Logo

মতামত

চামড়ার দাম নির্ধারণ করেই কি সরকারের দায়িত্ব শেষ?

মিরাজুল ইসলাম

মিরাজুল ইসলাম

প্রকাশ: ০৮ জুন ২০২৫, ১০:৫২

চামড়ার দাম নির্ধারণ করেই কি সরকারের দায়িত্ব শেষ?

প্রতিবছর কোরবানির ঈদ ঘিরে দেশের অর্থনীতি এক ধরনের আলাদা গতিশীলতা পায়। এই সময় পশুর হাট, পরিবহন, খাদ্য, ওষুধ, পশুর খাবার এবং চামড়ার বাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে হাজার কোটি টাকার লেনদেন। বিশেষ করে পশুর চামড়া বাংলাদেশের চামড়াশিল্পের অন্যতম কাঁচামাল। এই শিল্প একসময় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ খাত ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, গত কয়েক বছর ধরে এই বাজার চরমভাবে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত। আর এই অনিয়মের দায় নিতে হয় সরকারের সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের।

কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নিয়ে প্রতিবছরই নানা আলোচনা-সমালোচনা হয়। ঈদের আগে দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকারি প্রতিষ্ঠান-তবে সেটির কোনো বাস্তব প্রতিফলন বাজারে দেখা যায় না। মাঠপর্যায়ে গরিব মানুষ, এতিমখানা, মাদ্রাসা, অসহায় জনগোষ্ঠী যারা এই চামড়া বিক্রি করে ন্যূনতম কিছু আয় বা ফান্ড তৈরি করত, তারা বছরের পর বছর ধরে শোষিত হচ্ছে। এ বছরের চিত্রও তার ব্যতিক্রম নয়। ধর্মপ্রাণ মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু কোরবানি করেন এবং সেই পশুর চামড়া গরিবদের হক হিসাবে দান করেন। কিন্তু এই হক কোথায় যাচ্ছে? কে কেঁড়ে নিচ্ছে এই অধিকার? এই প্রশ্ন আজ নতুন নয়, বরং ১৬ বছর ধরে আওয়ামী লীগের শাসনামলে এ প্রশ্ন আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের ব্যবসার আকার প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা, যার প্রায় অর্ধেক আসে বিদেশের বাজার থেকে। তবে, আন্তর্জাতিক মানের সনদ না পাওয়ার কারণে রপ্তানি আয় আশানুরূপ বাড়ছে না। এছাড়া, পরিবেশগত সমস্যা ও কর্মপরিবেশের অভাবও এই খাতের উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করছে ।

সরকার প্রতিবছরই ঢাক-ঢোল পিটিয়ে চামড়ার দাম নির্ধারণ করে। মাঠপর্যায়ে এই দাম কার্যকর করতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তার কোনো হদিস পাওয়া যায় না। মধ্যস্বত্বভোগী ও সিন্ডিকেটের হাতে একেবারে জিম্মি হয়ে পড়েছে পুরো বাজার ব্যবস্থা। চামড়া ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে অর্ধেক বা তারও কম দামে চামড়া কিনে নেয়। কোথাও কোথাও চামড়া বিক্রি না করতে পেরে গরিব মানুষ সেটি রাস্তার পাশে ফেলে দিতে বাধ্য হয়। অথচ এসব চামড়া বিক্রির অর্থ মাদ্রাসা, এতিমখানা এবং অসহায় মানুষের জন্য জরুরি। এই চরম অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরকারের ন্যূনতম কার্যকর ভূমিকা নেই বললেই চলে।

এখানে একটি প্রশ্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ-কেন এমন হচ্ছে? বিশ্ববাজারের কথা বলা হয়, বলা হয় বৈশ্বিক মন্দার কথা। সত্যি বলতে কী, বৈশ্বিক বাজারের ওঠানামা সব সময়ই থাকবে। তার মানে এই নয় যে, দেশের গরিব মানুষের হক থেকে তাদের বঞ্চিত করা হবে। এই বাজার বিশ্ববাজারের সঙ্গে সংযুক্ত থাকলেও স্থানীয় বাজারে ন্যায্য দাম নিশ্চিত করাই সরকারের দায়িত্ব। সরকার যদি চামড়ার সুষ্ঠু সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা না করে-তাহলে এই অর্থনৈতিক সেক্টর দিনে দিনে ধ্বংস হয়ে যাবে এবং ক্ষতির শিকার হবে সমাজের সেই প্রান্তিক মানুষ, যাদের উপর দাঁড়িয়ে সমাজের ভারসাম্য টিকে আছে।

বাংলাদেশের চামড়াশিল্প একসময় আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ নাম করেছিল। এখনো বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের চামড়ার কদর রয়েছে। তবে দুর্নীতি, সিন্ডিকেট, অব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে এই শিল্প এখন প্রায় ধ্বংসপ্রায়। এ থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন কঠোর নজরদারি, সিন্ডিকেট ভাঙা এবং মাঠপর্যায়ে ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় প্রশাসন যদি আন্তরিকভাবে বিষয়টি দেখে -তাহলে এই সমস্যা নিরসন সম্ভব।

দুঃখজনক হলেও সত্য, আওয়ামী সরকারের গত ১৬ বছরের শাসনামলে এই সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। বরং চামড়ার বাজারে সিন্ডিকেট আরও শক্তিশালী হয়েছে। গরিব মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছে। কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করতে গিয়ে তারা যে অপমান ও বঞ্চনার শিকার হয়, তা একটি সভ্য দেশের জন্য লজ্জাজনক। ধর্মীয় অনুষঙ্গ, অর্থনৈতিক মূল্য এবং মানবিক দিক বিবেচনায় এই অব্যবস্থাপনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

একটি কল্যাণরাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব জনগণের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা। 

বিশেষ করে গরিব-অসহায় মানুষের জন্য আলাদা করে ভাবার কথা। অথচ ১৬ বছরের শাসনামলেও সেই দায়িত্ব পালনে সরকারের কোনো আন্তরিকতা দেখা যায়নি। চামড়ার বাজারদর নির্ধারণ করে দিলেই দায়িত্ব শেষ হয় না, বাস্তবায়ন নিশ্চিত করাটাই মুখ্য। 

এই অনিয়মের অবসান ঘটানো এখন সময়ের দাবি। গরিবের হক যারা কেড়ে নেয়, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নইলে এই ধর্মীয়, অর্থনৈতিক এবং মানবিক অব্যবস্থাপনার ভার সমাজকেই বহন করতে হবে।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী, সহসম্পাদক, দৈনিক বাংলাদেশের খবর

  • বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bkeditorial247@gmail.com 

এমএইচএস

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

চামড়া খাত

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর