Logo

মতামত

প্রযুক্তির দখলে আমাদের সময় ও সম্পর্ক

Icon

মুহাম্মদ নূরে আলম

প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২৫, ১২:৫৯

প্রযুক্তির দখলে আমাদের সময় ও সম্পর্ক

এক সময় সন্ধ্যা নামলেই বাড়ির উঠানে বা বৈঠকখানায় পরিবারের সদস্যরা একত্রিত হতেন। কেউ গল্প বলতেন, কেউ হাসিঠাট্টায় মেতে উঠতেন, কেউবা আবার পুরোনো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করে সময় কাটাতেন। শিশুরা দৌড়াদৌড়ি করত, বড়রা তাদের খোঁজখবর নিতেন। টেলিভিশনের সামনে বসে একসঙ্গে কোনো নাটক বা খেলা দেখার আনন্দ ছিল অন্যরকম। আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল চিঠির মাধ্যমে, ফোনের কলের মাধ্যমে, কিংবা সরাসরি সাক্ষাতে। এই সময়গুলো ছিল সম্পর্কের ভিত মজবুত করার সময়, যেখানে মানুষের মধ্যে আন্তরিকতা ও সৌহার্দ্যের বন্ধন গড়ে উঠত।

কিন্তু আজকের দিনে এই চিত্র অনেকটাই পাল্টে গেছে। ঘরভর্তি মানুষ থাকলেও সবাই যেন নিজের নিজের জগতে ডুবে আছে। হাতে মোবাইল ফোন, চোখে স্ক্রিনের আলো—এই দৃশ্য এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, স্ন্যাপচ্যাট—এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো আমাদের জীবনে এমনভাবে জায়গা করে নিয়েছে যে, এগুলো যেন আমাদের নতুন পরিবার, নতুন বন্ধু হয়ে উঠেছে। 

একটি সাধারণ দিনের শুরু এখন আর সকালের কাগজ পড়ে বা পরিবারের সঙ্গে চা খেতে খেতে গল্পে নয়। বরং ঘুম থেকে উঠেই মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে ফেসবুকে কে কী পোস্ট করল, কে কী কমেন্ট করল, কার স্টোরিতে কী আছে, কে আমাকে মেসেজ করল—এসব দেখা এখন আমাদের সকালের প্রথম কাজ। এই অভ্যাস শুধু সকালের সঙ্গেই সীমাবদ্ধ নয়, দিনের প্রতিটি মুহূর্তে এটি আমাদের সঙ্গী হয়ে উঠেছে। খাবার টেবিলে বসেও অনেকে ফোন স্ক্রোল করেন, কথোপকথনের ফাঁকে ফাঁকে ইনস্টাগ্রামে রিল দেখেন। এমনকি পারিবারিক জমায়েত, ঈদের মতো উৎসব, বা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায়ও মোবাইল ফোনের উপস্থিতি এখন অপরিহার্য। কিশোররা অনলাইন গেমে মগ্ন, বড়রা ফেসবুকের স্ট্যাটাসে ব্যস্ত। এই দৃশ্য এখন এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে, আমরা এর পেছনের ক্ষতিকর প্রভাবগুলো নিয়ে খুব কমই ভাবি। 

এই প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার শুধু সম্পর্কের ক্ষেত্রেই নয়, শিশুদের শারীরিক স্বাস্থ্যের উপরও গভীর প্রভাব ফেলছে। বর্তমানে শিশুদের জন্মের কিছু বছরের মধ্যেই চোখের সমস্যা দেখা দিচ্ছে, এমনকি অনেক ছোট শিশুর চোখে চশমা উঠে যাচ্ছে। চক্ষু বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম এই সমস্যার অন্যতম প্রধান কারণ। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দীর্ঘক্ষণ ডিজিটাল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকা শিশুদের মায়োপিয়া (দূরের দৃষ্টিশক্তির সমস্যা) এবং চোখের শুষ্কতার ঝুঁকি বাড়ায়। বাংলাদেশে, ঢাকার একটি চক্ষু হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, গত দশকে শিশুদের মধ্যে চোখের সমস্যা ৩০ শতাংশ বেড়েছে। এর পেছনে প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার, বিশেষ করে স্মার্টফোন ও ট্যাবলেটে গেম খেলা এবং ভিডিও দেখার অভ্যাসকে দায়ী করা হচ্ছে। শিশুদের চোখের বিকাশের সময়ে স্ক্রিনের নীল আলোর সংস্পর্শ তাদের দৃষ্টিশক্তির উপর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করে। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন, শিশুদের দৈনিক স্ক্রিন টাইম ১-২ ঘণ্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত এবং নিয়মিত চোখের পরীক্ষা করানো জরুরি।

প্রযুক্তির এই অতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ককেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এক সময় যেখানে পরিবারের সদস্যরা একসঙ্গে বসে গল্প করতেন, হাসিঠাট্টায় মেতে উঠতেন, সেখানে এখন নীরবতা বিরাজ করে। বাবা-মা ও সন্তানের মধ্যে যে আন্তরিক যোগাযোগ ছিল, তা এখন অনেক ক্ষেত্রেই ভার্চুয়াল দেয়ালে আটকে যাচ্ছে। একটি পরিবারের মধ্যেই যেন একেকজন একেক দ্বীপে বাস করছেন। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দৈনিক গড়ে ৪-৫ ঘণ্টা সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যয় হচ্ছে। এই সময়টি যদি পরিবারের সঙ্গে কাটানো হতো, তাহলে সম্পর্কের গভীরতা অনেক বেশি হতো। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমরা আমাদের সময় ও মনোযোগ ফোনের স্ক্রিনের কাছে বন্ধক রেখে দিয়েছি। 

এই প্রবণতা শুধু পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রতিবেশী বা আত্মীয়দের সঙ্গেও সম্পর্কের দূরত্ব বাড়ছে। এক সময় পাড়ার বড়রা ছোটদের খোঁজখবর নিতেন, তাদের সঙ্গে গল্প করতেন, তাদের খেলাধুলায় উৎসাহ দিতেন। কিন্তু এখন পাড়ার মাঠগুলো ফাঁকা, বিকেলে খেলার উচ্ছ্বাস আর নেই। ফুটবল বা ক্রিকেটের মাঠে ছেলেমেয়েদের হইহুল্লোড়ের পরিবর্তে এখন শুধু নীরবতা। তরুণরা তাদের সময় কাটাচ্ছে অনলাইন গেমে বা সোশ্যাল মিডিয়ার ভার্চুয়াল জগতে। এই পরিবর্তন শুধু সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেই নয়, আমাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উপরও গভীর প্রভাব ফেলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম মানুষের মধ্যে হতাশা, উদ্বেগ, এবং একাকিত্বের অনুভূতি বাড়াচ্ছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই প্রভাব সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয়। 

মনোবিজ্ঞানীদের মতে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার মানুষের মধ্যে এক ধরনের নেশার সৃষ্টি করছে। ফেসবুকের প্রতিটি লাইক, ইনস্টাগ্রামের প্রতিটি কমেন্ট আমাদের মস্তিষ্কে ডোপামিন নিঃসরণ করে, যা আমাদের বারবার ফোনের দিকে ফিরে যেতে প্ররোচিত করে। এই নেশা এতটাই শক্তিশালী যে, অনেকে রাতভর ফোন স্ক্রোল করে সময় কাটান, যা তাদের ঘুমের ধরনকে ব্যাহত করে। ঘুমের অভাব শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব কিশোর-কিশোরী দৈনিক ৬ ঘণ্টার বেশি সময় ফোনে কাটায়, তাদের মধ্যে উদ্বেগ ও বিষণ্নতার প্রবণতা সাধারণের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি। এই পরিসংখ্যান আমাদের জন্য একটি সতর্কবার্তা। 

এই পরিস্থিতির জন্য আমরা কি শুধু প্রযুক্তিকেই দায়ী করতে পারি? না, দায় আমাদের নিজেদেরও। প্রযুক্তি আমাদের হাতে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। এটি আমাদের জীবনকে সহজ করেছে, তথ্যের জগতে প্রবেশাধিকার দিয়েছে এবং বিশ্বের সঙ্গে আমাদের সংযোগ স্থাপন করেছে। কিন্তু এই হাতিয়ারের সঠিক ব্যবহার না হলে তা আমাদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমরা প্রযুক্তির দাস হয়ে পড়েছি, এটি আমাদের সময় ও মনোযোগ নিয়ন্ত্রণ করছে। আমরা যখন ফেসবুকের স্ট্যাটাসে ব্যস্ত থাকি, তখন আমাদের সন্তান আমাদের মনোযোগের জন্য অপেক্ষা করে। আমরা যখন ইউটিউবের ভিডিওতে মগ্ন, তখন আমাদের বাবা-মা আমাদের সঙ্গে দুটো কথা বলার জন্য অপেক্ষায় থাকেন। এই দূরত্ব শুধু সম্পর্কের নয়, আমাদের মানবিক গুণাবলীরও ক্ষয় ঘটাচ্ছে। 

তাহলে আমরা কীভাবে এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারি? প্রথম পদক্ষেপ হলো সচেতনতা। আমাদের বুঝতে হবে যে, প্রযুক্তি আমাদের জীবনের একটি অংশ, কিন্তু এটি আমাদের জীবনের সবকিছু নয়। আমাদের সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, স্ক্রিন টাইম কমাতে হবে, এবং পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। একটি সাধারণ নিয়ম হতে পারে—খাবার টেবিলে মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ। এই সময়টুকু শুধু পরিবারের জন্য উৎসর্গ করা যেতে পারে। সপ্তাহে একটি দিন নির্দিষ্ট করে পারিবারিক আড্ডার আয়োজন করা যেতে পারে, যেখানে সবাই একসঙ্গে বসে গল্প করবে, হাসিঠাট্টা করবে, বা কোনো বোর্ড গেম খেলবে। এই ছোট ছোট উদ্যোগ আমাদের সম্পর্ককে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে। 

এছাড়া, সন্তানদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। তাদের হাতে ফোনের পরিবর্তে বই তুলে দেওয়া যেতে পারে। তাদের শখ, আগ্রহ, এবং সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করতে হবে। বাবা-মা যদি নিজেরা ফোন থেকে দূরে থাকেন, তাহলে সন্তানরাও তাদের অনুসরণ করবে। এছাড়া, প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটানোর গুরুত্বও অপরিসীম। বছরে কয়েকবার পরিবারের সঙ্গে ভ্রমণে যাওয়া, প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করা, বা সাধারণ একটি পার্কে হাঁটা—এসব আমাদের মনকে প্রশান্তি দেয়। এই অভিজ্ঞতাগুলো ফেসবুকের লাইক বা ইনস্টাগ্রামের ফলোয়ারের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করা সম্ভব নয় এবং এটি প্রয়োজনও নয়। এটি আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু এর ব্যবহারে নিয়মানুবর্তিতা আনা জরুরি। উদাহরণস্বরূপ, দিনে নির্দিষ্ট সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করা, রাতে ঘুমানোর আগে ফোন থেকে দূরে থাকা, এবং সন্তানদের জন্য স্ক্রিন টাইমের সীমা নির্ধারণ করা যেতে পারে। এছাড়া, দেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে পরিবারে আলোচনার অভ্যাস গড়ে তোলা যেতে পারে। এটি শিশু-কিশোরদের জ্ঞানের বিকাশে সহায়তা করবে এবং তাদের সঙ্গে বাবা-মায়ের সম্পর্ককে আরও গভীর করবে। 

শেষ কথা হলো, প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে অনেক সুবিধা দিয়েছে, কিন্তু এটি আমাদের সময় ও সম্পর্ককে কেড়ে নিচ্ছে। ফেসবুকের লাইক বা ইনস্টাগ্রামের ফলোয়ার আমাদের মনের প্রশান্তি দিতে পারে না। বরং পরিবারের হাসি, বন্ধুর সঙ্গে আন্তরিক আলাপ, বা প্রকৃতির সৌন্দর্যে হারিয়ে যাওয়া—এসবই আমাদের জীবনকে সত্যিকার অর্থে সমৃদ্ধ করে। আমাদের প্রশ্ন করতে হবে—আমরা কি প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করছি, নাকি প্রযুক্তি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া এবং তার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়াই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুস্থ ও সুখী সমাজ গড়ে তুলতে পারে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

  • বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bkeditorial247@gmail.com 

এমএইচএস

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর