পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আন্দোলন : বৈষম্যবিরোধী সংগ্রামের বাস্তবচিত্র
প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৫, ১০:৪৪
-683a893adbe82.jpg)
বাংলাদেশের গ্রামীণ বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থায় ‘পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি’ (পবিস) দীর্ঘদিন ধরেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। দেশের ৮০টি সমিতির ৪৫ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী নিরলসভাবে কাজ করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎ সেবা পৌঁছে দিচ্ছেন। অথচ দীর্ঘদিন ধরে এই বিশাল কর্মীবাহিনী বৈষম্য, নিপীড়ন এবং দমন-পীড়নের শিকার। তাদের চাকরি, মর্যাদা, ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা এবং কর্মপরিবেশ আজও স্বাভাবিক হয়নি। সম্প্রতি এই অনিয়ম এবং শোষণমূলক ব্যবস্থা থেকে মুক্তির দাবিতে তারা যে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে, তা নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী এবং যৌক্তিক সংগ্রাম।
মূলত আরইবি (পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড) এবং পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-এই দ্বৈত ব্যবস্থাপনার অসংগতি, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং বৈষম্যমূলক নীতির কারণেই দীর্ঘদিন ধরে মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা বঞ্চিত হয়ে আসছিল। এ সংকট নিরসনে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে আরইবি-পবিস অভিন্ন চাকরিবিধি বাস্তবায়ন এবং জরুরি সেবায় নিয়োজিত সকল চুক্তিভিত্তিক/ অনিয়মিত কর্মীদের স্থায়ীকরণের দাবিতে স্মারকলিপি প্রদানের মাধ্যমে আন্দোলনের সূচনা ঘটে। এরপরেও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় মে ও জুলাই মাসে কর্মবিরতি কর্মসূচি পালন করে সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
সরকার প্রথমে আশ্বাস দিলেও, পরবর্তীতে বিদ্যুৎ বিভাগের একাংশ এবং আরইবির বাধার কারণে গঠিত কমিটির কার্যক্রম বারবার বাধাগ্রস্ত হয়। বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন এবং তিনটি মডেল প্রস্তাব করার পরও চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। এরই মধ্যে আন্দোলনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিনা নোটিশে চাকরিচ্যুতি, মিথ্যা মামলা, গ্রেপ্তার এবং শত শত কর্মীর হয়রানিমূলক বদলি করা হয়। বিশেষ করে যাদের নাম গণস্বাক্ষরিত স্মারকলিপিতে ছিল, তাদের মধ্যে সাতজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
এতৎসত্ত্বেও আন্দোলনকারীরা দায়িত্বশীলতা ও জনস্বার্থের কথা ভেবে বিদ্যুৎ সেবা চালু রেখে শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। গত ২১ মে, ২০২৫ থেকে ৭ দফা দাবিতে নতুন করে আন্দোলন শুরু হয়। এতে মূল দাবি হলো- আরইবি-পবিস দ্বৈত ব্যবস্থাপনা নিরসন, বিদ্যমান চেয়ারম্যানের অপসারণ, চাকরিচ্যুতদের পুনর্বহাল, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং শাস্তিমূলক বদলির আদেশ বাতিল।
উল্লেখযোগ্য বিষয়, এই আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা নয়। বরং এনসিপি শ্রমিক উইংস, ডিপ্লোমা প্রকৌশলী উইংস, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, হেফাজতে ইসলাম, এবি পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, নাগরিক ছাত্র ঐক্য, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইডিইবি, এফডিইবিসহ পেশাজীবী এবং সামাজিক সংগঠন এই ন্যায্য আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছে।
বর্তমানে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ৬৪ দিন ধরে বিদ্যুৎ সেবা স্বাভাবিক রেখে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো দৃশ্যমান সমাধানের উদ্যোগ না নেওয়ায় আন্দোলনকারীরা আগামী ২৭ মে থেকে নতুন কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছেন। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- সারাদেশের ৮০টি সমিতিতে জরুরি বিদ্যুৎ সেবা চালু রেখে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি এবং এমআরসিএমগণের শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ।
এই পরিস্থিতিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, আন্দোলনকারীদের মূল দাবি রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট। কারণ তারা সরাসরি বিদ্যুৎ সেবা বন্ধ না করে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে সেবা অব্যাহত রেখেছেন। একইসাথে একটি বৈষম্যহীন, আধুনিক ও টেকসই বিতরণ ব্যবস্থার দাবি জানিয়ে আসছেন।
এ আন্দোলন নিছক বেতন-ভাতার আন্দোলন নয়; বরং একটি বিকেন্দ্রীকৃত এবং অসুস্থ ব্যবস্থার সংস্কার দাবি। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন অধিক মূল্যবান। এই দক্ষ মানবসম্পদকে উপেক্ষা করলে গ্রামীণ বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়বে।
সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত, সংকট সমাধানে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা। বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ, ৭ দফা যৌক্তিক দাবি বাস্তবায়ন এবং আন্দোলনরত কর্মীদের হয়রানি বন্ধ করা। দেশের বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা ফেরাতে এটি এখন সময়ের দাবি।
এই আন্দোলন প্রমাণ করেছে, শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হলে পরিবর্তন সম্ভব। তাই সরকারের সর্বোচ্চ মহলের উচিত— এই সংকটকে অবহেলা না করে অবিলম্বে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা। নইলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে, যার দায়ভার সরকারকেই নিতে হবে।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী, সহসম্পাদক, দৈনিক বাংলাদেশের খবর
- বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bkeditorial247@gmail.com
এমএইচএস