ভারত-পাকিস্তান : শান্তির পতাকা বনাম মারণাস্ত্রের ঝনঝনানি
প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৫, ১৪:২৮
-681f31b0b6db9[1]-682848c1db881.jpg)
প্রতীকী ছবি
১৯৪৭ সালের আগস্ট মাস। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন অবসানের মাধ্যমে জন্ম নেয় দুটি রাষ্ট্র— ভারত ও পাকিস্তান। জন্মের পরপরই দেশ দুটি কাশ্মীর নামক ভূখণ্ডকে কেন্দ্র করে ‘ছিনতাইয়ের রাজনীতিতে’ জড়িয়ে পড়ে। জড়িয়ে যায় যুদ্ধে। তখন থেকেই শুরু এক দীর্ঘকালীন শত্রুতার, যার রেশ আজও বয়ে চলেছে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি, অর্থনীতি, সামরিক নীতি এমনকি নাগরিক জীবন।
প্রথম যুদ্ধের (১৯৪৭–৪৮) পেছনে মূলত ছিল জম্মু-কাশ্মীরের ভারতভুক্তি প্রশ্নে মতবিরোধ। পাকিস্তানের যুক্তি ছিল— মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের মানুষ তাদের দেশ হিসেবে পাকিস্তানকে চায়। তাদের ইচ্ছা অনুসারে কাশ্মীর হোক তাই পাকিস্তানের। ভারত তা অগ্রাহ্য করে সেনা মোতায়েন করে এবং জম্মু-কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিংয়ের ‘instrument of accession’ অনুযায়ী ভূখণ্ড দখল করে নেয়। যুদ্ধের পর জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে যে যুদ্ধবিরতি হয়, তা মূল সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান দেয়নি। বরং রেখে যায় একটি ‘লাইন অব কন্ট্রোল’— যা বিভাজনকেও স্থায়ী করে তোলে।
পরবর্তী দশকগুলোতে শত্রুতা নতুন নতুন রূপ নেয়। ১৯৬৫ সালের দ্বিতীয় যুদ্ধ শুরু হয় পাকিস্তানের ‘অপারেশন জিব্রাল্টার’ দিয়ে, যেখানে পাকিস্তানি বাহিনী কাশ্মীরে গোপনে অনুপ্রবেশ করে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ উসকে দিতে চায়। প্রতিক্রিয়ায় ভারত পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ শুরু করে। যুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত হয় তাসখন্দ চুক্তি। যদিও তা কোনো নিরপেক্ষ সমাধান নয়, বরং ছিল সাময়িক বিরতি।
১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধ আরেকটি টার্নিং পয়েন্ট। এই যুদ্ধ প্রমাণ করে— শান্তি আলোচনা ও পারমাণবিক শক্তির অস্তিত্ব সত্ত্বেও সামরিক সংঘর্ষ বন্ধ হয়নি। কারগিল যুদ্ধের মূল প্রেক্ষাপট ছিল পাকিস্তানের উচ্চভূমিতে অনুপ্রবেশ ও ভারতের প্রবল সামরিক প্রতিক্রিয়া। যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সমাজ ভারতের পক্ষে দাঁড়ালেও, পাকিস্তানে এর প্রতিক্রিয়া ছিল— ভারত কূটনীতিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সমঝোতা এড়িয়ে চলেছে।
এই পটভূমিতে ২০২৫ সালের সাম্প্রতিক উত্তেজনা ছিল সময়েরই দাবি। কাশ্মীরে ভারতের ‘নয়া নিরাপত্তা নীতি’র আওতায় আধাসামরিক বাহিনীর নজিরবিহীন মোতায়েন, সন্দেহভাজনদের গুম, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং স্থানীয় রাজনীতিবিদদের দমন-পীড়ন কেবল স্থানীয় জনতার নয়, গোটা অঞ্চলের আস্থা বিনষ্ট করে। পাকিস্তান যখন এই নিপীড়নের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক আওয়াজ তোলে, ভারত তা অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে চিহ্নিত করে আন্তর্জাতিক আলাপ এড়িয়ে চলে।
২০২৫ সালের মার্চে সীমান্তে এক ‘ঘটনাকে’ কেন্দ্র করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। উভয় পক্ষের সীমান্ত বাহিনী গুলি বিনিময়ে জড়ায়, পরে সেটি রূপ নেয় ড্রোন হামলা, সাইবার আক্রমণ ও কূটনৈতিক সম্পর্ক হ্রাসের দিকে। ভারতের পক্ষ থেকে ‘প্রতিরক্ষার’ দাবি এলেও, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ বলেছে—কাশ্মীরের জনগণের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। তুরস্ক, মালয়েশিয়া ও ওআইসি প্রকাশ্যে পাকিস্তানের অবস্থান সমর্থন করে। জাতিসংঘে পাকিস্তান ইস্যুটি তুললেও ভারত ‘সার্বভৌমত্ব’ অজুহাতে তা ধামাচাপা দেয়।
অবশেষে চীন ও সৌদি আরবের উদ্যোগে শুরু হয় একাধিক দফা শান্তি আলোচনা। যুক্ত হয় কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতও। ফলাফল—‘ইসলামাবাদ শান্তি সমঝোতা ২০২৫’। চুক্তিতে দুই পক্ষই সীমান্তে সেনা মোতায়েন কমাতে সম্মত হয়, কাশ্মীর নিয়ে ‘দ্বিপক্ষীয় আলোচনার দরজা’ খুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ মিশন গ্রহণে অনির্ধারিতভাবে সম্মত হয়।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়— এ চুক্তি কি স্থায়ী শান্তির ভিত্তি গড়বে, নাকি কেবল কৌশলগত বিরতি মাত্র? ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক বলয়ের মধ্যে ‘কঠোর জাতীয়তাবাদ’ ও সামরিক আধিপত্যের যে প্রবণতা, তা পরিবর্তন না হলে ভবিষ্যতের সংকট অনিবার্য। পাকিস্তানে শান্তিবাদী কণ্ঠ যতই জোরালো হোক না কেন, বাস্তবতা বলছে—ভারত শান্তির টেবিলে এলেও সমতার ভিত্তিতে নয়, বরং আধিপত্যের মনোভাব নিয়ে আসে।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি অনেকটাই নির্ভর করছে ভারতের ভেতরের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের ওপর। আর পাকিস্তানের জন্য এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন— অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বজায় রেখে আন্তর্জাতিক সমর্থন পোক্ত করা।
এমন প্রেক্ষাপটে মেহেরত শাহের একটি কথাই মনে পড়ে— ‘When the powerful deny justice, the weak must turn diplomacy into resistance.’
কাশ্মীর ইস্যু কেবল একটি ভূখণ্ডের প্রশ্ন নয়, এটি দক্ষিণ এশিয়ার আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন। আর সেটির সমাধান কেবল বন্দুক নয়, ন্যায়ের ভিত্তিতে হতে পারে। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইতিহাস যতবার রক্তে রাঙিয়েছে এই অঞ্চলকে, শান্তি ততবার ফিরেছে সাময়িকভাবে, স্থায়ীভাবে নয়। তাই ২০২৫ সালের শান্তি চুক্তিও শেষ কথা নয়— এটি শুরু, যদি তা সহানুভূতি, সমতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার ভিত্তিতে বাস্তবায়িত হয়।