
‘একটি জীবন কাটাতে মানুষের কত টাকা প্রয়োজন?’- প্রশ্নটি শুনতে সহজ, কিন্তু এর উত্তর জটিল। এটি কেবল অর্থনৈতিক হিসাব নয়, বরং মানসিকতা, মূল্যবোধ, সমাজব্যবস্থা এবং জীবনের দর্শনের প্রশ্ন। এমন এক সময়ে, যখন উন্নয়ন আর সফলতার মাপকাঠি হয়ে উঠেছে আয় এবং ভোগ, তখন এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টাই এক ধরনের নীরব বিদ্রোহ।
ছোটবেলায় আমাদের শেখানো হয়, ভালো করে লেখাপড়া করো, একটা ভালো চাকরি বা ব্যবসা করো, টাকা উপার্জন করো এবং নিরাপদ জীবন যাপন করো। এই ‘নিরাপদ জীবন’ এর সংজ্ঞার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে খরচ, চাহিদা এবং ‘প্রয়োজন’ নামের এক ধরনের সমাজ নির্ধারিত ফ্রেমওয়ার্ক। অথচ বাস্তবে, সেই প্রয়োজনের কোনো শেষ নেই। আজ যা স্বপ্ন, কাল তা অভ্যাস। আজকের বিলাস, কালকের প্রয়োজন।
আমরা যদি সরলভাবে হিসাব করি, শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্য, বাসস্থান ও যাতায়াত, এই পাঁচটি মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে একটি মানুষের জীবদ্দশায় কত টাকা প্রয়োজন, তাহলে হয়তো একটি নির্দিষ্ট অঙ্ক বের করা সম্ভব। সেই অঙ্কের পরিমাণ আবার অনেক কমে যায়, যখন পরিবারের সবাই একসাথে বসবাস করে।
কিন্তু হিসাব কাগজে কলমে সঠিক থাকলেও, বাস্তবে কখনোই ঠিক থাকে না। কারণ, চাহিদা বাড়ে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খরচ বাড়ে, এবং বাজারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের চাওয়ার সংজ্ঞা বদলে যায়। একজন ধনী মানুষও ভাবেন, আরো টাকা দরকার। মধ্যবিত্ত ভাবেন, একটু বাড়তি হলে জীবনটা সহজ হতো। গরিব মানুষ ভাবেন, ন্যূনতম নিশ্চয়তা পেলেই চলবে। এই যে ‘আরো চাই’, এটাই হয়তো সবচেয়ে ব্যয়বহুল অভ্যাস।
এ প্রসঙ্গে এক অর্থনীতিবিদের দারুণ একটি উক্তি রয়েছে ‘টাকার প্রয়োজন শেষ হয়, লোভের শেষ নেই।’ বাস্তবে আমরা দেখি, একজন মানুষ হয়তো জীবনে ৫ কোটি টাকা উপার্জন করেন, কিন্তু শান্তি পান না। অন্যদিকে কেউ হয়তো সারা জীবনে ২০ লাখ টাকাও আয় করতে পারেন না, কিন্তু তার ঘুম গভীর। তাহলে টাকার পরিমাণ নয়, বরং টাকার ব্যবস্থাপনা, চাহিদার নিয়ন্ত্রণ এবং জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিই মানুষকে শান্তি দেয়।
আবার বিষয়টি একেবারেই ব্যক্তিভেদে ভিন্ন। গ্রামে বসবাসরত একজন কৃষকের প্রয়োজন আর শহরের করপোরেট দুনিয়ায় কাজ করা একজন নির্বাহীর প্রয়োজন এক হতে পারে না। একজনের জন্য ৫০ হাজার টাকাই পর্যাপ্ত, আরেকজনের জন্য মাসে ৫ লাখও অপ্রতুল। কিন্তু যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, ‘একটা সম্মানজনক, স্বাস্থ্যকর, মর্যাদাপূর্ণ ও দুশ্চিন্তাহীন জীবনযাপনের জন্য কত টাকা লাগে?’ তাহলে আমাদের আলোচনার গতি পাল্টে যায়।
এখানে আসল প্রশ্নটা হয়তো টাকা নয়, বরং ‘নিরাপত্তা’। মানুষ আসলে টাকা চায় না, মানুষ চায় নির্ঝঞ্ঝাট জীবন, ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা, সন্তানদের শিক্ষার ব্যবস্থা, চিকিৎসার সহজলভ্যতা, এবং বার্ধক্যে নির্ভরতাহীনতা। কিন্তু এই সবকিছুর প্রতীক হয়ে ওঠে আবার ‘টাকা’।
উন্নত দেশগুলোতে যেখানে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, বেকার ভাতা, অবসরকালীন ভাতা রাষ্ট্রের দায়িত্ব, সেখানে নাগরিকদের জীবনের চাহিদা তুলনামূলকভাবে কম হয়। সেখানে টাকা উপার্জনের চেয়ে সময় উপভোগ করাটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে যেখানে প্রতিটি সেবা কিনে নিতে হয়, সেখানে জীবনটাই এক ব্যবসায়ে পরিণত হয়।
এক জীবনে মানুষের আসলে কত টাকা প্রয়োজন, তার নির্দিষ্ট কোনো উত্তর নেই। কারণ, জীবন কেবল হিসাবের নয়, অনুভবেরও। টাকা প্রয়োজন, সন্দেহ নেই। কিন্তু জীবনের মানে যদি কেবল টাকা হয়ে দাঁড়ায়, তবে মানুষ জীবনের আসল সৌন্দর্যটাই হারিয়ে ফেলে।
লেখক : যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক