Logo

মতামত

একজন বাবাও বৃদ্ধাশ্রমে না থাকুক

মিরাজুল ইসলাম

মিরাজুল ইসলাম

প্রকাশ: ১৫ জুন ২০২৫, ১৭:৪৫

একজন বাবাও বৃদ্ধাশ্রমে না থাকুক

আজ বিশ্ব বাবা দিবস। দিনটি বাবা নামের সেই মানুষদের জন্য, যারা জীবনের প্রতিটি ক্ষণে নিঃশব্দে সন্তানের মুখের হাসি আর পরিবারের সুখ-শান্তির জন্য লড়ে যান।

ছেলেবেলায় আমরা যখন ঈদে নতুন জামা-কাপড় নিয়ে মাতামাতি করতাম, তখন হয়ত খেয়াল করিনি-বাবার জন্য নতুন কিছু কেনা হয়নি। অথচ তিনি হাসিমুখেই পুরোনো পাঞ্জাবি পড়ে আনন্দ করতেন। আমাদের আনন্দই ছিল তার ঈদ। বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে এমন হাজারো বাবার গল্প।

স্মৃতির খাতায় এখনো ভেসে আসে ছোটবেলার দিনগুলো। স্কুলে ভর্তি, বই-খাতা, খেলনা কেনা, ঈদের জামা, হাটের গরু-সবকিছুতেই ছিলেন বাবা। বাবাদের এই আত্মত্যাগকে আমরা ক'জন বুঝতে পেরেছি?

বাংলাদেশের পরিবারব্যবস্থায় বাবাদের অবস্থান এক ধরনের কঠিন, অথচ নীরব। সংসারের দায়িত্ব, সন্তানদের পড়াশোনা, পরিবারের প্রয়োজনে শেষ বয়স পর্যন্ত জীবন উৎসর্গ করে দেন। অথচ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবাদের মূল্যায়ন কমে যায়। বিশেষ করে অবসর জীবন কিংবা বার্ধক্যে এসে অনেক বাবা সন্তানদের অবহেলার শিকার হন।

সম্প্রতি একটি বেসরকারি সংস্থা পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৬৩ শতাংশ বৃদ্ধ বাবা-মা তাদের সন্তানের সঙ্গে বসবাসের সুযোগ পান না। আর ২২ শতাংশ বাবা হয়ে বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই নিতে বাধ্য হয়েছেন। অথচ এই বাবারাই কোনো দিন সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করেছিলেন।

দেশের সরকারি-বেসরকারি বৃদ্ধাশ্রমগুলোর তথ্য বলছে, বর্তমানে বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে পুরুষ সদস্যের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সিংহভাগই বাবা। কোনো সন্তান-সংসার তাদের কাছে আসেনি বছরের পর বছর। ঈদ-পূজা কিংবা জন্মদিনেও খোঁজ নেন না অনেকেই। অথচ সেই সন্তানদের জন্যই একদিন এই বাবারা নিজের জীবন-সম্ভল, সুখ বিসর্জন দিয়ে পথ দেখিয়েছিলেন।

এটা কি আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয় নয়? যে সমাজে বাবা-মা বৃদ্ধাশ্রমে দিন কাটান, সে সমাজের মানবিকতা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।

এখন সময় এসেছে ভাবার, বাবা শুধু রক্তের সম্পর্ক নয়, তিনিই জীবনের প্রথম পথপ্রদর্শক। জীবনের প্রথম স্কুল, শেখানোর কারিগর। তাই বাবার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ নয় কেবল অর্থ পাঠানো কিংবা মাঝে-মধ্যে ফোন করার মধ্যে। সময় দেওয়া, শ্রদ্ধা করা, ভালোবাসা জানানো, প্রয়োজনের সময়ে পাশে থাকা—এসবই সন্তানের কর্তব্য।

এ দেশের বেশিরভাগ বাবা সংসারের কথা ভেবে নিজের জন্য খরচ করতে পারেন না। এমনকি সন্তানরা বড় হলে তাদের সময় দিতে চাইলেও নানা অজুহাতে দূরে সরে যায়। অথচ একবার ভেবে দেখা উচিত, যার ঘামে, কষ্টে, শ্রমে আমাদের বর্তমান, সেই মানুষটির জন্য আমাদেরও কিছু দায় আছে।

বাবা দিবস কেবল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট, ছবি দেওয়া কিংবা ‘বাবা আমার পৃথিবী’ টাইপ ক্যাপশন লিখলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। বাস্তব জীবনে সেই বাবার পাশে দাঁড়ানো, সময় দেওয়া, প্রয়োজনে তার হাত ধরে হাঁটা, ইচ্ছে-অনিচ্ছা শোনাও সন্তানের দায়িত্ব।

বর্তমানে সামাজিক ব্যবস্থার পরিবর্তনে, নগরায়ণের প্রভাবে যৌথ পরিবার ভেঙে ছোট পরিবার আর একক পরিবারে রূপ নিচ্ছে। ফলে বাবা-মায়েরা একা হয়ে পড়ছেন। সন্তানের চাকরি, পড়াশোনা, সংসার, বিদেশে থাকা—এসব কারণেই অনেক বাবা বৃদ্ধাশ্রমে বা একাকীত্বের জীবন যাপন করছেন। তবে ব্যস্ততা কখনো অজুহাত হতে পারে না।

সন্তানের প্রতি বাবার যেমন দায়িত্ব থাকে, তেমনি বাবার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সন্তানের দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়। চিকিৎসা, দেখভাল, সঙ্গ দেওয়া, আর্থিক সহায়তা দেওয়া—এসবই নৈতিক কর্তব্য। ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান—সব ধর্মেই বাবা-মায়ের অধিকারকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

বাবার ভালোবাসা অনেক সময় কঠিন মুখোশের আড়ালে থাকে। তিনি সহজে আবেগ দেখান না। কিন্তু সেটা যে কতটা গভীর, তা আমরা অনেক সময় বুঝতে পারি না। সন্তান বড় হলে বাবারা অনেক সময় সন্তানদের কাছ থেকে একটু সময়, একটু গল্প করার মানুষ খোঁজেন। এটুকু দিলেই তারা খুশি।

বাবারা জামা না কিনেও, পুরোনো কাপড়ে ঈদ করেন। সন্তানের নতুন জামা দেখেই তার ঈদের আনন্দ পূর্ণ হয়। বাবার পুরোনো কাপড় কখনো পুরোনো হয় না, কারণ সেখানে জমে থাকে সন্তানের হাসির স্মৃতি।

বিশ্ব বাবা দিবসে আমাদের শপথ হোক—বৃদ্ধাশ্রম নয়, সন্তানের ঘরেই হোক বাবাদের শেষ ঠিকানা। তাদের জীবনের শেষ দিনগুলো হোক আনন্দ-সুখে ভরা। কারণ, এই মানুষটির কারণেই তো আমাদের পৃথিবীটা এত সুন্দর।

ভালোবাসা হোক শুধু আজকের জন্য নয়, সারা জীবনের জন্য।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী, সহসম্পাদক, দৈনিক বাংলাদেশের খবর

  • বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bkeditorial247@gmail.com 

এমএইচএস

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর