Logo

মতামত

সহিংস রাজনীতিতে হারিয়ে যাচ্ছে তরুণদের আস্থা

Icon

তানজিল কাজী

প্রকাশ: ২৭ মে ২০২৫, ১৪:৫০

সহিংস রাজনীতিতে হারিয়ে যাচ্ছে তরুণদের আস্থা

বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে তরুণ প্রজন্ম আজ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। মেধাবীরা যেখানে দেশের চালিকাশক্তি হওয়ার কথা, সেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার কারণে তারা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে— যা এক ভয়াবহ মেধা-শূন্যতার ইঙ্গিত। রাজনীতিতে যোগ্যতার অবমূল্যায়ন, রাজনৈতিক প্রভাব এবং সহিংসতায় তরুণদের স্বপ্ন বেড়া জালে আটকে যাচ্ছে। ছাত্র রাজনীতির নামে নিভে যাচ্ছে অসংখ্য প্রাণ, অথচ তাদের পরিবারের দায়িত্ব কেউ নেয় না।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চরম অস্থিরতা দেশকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই সংকট থেকে উত্তরণে আমাদের প্রয়োজন একটি অংশগ্রহণমূলক, সহনশীল এবং মূল্যবোধভিত্তিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি। কিন্ত এই অবক্ষয় রোধে তরুণ সমাজ কি এগিয়ে আসবে? রাজনীতিকে ভয় না পেয়ে, এটিকে কি আমরা আশার জায়গায় পরিণত করতে পারি? এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের খবরের সঙ্গে কথা বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণরা। মতামত তুলে ধরেছেন তানজিল কাজী— 

রাজনীতি কি তরুণদের জন্য ‘নিরাপদ স্থান’ নয়?
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর তরুণদের জন্য রাজনীতি একটি সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছিল; কিন্তু বাস্তবে তা রূপ নেয়নি। আজও অনেক তরুণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে গিয়ে শারীরিক, মানসিক ও প্রশাসনিক ঝুঁকির মুখে পড়েন। বেশিভাগ ছাত্র সংগঠনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকলেও সিদ্ধান্ত আসে উপর মহল থেকে। ফলে মাঠপর্যায়ের নেতাদের মতামত উপেক্ষিত হয়। অভ্যুত্থানের পর তরুণদের রাজনৈতিক আগ্রহ থাকলেও সংগঠনগুলো তা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে। 

নিরাপত্তাহীনতা, পুরোনো রাজনৈতিক গোঁড়ামি ও দলীয় স্বার্থের আধিপত্য তরুণদের আস্থা ভেঙে দিচ্ছে। রাজনীতিকে ভয় পাচ্ছে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী। আমাদের প্রয়োজন সহিংসতামুক্ত, অংশগ্রহণমূলক, নিচ থেকে নেতৃত্বগঠনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। রাজনীতি যেন ভয় নয়, বরং আশার জায়গা হয়ে ওঠে—এটাই হওয়া উচিত আগামী দিনের লক্ষ্য।

মো. মুহতাসিম ফুয়াদ
কেন্দ্রীয় সংগঠক, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ

রাজনীতি মানেই দুর্নীতি? তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গির বিবর্তন
গ্রিক দার্শনিক প্লেটো তার বই ‘রিপাবলিক’ এ রাজনীতি নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে বলেছেন, রাজনীতি হচ্ছে সেই ব্যবস্থা যেখানে শাসকেরা তাদের জ্ঞান ও গুণাবলীর ভিত্তিতে সমাজে ন্যায়বিচার এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবেন। কিন্তু কালের বিবর্তনে সেই রাজনীতি হয়ে উঠেছে ক্ষমতার অপব্যবহার, অবৈধ অর্থ উপার্জন ও ব্যক্তিগত স্বার্থ সিদ্ধির এক খোলা ময়দান। এসব পর্যবেক্ষণ করে জনসাধারণের মধ্যে ধারণা জন্মেছে যে, রাজনীতি মানেই হয়তো দুর্নীতি।

গণমাধ্যমের মারফত এসব দুর্নীতির খবর যখন তরুণদের সামনে আসে; তখন তারা রাজনীতির প্রতি আস্থা হারাতে বাধ্য হয়। জুলাই বিপ্লবের অন্যতম চাওয়া ছিল এই ঘুনে ধরা বন্দোবস্তের পরিবর্তন। তাই আমাদের দেশে বিদ্যমান সেকেলে সেই ক্ষমতার অপব্যবহার ও বলপ্রয়োগের রাজনীতির ইতি ঘটিয়ে সত্যিকারের রাজনীতির দিকে ফেরার এখনই সময়। যেখানে থাকবে শুধুই ন্যায়-ইনসাফ। থাকবে না কোনো রক্তচক্ষু, হুমকি অথবা প্রাণনাশের কোনো ভয়। 

দেশীয় রাজনীতিতে যদি সঠিক নেতৃত্ব ও নৈতিক মূল্যবোধের চর্চা হয়, তবে তরুণদের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে তৈরি হওয়া নেতিবাচক ধারণা দ্রুত বিদায় নেবে এবং আবারও তারা রাজনীতিকে সমাজ পরিবর্তনের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেবে। তাই শিক্ষিত, জ্ঞানী, উদার, সর্বোপরি সৎ-তরুণ নেতৃত্বের আগমন ঘটুক। দেশে আবার হারিয়ে যাওয়া গণতান্ত্রিক চর্চা প্রাণ ফিরে পাক।

কে. এম. মুহীব্বুল্লাহ
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

রাজনীতিতে তরুণদের সঠিক ভূমিকা প্রয়োজন
রাজনীতির মূল লক্ষ্য জনকল্যাণ, উন্নয়ন ও একটি সচেতন সমাজ গঠন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বর্তমানে রাজনৈতিক অঙ্গনে সহিংসতার যে ভয়াবহ রূপ দেখা যাচ্ছে, তার অন্যতম শিকার আমাদের তরুণ সমাজ। মব জাস্টিসের নামে কিছু ছাত্রনেতার কর্মকাণ্ডে জনমনে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। জনগণের আস্থা হারাচ্ছে তরুণরা। অথচ জুলাই আন্দোলনের মতো ঐতিহাসিক মুহূর্তে নেতৃত্ব দিয়েছিল তারাই। আজ তাদের রাজনীতি থেকে পিছিয়ে পড়া মানে দেশের ভবিষ্যৎ পিছিয়ে পড়া।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সবসময় রাজনৈতিক সহিংসতা ও মবের বিরুদ্ধে। আমরা বিশ্বাস করি, অচিরেই সহিংসতার এই অধ্যায় শেষ হবে এবং তরুণরা আবারও আগামীর বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে।

ছাত্রদল ছাত্রদের অধিকার, সুযোগ, কল্যাণ ও মেধা বিকাশের জন্য কাজ করে। আমরা সকল ছাত্রকে আহ্বান জানাই—এসো, আমাদের সঙ্গে একযোগে কাজ করি ছাত্রদের জন্য, দেশের জন্য।

রাকিবুল হাসান চাঁদ
সভাপতি, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ছাত্রদল

তরুণ সমাজের রাজনৈতিক বিমুখতা : সংকট ও সম্ভাবনা
রাজনীতি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে প্রধান মাধ্যম, অথচ বাংলাদেশের তরুণ সমাজ ক্রমেই রাজনীতি থেকে বিমুখ হচ্ছে। এক সময়ের গৌরবময় ছাত্ররাজনীতি আজ দুর্নীতি, পরিবারতন্ত্র ও সহিংসতায় আচ্ছন্ন। ফলে তরুণরা রাজনীতিকে অবজ্ঞা করছে। ভোট দিতেও আগ্রহী নয়।

এর কারণ হলো আদর্শের অভাব, ছাত্র রাজনীতিতে সহিংসতা এবং নাগরিক শিক্ষার ঘাটতি। এই বিমুখতা নেতৃত্ব সংকট সৃষ্টি করছে; ফলে অযোগ্যদের হাতে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ যাচ্ছে। বাড়ছে বৈষম্য ও দুর্নীতি।

তবে পরিবর্তন সম্ভব। শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক ও নাগরিক শিক্ষা জোরদার করতে হবে, ছাত্ররাজনীতিকে করতে হবে আদর্শিক ও মানবিক। এ ক্ষেত্রে ইসলামী সংগঠনগুলোর জনসেবামূলক কর্মকাণ্ড হতে পারে অনুসরণীয়। সৎসাহসী তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণেই রাজনীতিতে ন্যায় ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব।

মুহাম্মদ আবু রায়হান
এইচআরডি সম্পাদক (সহকারী), বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, গাইবান্ধা জেলা শাখা

রাজনীতিতে তরুণরা অনলাইনে সচেতন, অফলাইনে উদাসীনতা কেন ?
বর্তমানে অনেক তরুণ রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করে অনলাইনে, কিন্তু বাস্তব রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তাদের উপস্থিতি প্রায় অনুপস্থিত। একদিকে যখন অযোগ্য ও লোভী রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেশে স্বৈরাচার কায়েম করে, অন্যদিকে তরুণ সমাজ শুধুই ভার্চুয়াল প্রতিবাদে সীমাবদ্ধ থাকে।

রাজনীতি থেকে তরুণদের দূরে থাকা মানেই অযোগ্যদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া। অথচ তরুণরাই সমাজের প্রাণশক্তি, যাদের হাতে দেশ গড়ার ভবিষ্যৎ। কেবল পোস্ট, রিয়্যাকশন বা হ্যাশট্যাগ নয়, প্রয়োজন বাস্তব রাজপথে সক্রিয় অংশগ্রহণ।

যুগ বদলাতে ঘাম ঝরাতে হয়, ইতিহাস গড়তে লাগে আত্মত্যাগ। তাই রাজনীতির অন্ধকার দূর করতে হলে তরুণদেরই এগিয়ে আসতে হবে। যোগ্যদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে হবে। শুধু অনলাইনে নয়, তরুণদের অফলাইনেও রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি—দেশ বাঁচাতে, ভবিষ্যৎ গড়তে।

এম.এইচ. সুমন
শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর