগ্ন। এই ঘটনার প্রতিবাদে ঢাকার পাশাপাশি সারাদেশের নার্সিং কলেজগুলোতে বিক্ষোভ চলছে। কর্মসূচির অংশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে ২৪ ঘণ্টার সময়সীমা দিয়ে দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্মারকলিপি পেশ করা হবে।
এছাড়া, আন্দোলন চলাকালীন নতুন কোনো ভর্তি কার্যক্রম না চালানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলেও সরাসরি জানিয়ে দিয়েছেন তারা।
বেতন-ভাতার ক্ষেত্রেও নার্সদের অবস্থান খুব একটা উন্নত নয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানে বেতন কাঠামো থাকলেও তা যথেষ্ট নয়। বেসরকারি হাসপাতালে নার্সদের অবস্থা আরও শোচনীয়। অনেক প্রতিষ্ঠানেই কম বেতন, অনিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। পদোন্নতির সুযোগ সীমিত, পেশাগত উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও সুযোগ নেই। অনেক সময় প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণেও নার্সদের মতামত নেওয়া হয় না। এতে কর্মক্ষেত্রে এক ধরনের হতাশা ও অবমূল্যায়নের অনুভূতি জন্ম নেয়।
নার্সদের সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রেও এখনো কিছু নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান। অনেক সময় তাদের পেশাকে হেয় করে দেখা হয়। অথচ একজন নার্স রোগীর সুস্থতার জন্য দিন-রাত সেবা দিয়ে থাকেন। চিকিৎসকের পর রোগীর সবচেয়ে কাছের সঙ্গী হিসেবে একজন নার্সই সব সময় পাশে থাকেন।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন স্বচ্ছ ও যুগোপযোগী নীতিমালা, পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, কর্মপরিবেশের উন্নয়ন এবং নার্সদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন প্রয়োজন। নার্সিং পেশাকে সম্মানজনক ও মানবিক দায়িত্ব হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আন্তর্জাতিক নার্স দিবসের এই দিনে দেশের নার্সদের অধিকার, মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী, সহসম্পাদক বাংলাদেশের খবর
- বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bkeditorial247@gmail.com
এমএইচএস