Logo

মতামত

বিশ্ববিদ্যালয় সংকট, বাজেট বৈষম্য ও শিক্ষায় ন্যায্যতার দাবি

Icon

শামসুল আরেফীন

প্রকাশ: ১৯ জুন ২০২৫, ২১:১০

বিশ্ববিদ্যালয় সংকট, বাজেট বৈষম্য ও শিক্ষায় ন্যায্যতার দাবি

গত কয়েকদিন ধরে গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (জিএসটিইউ) শিক্ষার্থীরা পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। ক্যাম্পাস সম্প্রসারণ, অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষক সংকট নিরসন, ছাত্র সংসদ চালু ও শিক্ষা পরিবেশ উন্নয়ন—এসব দাবির পেছনে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় নামক একটি প্রতিষ্ঠানের মৌলিক শর্তসমূহ। এসব দাবি নতুন কিছু নয়; বরং এ দাবিগুলো পূরণ না হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে আদৌ ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ বলা যায় কি না, সে প্রশ্ন তোলা যুক্তিসংগত।

দুঃখজনকভাবে, গত দেড় দশকে বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রসারণের নামে দেশে অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে রাজনৈতিক স্বার্থে এবং উন্নয়ন সংস্থার খুশি রাখার জন্য। অনেক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ক্যাম্পাস নেই, ভাড়াকৃত ভবনে চলছে পাঠদান। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নেই, আর নিয়োগপ্রক্রিয়া দলীয়করণ ও স্বজনপ্রীতির কারণে গুণগত শিক্ষা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরিণতিতে শিক্ষার্থীরা ভোগ করছে ক্লাসরুম, ল্যাব ও আবাসন সংকটসহ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অভাব।

এই কাঠামোগত সংকট শিক্ষার্থীদের মধ্যে গভীর অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। গত ১৫ বছরে ২০টিরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন হয়েছে, যা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর ৪০ ছাড়িয়ে গেছে। মতপ্রকাশের অনেকটা স্বাধীনতা ফিরে আসায় ভবিষ্যতে আরও আন্দোলন হওয়াও স্বাভাবিক। এসব দাবিকে উপেক্ষা করা যাবে না যদি না বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ, অংশগ্রহণমূলক প্রশাসন এবং বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়নে সুসমন্বিত জাতীয় পরিকল্পনা আমরা গ্রহণ করতে না পারি।

কিন্তু বাস্তবে আমরা তা দেখতে পাচ্ছি না। ইন্টারিম সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টার কার্যক্রম এখন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ উপাচার্য রদবদল ও আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে। অথচ বাস্তব পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সংস্কার।

২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য ১৩,২২২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। গবেষণায় বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র ২ কোটি টাকা, যা প্রহসনের মতো। ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফয়েজ দাবি করেছেন যে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার অর্থ ব্যয় করতে পারে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো—গবেষণা বাধাগ্রস্ত হওয়ার পেছনে যেসব কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা কাজ করে, যেমন শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, টিচিং লোড, ল্যাব ও রিসোর্স ঘাটতি, সেগুলো চিহ্নিত করে সমাধান দেওয়ার দায়িত্ব কার?

বাজেট বণ্টনে বৈষম্যও এখন স্পষ্ট। উদাহরণস্বরূপ, জিএসটিইউ এবার ইউজিসি থেকে মাত্র ৩ কোটি ৫ লাখ টাকা পেয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ৩৪ কোটি টাকা কম। অথচ শুধু বেতন খাতেই প্রয়োজন ৩০ কোটি টাকা। ফলে ক্লাস, গবেষণা বা আবাসনের জন্য বাজেট কোথা থেকে আসবে? বরাদ্দ কমানোর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে—গত বছরের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থতা। এই যুক্তি যদি সত্যও হয়, তাহলে প্রশ্ন হলো—কেন সেই প্রশাসনিক ব্যর্থতার দায় শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা বহন করবে?

এই বাজেট সংকটের পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব আছে কিনা, তা স্পষ্ট নয়। তবে অনেকেই মনে করেন, বিগত সরকারের সময় গোপালগঞ্জ বিশেষ সুবিধা পেয়েছিল, এখন তার উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কিন্তু একটি বিশ্ববিদ্যালয় একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের নয়, জাতীয় সম্পদ। সেখানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মেধাবী শিক্ষার্থীরা আসে। আঞ্চলিক রাজনীতির প্রভাবে বাজেট নির্ধারিত হলে, তাতে সার্বজনীনতার নীতি ভেঙে পড়ে এবং বৈষম্য বাড়ে।

অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কার নিয়ে বিভিন্ন সেমিনার, আলোচনা এবং শিক্ষক নেটওয়ার্কের কর্মশালা হয়েছে। “কেমন বিশ্ববিদ্যালয় চাই” এই প্রশ্নে বহু মতামত এসেছে। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে কার্যকর কোনো পরিকল্পনা এখনও চোখে পড়েনি। শিক্ষা সংস্কারের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ কমিশন গঠনের দাবি বারবার উঠলেও সে বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই। বরং আমরা দেখেছি কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের ঘটনা। উপাচার্য নিয়োগেও এখনো দলীয় পছন্দের ছাপ রয়েছে, নিয়োগের প্রক্রিয়া ও যোগ্যতার মানদণ্ড এখনও অস্পষ্ট।

ছাত্র সংসদ এখনও চালু হয়নি, নিরাপদ ও নারীবান্ধব ক্যাম্পাস গঠনের কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই। বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক দুইটি হত্যাকাণ্ড সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতকে আবার সামনে এনেছে। এমনকি বর্তমান সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া কিছু উপাচার্যও আন্দোলনের মুখে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছেন—যেমন কুয়েট বা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা।

তবুও কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। বিভিন্ন ক্যাম্পাসে নানান ক্রিয়াশীল শিক্ষার্থী সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনদের সহাবস্থান দেখা যাচ্ছে, যা আগের রেজিমে সম্ভব ছিল না। উপাচার্য নিয়োগে প্রথমবার সার্চ কমিটি গঠন হয়েছে, যদিও তার কাঠামো পর্যালোচনার দাবি রাখে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় পিএইচডি শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির ঘোষণা দিয়েছে, ইউজিসি ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়কে পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি করার অনুমতি দিয়েছে। এমনকি ব্রাক এবং ইংল্যান্ডের সোয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ পিএইচডি প্রোগ্রামও চালু হয়েছে—যা নিশ্চয় প্রশংসনীয়।

তবুও প্রশ্ন থেকে যায়—উচ্চশিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি, ন্যায্য ও কার্যকর পরিকল্পনা কোথায়? আমার প্রস্তাব:

  • পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শতভাগ শিক্ষার্থীর আবাসন নিশ্চিত করতে হবে
  • বাজেট বণ্টনে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও ন্যায্যতা বজায় রাখতে হবে
  • ছাত্র সংসদ অবিলম্বে চালু করে অংশগ্রহণমূলক প্রশাসন গড়ে তুলতে হবে
  • গবেষণার জন্য সহায়ক পরিবেশ ও পর্যাপ্ত তহবিল নিশ্চিত করতে হবে
  • শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদা বৃদ্ধি করতে হবে
  • প্রান্তিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংকট নিরূপণ করে দ্রুত সমাধান দিতে হবে

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যেন জাতীয় বা আঞ্চলিক রাজনীতির বলি না হয়। অ্যাকাডেমিক সুযোগ-সুবিধা থেকে কেউ যেন বঞ্চিত না হয়, সেটিই হওয়া উচিত রাষ্ট্রের ন্যূনতম দায়িত্ব। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় শুধু উচ্চশিক্ষা অর্জনের স্থান নয়; এটি একটি জাতির নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং গণতান্ত্রিক চেতনার ভিত্তি নির্মাণের প্রধান ক্ষেত্র।

তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকট মানে কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা নয়—এটি পুরো সমাজব্যবস্থার, বিশেষত আমাদের গণতন্ত্র, সাম্য এবং সামাজিক ন্যায়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে এক গভীর সতর্ক সংকেত। গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন সেই সংকেতেরই প্রকাশ—যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, এখনই সময় মৌলিক চাহিদা পূরণ, স্বচ্ছ বাজেট বণ্টন, এবং অংশগ্রহণমূলক প্রশাসন নিশ্চিত করার।

এই প্রেক্ষাপটে, আঞ্চলিক পক্ষপাত, দলীয় নিয়ন্ত্রণ এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতা পরিহার করে আমাদের গড়ে তুলতে হবে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায্য এবং টেকসই উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা। এটি কেবল শিক্ষার্থীদের জন্য নয়, বরং একটি ন্যায্য রাষ্ট্র ও মানবিক সমাজ নির্মাণে আমাদের সবার স্বার্থে জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয় যেন সত্যিকার অর্থে হয়ে উঠতে পারে জ্ঞান, স্বাধীনতা এবং ন্যায়ের আলোকবর্তিকা—এই হোক আমাদের সম্মিলিত অঙ্গীকার।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়; পিএইচডি গবেষক, ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র। 

  • বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bkeditorial247@gmail.com

এমএইচএস

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

বিশ্ববিদ্যালয়

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর