দৃষ্টিপাত
ধূমপান করছেন মানে আপনি নীরবে ‘মানুষ হত্যা’ করছেন!
প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৫, ১২:৩১
-685500413e03f.jpg)
এআই দিয়ে তৈরি ছবি
খাবারে ফরমালিন মেশানোকে অপরাধ বলে মানেন শতভাগ মানুষ। আইনের চোখেও তা গুরুতর অপরাধ। কাজটি নিঃসন্দেহে ভয়ানক, নৈতিকতাবিরোধী এবং জীবনবিনাশী। এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন হয়, সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভ ছড়ায়, কখনও বিক্ষোভ হয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালায়, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়। কারণ আমরা জানি, ফরমালিন শরীরে ধীরে ধীরে বিষক্রিয়া তৈরি করে, ফুসফুস, কিডনি, লিভার ক্ষতিগ্রস্ত করে, এমনকি ক্যানসারেরও কারণ হতে পারে।
এই বোধের জায়গা থেকে তৈরি হয় প্রশ্ন—ধূমপান কি ফরমালিনের চেয়ে কম ভয়ানক? ফরমালিন যেমন নিঃশব্দে শরীরে মৃত্যুবীজ বপন করে, তেমনি ধূমপানের ধোঁয়াও তো ছড়িয়ে দেয় ক্ষতিকর রাসায়নিক—নিকোটিন, টার, কার্বন মনোক্সাইড। তবু ধূমপানকে ‘স্বাভাবিক অভ্যাস’ হিসেবে বিবেচনা করে সমাজ। মেনে নেয় এবং এর ক্ষতি নিয়ে খুব বেশি ভাবে না। বরং ধূমপানের পরিবেশের ভেতরেই দিন যাপনে অভ্যস্ত হয়। এমনকি এ নিয়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ তো বহু দূরের ভাবনা, নিজেদের পরিমণ্ডলেও কথা বলে না। বলার প্রয়োজন মনে করে না হয়ত।
কেউ কেউ সর্বোচ্চ এতটুকুতেই সন্তুষ্ট হন যে, তিনি নিজে তো ধূমপান করছেন না। অথচ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)’র সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৮০ লক্ষ মানুষ তামাকজনিত রোগে মারা যায়, যার মধ্যে প্রায় ১৩ লক্ষ মানুষ ‘প্যাসিভ স্মোকিং’ বা অন্যের ধূমপানের শিকার। বাংলাদেশেও ছবিটা ভয়াবহ—২০১৮ সালের জাতীয় তামাক জরিপ অনুসারে, প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশ তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করেন। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হলো—এই তামাকের প্রভাব শুধু ব্যবহারকারীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। ধূমপায়ীর চারপাশের মানুষ—শিশু, বৃদ্ধ, গর্ভবতী নারী এমনকি পথচারীরাও সেই ধোঁয়ার শিকার হন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আরেকটি তথ্য বলছে, পরোক্ষ ধূমপানের ফলে প্রায় ৭,০০০ প্রকারের রাসায়নিক পদার্থ মানবদেহে প্রবেশ করে, যা শিশু, গর্ভবতী নারী এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক এবং তা সকলের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ায়। এর ফলে শিশুদের আকস্মিক মৃত্যু থেকে শুরু করে, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, কানের সংক্রমণ এবং গুরুতর হাঁপানি হতে পারে। অন্যদিকে, পরোক্ষ ধূমপানের ফলে গর্ভবতী নারীদের ভ্রূণের ক্ষতি ছাড়াও, অকাল প্রসব এবং অপরিণত শিশু জন্মদানের মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। তাছাড়া, প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে স্ট্রোক, ফুসফুস ও স্তন ক্যানসার, হৃদ্রোগ, পালমোনারি রোগ এবং ডায়াবেটিসের মতো রোগ সৃষ্টি হতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে পরোক্ষ ধূমপানে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন ধূমপায়ীর বাসায় থাকা লোকজন। ঘরে থাকার সময় ধূমপায়ীরা যখন ধূমপান করেন তখন বাড়ির শিশু, অন্তঃসত্ত্বা এবং বয়স্ক ব্যক্তিসহ পরিবারের থাকা অন্য সদস্যরা পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়।
অর্থাৎ, প্রত্যক্ষ ধূমপানের কারণে যে ক্ষতি হয় ধূমপায়ী ব্যক্তির, পরোক্ষ ধূমপানের অবস্থা তৈরি করে তিনি অন্যদেরও ঝুঁকিতে ফেলে দেন।
এই প্রেক্ষাপটে একজন ধূমপায়ী এবং মাছে বা ফলে ফরমালিন মেশানো ব্যবসায়ীর ভেতরে পার্থক্য কতখানি? একজন খাবারে বিষ মেশায়, আরেকজন নিশ্বাস নেওয়ার বাতাসে। দুজনেই জানেন কাজটা ক্ষতিকর। কিন্তু একজন ব্যক্তিগত ভালোলাগা আর অভ্যাসে অন্যজন ব্যক্তিগত লাভের আশায় করে চলেন।
এই দুয়ের ভেতরে আমার কখনো ধূমপায়ীকেই বেশি ভয়ংকর বলে মনে হয়। কেননা, আপনি চাইলে বিকল্প খাবার কিনতে পারবেন। অরগানিক শাকসবজি কিনতে পারেন। প্রয়োজনে বিক্রেতা বদলাতে পারেন। ফরমালিন শনাক্ত করার কৌশল জানতে পারেন। অর্থাৎ, ফরমালিন মেশানো খাবারকে এড়ানোর সুযোগ আছে। কিন্তু বাতাসের তো বিকল্প নাই। বাতাসের সীমানাও নাই। রাস্তায় বা চায়ের দোকানে আপনার পাশের লোকটি সিগারেট ধরালে আপনার কাছে কোনো বিকল্প থাকে না। বাতাস কারও একার নয়। একজনের বা কিছু মানুষের ধূমপানের কারণে সবার বাতাস হয়ে ওঠে বিষাক্ত।
ধূমপায়ীরা নিজেদের পক্ষে বিষয়টাকে ‘ব্যক্তিগত পছন্দ’ বা ‘ব্যক্তি স্বাধীনতা’ হিসেবে দাবি করতে চান। কিন্তু কোনো পছন্দ যদি অন্যের জীবনকে হুমকিতে ফেলে, তা আর ব্যক্তিগত থাকে না।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না। এই বিধানকে সামনে এনেও কেউ কেউ ব্যক্তিস্বাধীনতার দোহাই দেন। কিন্তু ধূমপান করা যদি কারো ব্যক্তিস্বাধীনতা হয় তাহলে ধূমপানমুক্ত পরিবেশে থাকতে চাওয়াটাও ব্যক্তিস্বাধীনতা। কেউ এই পরিবেশ নষ্ট করলে তিনি ব্যক্তিস্বাধীনতা নষ্ট করছেন।
অন্যদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ (UDHR)-এর ৩ অনুচ্ছেদ বলছে, ‘Everyone has the right to life, liberty and security of person.‘
কাজেই ধূমপানের মাধ্যমে অপরকে বিষযুক্ত ধোঁয়ার মুখে ঠেলে দেওয়া ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মানবাধিকারের সরাসরি লঙ্ঘন।
বাংলাদেশে ২০১৩ সালের ‘তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন’ অনুযায়ী, পাবলিক প্লেসে (অর্থাৎ জনসমক্ষে) ও পাবলিক পরিবহনে ধূমপান নিষিদ্ধ। কিন্তু বাসস্ট্যান্ড, ফুটপাত, সরকারি হাসপাতালের চত্বর, এমনকি আদালতের সিঁড়িতেও প্রতিনিয়ত এই আইন লঙ্ঘিত হয়। তাই, কেবল আইন থাকলেই হবে না—তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত হওয়া জরুরি। সেজন্য দরকার সরকারি সদিচ্ছা এবং জনসচেতনতা।
বিভিন্ন সময়ে আমরা ফরমালিন বিরোধী অভিযান পরিচালনা হতে দেখেছি, বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালত নামে, ধরা হয় অপরাধী। শাস্তিও দেওয়া হয়। কিন্তু ধূমপানবিরোধী ব্যবস্থায় আমরা সেই আন্তরিকতা দেখি না। এই উদাসীনতাও দায়ী। কারণ সমাজ ফরমালিনের বিষয়ে যতটা সংবেদনশীল, ততটা ধূমপানে না। তাই খাবারের বিষ মেশানো কারবারি তা করেন গোপনে। আর বাতাসে বিষ মেশানো কারবারি করেন প্রকাশ্যে, কখনো স্টাইল করে। সমাজ একে এক ধরনের ‘অবৈধ স্বাভাবিকতা’ হিসেবে মেনে নেয়। কিন্তু ধূমপান প্রতিরোধেও আইন আছে। এই আইনের কোনো প্রয়োগ কোথাও হতে দেখা যায় না। এখানে আইনের কাঠামোগত দুর্বলতাও হয়ত দায়ী। তবুও, সামাজিকভাবে যদি একে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা তৈরি হতো, তাহলেও হয়ত কমতো ধূমপায়ীর সংখ্যা।
কখনো কখনো অবশ্য বিভিন্ন দিবসকে কেন্দ্র করে লোক দেখানো কিছু সচেতনতামূলক কাজ হয়। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দেখা যায় ধূমপান বিরোধী সভা-সেমিনার বা কিছু মানববন্ধন করতে। সেই সময়েই রাস্তায় রিকশাচালক বা পথচারীর হাতে, কলেজছাত্রের ঠোঁটে, অফিসে চা বিরতির সময়ে, এমনকি ওইসব সভা-সেমিনার-মানববন্ধনের ফাঁকেও সিগারেট জ্বলতে থাকে।
এই বাস্তবতায় ধূমপানের বিরুদ্ধে লড়াই হতে হবে ফরমালিনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের চেয়েও শতগুণ সক্রিয় এবং পরিকল্পনামাফিক। সে লক্ষ্যে কিছু বাস্তব উদ্যোগের প্রস্তাব করছি।
- সকল পাবলিক প্লেসে ধূমপানবিরোধী আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন
- স্কুল-কলেজে তামাকবিরোধী শিক্ষা কার্যক্রম
- ধূমপানবিরোধী বিজ্ঞাপন ও ক্যাম্পেইনে তারকাদের সম্পৃক্ততা
- ই-সিগারেট ও ভেপ জাতীয় দ্রব্য নিয়ন্ত্রণে নতুন আইন
- ধূমপানের ওপর কর বাড়িয়ে তামাকপণ্যে নিরুৎসাহ তৈরি করা
- তামাকবিরোধী আইন আরও কঠোর করা এবং আইন বাস্তবায়নের স্পষ্ট রূপরেখা দেওয়া।
শেষ কথা
খাবারে ফরমালিন মেশানো আর ধূমপানের এই তুলনা অনেকের কাছেই অপছন্দনীয় হবে জানি। তবু নিশ্চিতভাবেই এই দুই তুলনাযোগ্য। কেননা উভয়ের মাধ্যমেই মানুষের শরীরে বিষ ঢোকে, নীরবে। এ দুয়ের কারবারিই মূলত এই বিষ ঢোকান অন্যদের শরীরে।
আপনি যদি একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে খাবারের নিরাপত্তা চান, তাহলে বাতাসের নিরাপত্তাও আপনার দাবি করা উচিত। মনে রাখা উচিত, নিঃশ্বাসের বাতাসের কোনো বিকল্প নেই।
আপনার ‘সুখ টান’ কারো মৃত্যুর টিকিট হয়ে দাঁড়াক—তা কি আপনি চান?
মেহেদী হাসান শোয়েব : লেখক, প্রকাশক, বিতার্কিক; শিফট ইনচার্জ, বাংলাদেশের খবর
- বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bkeditorial247@gmail.com