-682d7cc5bf837.jpg)
২১ মে জাতীয় চা দিবস। ১৮৫৭ সালের এই দিনে সিলেটের মালনিছড়ায় দেশের প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দীর্ঘ দেড় শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এই চা শিল্প শুধু অর্থনীতিতে অবদান রাখেনি, বরং দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যেরও এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। অথচ এই শিল্পের মূল চালিকাশক্তি -চা শ্রমিকদের জীবনযাত্রা আজও রয়ে গেছে উপেক্ষিত, অবহেলিত ও বঞ্চিত।
বর্তমানে দেশের ১৬৭টির বেশি চা বাগানে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার নিবন্ধিত শ্রমিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে আরও অর্ধলাখের বেশি শ্রমিক কাজ করছেন। এই শ্রমিকদের অধিকাংশই ভারতীয় উপমহাদেশের ঔপনিবেশিক আমলে আসা তামিল, তেলেগু, ওড়িয়া, সাঁওতাল, মুণ্ডা, গোণ্ড সম্প্রদায়ের বংশধর। ব্রিটিশ শাসকরা এসব জনগোষ্ঠীকে চা বাগানে কাজের জন্য নিয়ে আসে। সে সময় শ্রমিকদের জীবন ছিল শোষণ, অবহেলা আর দারিদ্র্যে ভরা। দুঃখজনকভাবে, স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও সেই চিত্রের খুব বেশি পরিবর্তন ঘটেনি।
চা শ্রমিকদের প্রধান সমস্যা তাদের মজুরি। বর্তমানে দৈনিক মজুরি ১৭০ টাকা। অথচ শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের দাবি দৈনিক ৩০০ টাকা। ২০১০ সালে তৎকালীন সরকার শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আশ্বাস দেয়। ২০১৫ সালে আবার আলোচনায় আসে বিষয়টি। অবশেষে ২০১৯ সালে দৈনিক ১২০ টাকা নির্ধারণ করা হলেও বাজারদরের তুলনায় তা ছিল অপ্রতুল। ২০২২ সালের আগস্টে শ্রমিকরা বড় আন্দোলনে নামেন। ৩০০ টাকা মজুরি দাবিতে কয়েকদিন পুরো চা শিল্প কার্যত অচল হয়ে পড়ে। তখন সরকারের হস্তক্ষেপে ১৭০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। যদিও শ্রমিকদের মতে, এই মজুরিতেও তাদের সংসার চলে না।
শুধু বেতন নয়, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, মাতৃত্বকালীন সুবিধা, বিশুদ্ধ পানি, পাকা রাস্তা ও নিরাপদ পরিবেশ-সবকিছুতেই চা শ্রমিকরা অবহেলার শিকার। অধিকাংশ বাগানপাড়ার ঘর অস্বাস্থ্যকর ও জরাজীর্ণ। অধিকাংশ এলাকায় নেই মানসম্পন্ন স্কুল বা হাসপাতাল। শিশুদের স্কুলে যাওয়া দূরের কথা, অনেক এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষার সুবিধাও নেই। অধিকাংশ নারী শ্রমিক মাতৃত্বকালীন ছুটি বা সরকারি সুবিধা পান না।
চা বাগানপাড়ায় এক ধরনের অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জীবনযাপন করতে হয় শ্রমিকদের। বাগান কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া বাইরে কাজ করা যায় না। সরকারি নাগরিক সুবিধাও অনেক ক্ষেত্রে তাদের নাগালে আসে না। বেশিরভাগ শ্রমিক পরিবারের বাসভবন কাঁচাঘর। স্বাস্থ্যঝুঁকি, পানির সংকট, টয়লেট সব মিলিয়ে মানবেতর অবস্থা।
প্রতিবছর চা দিবসে সরকার উন্নয়ন পরিকল্পনা ও নীতিমালার কথা বলে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ চা বোর্ড ‘চা শিল্পে শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন নীতিমালা’ গ্রহণ করে। কিন্তু বাস্তবতায় এর তেমন কার্যকর প্রভাব পড়েনি। ২০২২ সালের আন্দোলনের পর কিছু আশ্বাস মিললেও স্থায়ী সমাধান হয়নি।
চা শিল্পের বাৎসরিক উৎপাদন প্রায় ৯ কোটি কেজি ছাড়িয়েছে। দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানিও বাড়ছে। অথচ এই শিল্পের শ্রমিকরা দিনশেষে যেই জায়গায় দাঁড়িয়ে, তা কেবল হতাশাজনক নয়, অন্যায্যও। অর্থনীতিতে অবদান রাখার পরও শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা হচ্ছে না।
জাতীয় দিবস তখনই অর্থবহ হয়, যখন সংশ্লিষ্ট খাতের মানুষের জীবনমান উন্নত হয়। শুধু মজুরি বৃদ্ধি নয়, শ্রমিকদের জন্য আবাসন প্রকল্প, স্কুলকলেজ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। মাতৃত্বকালীন সুবিধা এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে। শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য উপবৃত্তি চালু করতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, এই শ্রমিকরা কেবল উৎপাদনশীল শ্রমিক নন, তারা এই দেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতির অংশ। তাদের জীবনমান উন্নয়নের দায় আমাদের সবার।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী, সহসম্পাদক, দৈনিক বাংলাদেশের খবর
- বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bkeditorial247@gmail.com
এমএইচএস