Logo

মতামত

দৃষ্টিপাত

নিসর্গপুরের কথা

মেহেদী হাসান শোয়েব

মেহেদী হাসান শোয়েব

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৫, ১৭:৪১

নিসর্গপুরের কথা

এআই ব্যবহার করে তৈরি করা ছবি

গ্রামের নাম ছিল নিসর্গপুর। নামেই বোঝা যায়—গ্রাম ঘেরা ছিল অজস্র গাছগাছালি, খালবিল, নদীনালা। দূর থেকে দেখা যেত সবুজ পাহাড়ের ছায়া। সকালবেলা পাখিরা গান গাইত, সন্ধ্যা হলে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক মিলিয়ে যেত গোধূলির আলোর সঙ্গে।

এই গ্রামেই ছিল এক বিশাল বটগাছ, যাকে সবাই ডাকত ‘বট দাদা’। তার শীতল ছায়ায় বসে মানুষ গল্প করত, গানে গানে সন্ধ্যা নামাতো। কিন্তু বট দাদার সবচেয়ে প্রিয় ছিল এক ঝাঁক কিশোর-কিশোরী—ওদের দলের নাম ‘অবুঝ সবুজ কাঁচা’। দলের নেতা বারো-তেরো বছরের ছেলে জোহান। চোখে ছিল দীপ্তি, মুখে সাহস। সঙ্গে থাকত ছয় থেকে চোদ্দ-পনেরো বছরের শ্রাবণী, রেদোয়ান, আদিবা, তরু, নাবিলা, অন্তু, আরিন, সুরাইয়া, আর শুভ। মাঝেমাঝেই গ্রামের অন্য অনেক শিশুকিশোরই ওদের সাথে যোগ দিত।

ওরা প্রতিদিন সকালবেলা বট দাদার সামনে এসে দাঁড়াতো, হাত উঁচিয়ে শপথ করত—‘আমরা প্রতিজ্ঞা করছি, পৃথিবীকে রক্ষা করবো। নিসর্গপুরের প্রাণ ও প্রকৃতিকে রক্ষা করবো। নদী-খাল, গাছ-পাখি, বাতাস-আকাশ—সবই আমাদের প্রাণের জন্য অপরিহার্য। তাই এদের রক্ষা করার দায়িত্বও আমাদের।’

তারপর ওরা ছড়িয়ে পড়ত কাজ করতে—কেউ প্লাস্টিক-পলিথিন কুড়াত, কেউ গাছের পরিচর্যা করত, কেউ আবার স্কুলে গিয়ে গান গেয়ে বোঝাত প্লাস্টিকের ভয়ংকর ক্ষতিকর নানা দিক।

তবে নিসর্গপুরের সবাই যে ওদের কথা শুনতো, তা তো নয়। গ্রামের এক প্রান্তে ছিল রহস্যময় এক কারখানা। নাম ছিল—‘প্লাস্টিকে বহুমুখী সমাধান’। এর মালিক ধূর্ত ও ধনবান মারফত আলী। তার ভাষ্য ছিল, ‘প্লাস্টিক ছাড়া জীবন চলে না। প্লাস্টিক মানেই উন্নয়ন। ব্যাগ, বোতল, মোবাইল, গাড়ি—সবই তো প্লাস্টিক!’

তার সঙ্গে ছিল এক চক্র—তারা গ্রামের বড়দের মগজ ধোলাই করত। ছেলেমেয়েদের ঠাট্টা করে বলত—‘এই পুতুল খেলার দল কি উন্নয়ন বোঝে?’

জোহান তাদের জবাবে বলত—‘উন্নয়ন মানে যদি নদীর স্রোত বন্ধ হয়ে যাওয়া হয়, গাছের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া হয়—তাহলে তা উন্নয়ন নয়, ধ্বংস! আমরা উন্নয়নের নামে এমন ধ্বংস চাই না।’

মারফত আলী একদিন ঘোষণা দিলেন—তিনি আরেকটা প্লাস্টিক উৎপাদন কারখানা বানাবেন নিসর্গপুরের বনের ভেতরে। 

এ কথা জানতে পেরে জোহানের ‘অবুঝ সবুজ কাঁচা’ দলের সবার ভীষণ মন খারাপ হলো। ওরা খুবই চিন্তায় পড়ে গেল। নিজেদের মধ্যে বলা-বলি শুরু করলো যে, ওরা এখন কী করবে? মরফত আলীর তো অনেক ক্ষমতা। তাকে কেমনে ওদের মতো ছোটরা মিলে থামাবে এই গ্রামকে ধ্বংস করার কারখানা বানানো থেকে। 

অন্য দিনের মতোই ওরা মিলিত হয়েছে। একটা কিছু তো করতেই হবে। কেবল নিজেরা নদী খাল বিলের প্লাস্টিক কুড়িয়েই সমাধান হবে না। যে করেই হোক নতুন প্লাস্টিক কারখানা হওয়া বন্ধ করতে হবে। ওরা সবাই কেমন ঝিম ধরে দাঁড়িয়ে আছে গোল হয়ে। ঠিক তখনই বট দাদার কয়েকটা পাতা উড়ে এসে ওদের একেক জনের মাথায় স্পর্শ করে মাটিতে পড়ল। ওদের যেন মনে হলো, বট দাদা বলছে, তোমরা শুধু সচেতনতার কাজ করলেই হবে না এখন। বরং যুদ্ধ করো। এই পৃথিবী শুধু বড়দের নয়, তোমাদেরও। আজ যদি তোমরা না জাগো, তাহলে প্রকৃতি একদিন ভয়ঙ্করভাবে জেগে উঠে প্রতিশোধ নেবে। সেই প্রতিশোধ কেউ সহ্য করতে পারবে না।

বট দাদা যেন ওদের বলল, ‘সবুজকে বাঁচাও’।

ওদের ভেতরে ভেতরে চেতনার বিপ্লব জেগে উঠলো। যেন শুরু হলো এক ‘সবুজ বিপ্লব’। তবে শৃঙ্খলাপূর্ণ এবং নিয়মতান্ত্রিক এ বিপ্লব! 

জোহান ঘোষণা দিল, ‘আমরা কেবল প্রতিবাদ করবো না, আমরা বিকল্প দেখাবো। প্রমাণ করবো—প্লাস্টিক ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব। তোমরা সবাই আইডিয়া দাও।’

সবাই নিজেদের মতো করে আইডিয়া দিল। সেসব মিলিয়ে ওরা ঠিক করলো, ‘আমরা প্লাস্টিক বোতলসহ সবরকম প্লাস্টিক রিসাইকেল করব। স্কুলে স্কুলে সচেতনতা কর্মসূচি চালাবো। গ্রামে গ্রামে পাটের ব্যাগ বিতরণ করবো। বাড়িতে বাড়িতে আমাদের মা, খালামনিদের বলবো, বাড়িতে থাকা অপ্রয়োজনীয় টুকরো কাপড় দিয়ে ব্যাগ বানিয়ে বাবা, মামা, চাচ্চুদের বাজারে যাবার সময় দিয়ে দিতে। যেন কেউ আর পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার না করেন। প্লাস্টিক উৎপাদন বন্ধে জেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত আবেদন দেব। আর প্রজেক্টরের মাধ্যমে গ্রামের হাটে পরিবেশবিষয়ক চলচ্চিত্র দেখাবো।’

‘অবুঝ সবুজ কাঁচা’ দলের সবাই মিলে শুরু করে দিল ওদের অভিযান। ডেকে নিল গ্রামের সব বাড়ির শিশুকিশোরদেরকে। নিসর্গপুরের প্রধান রাস্তায় ওরা বিরাট এক মিছিল করল। সবাই একসাথে স্লোগান দিল, ‘পলিথিন নয়, নিসর্গ চাই—প্লাস্টিকের জায়গা নাই।’

দলটা এখন আর শুধু ‘অবুঝ সবুজ কাঁচা’র রইল না। গ্রামে গ্রামে তৈরি হল শিশুকিশোরদের ছোট ছোট নতুন দল। সবাই মিলে গড়ে উঠলো যেন এক ‘মহা সম্মিলিত অবুঝ সবুজ কাঁচা’ দল।

ওরা আয়োজন করল এক বিশাল উৎসব—নাম দিল ‘নিসর্গ মেলা’। পাপেট নাটক বানালো, নাম—‘পলিথিন দানব’। ‘নদীর চোখে জল’ নামে পথনাটক করলো। বানালো নানারকম সচেতনতামূলক পোস্টার’। মেলায় হাজির হলো আশেপাশের পঞ্চাশ গ্রামের অসংখ্য মানুষ।

ওদের এই আন্দোলনের খবর সরকারের উচ্চ মহল পর্যন্ত পৌঁছাল। সোশ্যাল মিডিয়া কাঁপিয়ে দিল শিশুদের আন্দোলন। দেশের প্রধান গণমাধ্যমগুলোতে শিরোনাম হলো, ‘প্রকৃতির পক্ষে শিশুরা, নিসর্গপুরে সবুজ বিপ্লব।’ দেশবিদেশে নীতি নির্ধারকদের নজরেও পড়লো নিসর্গপুরের ‘অবুঝ সবুজ কাঁচা’ দলের ‘সবুজ বিপ্লব’।

একদিন সকালে বট দাদুর সামনের বড় মাঠে এসে নামলো একটা হেলিকপ্টার। গ্রামের শিশুকিশোরসহ ছেলে-বুড়োরা দৌড়ে এল। হেলিকপ্টার থেকে নেমে এলেন বিদেশি একজন মানুষ। জানা গেল তিনি জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির প্রধান।

তিনি বললেন—‘এ বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে, ‘প্লাস্টিক দূষণ রোধ করুন’। নিসর্গপুরের ‘সবুজ বিপ্লব’ দেখে আমরা এই প্রতিপাদ্য নির্বাচন করেছি। আমরা এমন ‘অবুঝ সবুজ কাঁচা’দের সম্মান জানাতে চাই, যারা সাহসিকতার সাথে পরিবেশ রক্ষার লড়াই করছে। নিসর্গপুরের এই শিশুরা সত্যিকারের বীর যোদ্ধা।’

এরপর প্রশাসন ‘প্লাস্টিকে বহুমুখী সমাধান’ কারখানা বন্ধ করে দিল। নতুন প্লাস্টিক কারখানাও নিষিদ্ধ হলো নিসর্গপুরে। গ্রামে পাটের ব্যাগ তৈরির কারখানা গড়ে উঠল। গাছপালা লাগানোর জন্য সরকারি-বেসরকারি বড় বড় উদ্যোগ নেওয়া হলো। স্কুলে পরিবেশ শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হলো। আর ‘অবুঝ সবুজ কাঁচা দল’ জাতিসংঘ থেকে পেল নতুন এক সম্মান—‘গ্রিন অ্যাওয়ার্ড।’ বা ‘সবুজ পুরস্কার’।

বট দাদার সামনে মিলিত হয়ে জোহান বলল, ‘আমরা এ লড়াইয়ে জিতেছি, কারণ আমরা বিশ্বাস করেছিলাম, পৃথিবীটা শুধু আজকের জন্য নয়। পৃথিবীটা বড়দের যেমন, আমাদেরও তেমন। ভবিষ্যতের জন্যও নিরাপদ হতে হবে এই নিসর্গভূমি। আমাদের নিশ্বাস, আমাদের নদী, আমাদের বন, পাখি—সবই আমাদের দায়িত্ব।’

বট দাদা মৃদু বাতাসে মাথা নাড়ালেন, যেন সম্মতি জানিয়ে আশীর্বাদ করে বললেন, ‘এই লড়াই যেন থেমে না যায় দাদুরা আমার। একদিন আরও আরও নতুন প্রজন্ম আসবে। তারা তোমাদের বিজয়ের গল্প শুনে আরও দূর পর্যন্ত যাবে।’

গল্পটা কাল্পনিক, কিন্তু এর আবেদন বাস্তব। আমাদের সত্য গল্পগুলিতে এরকম সুন্দর সমাধান মেলে না। কিন্তু এই গল্প থেকে আমাদের বুঝে নেওয়ার আছে অনেক কিছু। আমরা কি আমাদের ভবিষ্যতের জন্য পৃথিবীকে রক্ষা করতে চেষ্টা করবো, নাকি যেভাবে ধ্বংসের দিকে নিয়ে চলেছি, সেভাবেই চলতে থাকবো আর বছর বছর পরিবেশ দিবসের আনুষ্ঠানিকতা পালন করে যাবো শুধু। 

উল্লেখ্য, আজ ৫ জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবস। পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) উদ্যোগে ১৯৭৩ সাল থেকে প্রতি বছর এই দিনটি পালন করা হয়ে আসছে। এবারের প্রতিপাদ্য—‘প্লাস্টিক দূষণ রোধ করুন’ (Beat Plastic Pollution)। 

মেহেদী হাসান শোয়েব : লেখক, প্রকাশক, বিতার্কিক; শিফট ইনচার্জ, বাংলাদেশের খবর

  • বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bkeditorial247@gmail.com 
Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর