Logo

মতামত

কেন ইরান লিবিয়া-মিশর-সিরিয়া-ইরাকের মতো নয়

Icon

রিয়াজুল হক

প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৫, ২০:০৭

কেন ইরান লিবিয়া-মিশর-সিরিয়া-ইরাকের মতো নয়

লিবিয়া, মিশর, সিরিয়া, ইরাক-এই দেশগুলোর নাম শুনলেই আমাদের সামনে ভেসে ওঠে কিছু শক্তিশালী, এককেন্দ্রিক শাসকের মুখ। মুয়াম্মার গাদ্দাফি, হোসনি মোবারক, বাশার আল-আসাদ, সাদ্দাম হোসেন, তারা ছিলেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার একমাত্র চালিকাশক্তি। এই নেতাদের পতন মানেই গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রের পতন, যার প্রতিফলন আমরা প্রত্যক্ষ করেছি অরাজকতা, গৃহযুদ্ধ কিংবা বিদেশি হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে। অথচ ইরানের ক্ষেত্রে আমরা দেখি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক বাস্তবতা।

ইরানে প্রেসিডেন্ট মারা গেলে শোক হয়, রাজনীতিতে কিছুটা আলোড়ন সৃষ্টি হয়, কিন্তু শাসনব্যবস্থার ভিত টলে না। প্রধানমন্ত্রী, সেনাবাহিনী প্রধান, এমনকি সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি নিহত হলেও ইরানের রাষ্ট্র কাঠামো অটুট থাকে। কারণ, দেশটি একক শাসকনির্ভর নয়, বরং একটি সুপ্রতিষ্ঠিত কাঠামো এবং মতাদর্শভিত্তিক ব্যবস্থার ওপর দাঁড়িয়ে আছে।

এই ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ‘রাহবার’। তিনি সরাসরি নির্বাচিত না হলেও দেশটির ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের এক গুরুত্বপূর্ণ ধারার প্রতিনিধিত্ব করেন, যিনি দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রের মূল দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করেন। তার অধীনে কাজ করে প্রেসিডেন্ট, পার্লামেন্ট, বিচার বিভাগ, বিপ্লবী গার্ড এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। একাধিক স্তরে নেতৃত্ব থাকায় এক ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে পুরো শাসন কাঠামো ধসে পড়ে না।

প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি সম্প্রতি এক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। তাঁর সঙ্গী ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ানসহ আরও উচ্চপর্যায়ের নেতা। কিন্তু আমরা দেখেছি, এই দুঃখজনক ঘটনার পরও ইরানের রাষ্ট্রযন্ত্রে কোনো অচলাবস্থা তৈরি হয়নি। সংবিধান অনুযায়ী অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট নিয়োগ হয়েছে, নতুন নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে, আন্তর্জাতিক কূটনীতি চালু রয়েছে এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাও স্বাভাবিক।

এই সক্ষমতার পেছনে রয়েছে ইরানের দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক চেতনা ও সংগঠিত প্রতিষ্ঠানব্যবস্থা। ইসলামি বিপ্লবের পর দেশটি একটি আদর্শভিত্তিক শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, যেখানে ব্যক্তির চেয়ে প্রতিষ্ঠান এবং মতাদর্শ গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে একক নেতৃত্বের পরিবর্তন কোনো মহাবিপর্যয় ডেকে আনে না।

তুলনামূলকভাবে মিশরে মোবারকের পতনের পর সামরিক শাসন ফিরে আসে। গণতন্ত্র কিছুকাল টিকে থাকলেও স্থায়িত্ব পায়নি। সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের বিরোধিতা গৃহযুদ্ধে পরিণত হয় এবং এখনও দেশটি স্থিতিশীলতা খুঁজে ফিরছে। ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের মৃত্যুর পর দেশটি চরম অস্থিতিশীলতায় পড়ে। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সংঘর্ষ, আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ এবং সন্ত্রাসবাদ ইরাককে বিপর্যস্ত করে তোলে।

ইরান এই বিচারে অনেকটাই ব্যতিক্রম। তাদের রাষ্ট্র কাঠামোর স্থিতিশীলতা অনেক দেশকেই শিক্ষা দিতে পারে। নেতৃত্বের পরিবর্তন সেখানে গঠনগত প্রক্রিয়ায় ঘটে, বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে নয়। ইরানের শাসন কাঠামো নিয়ে বিতর্ক করা যেতেই পারে, তবে তা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আজকের পৃথিবী, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের প্রেক্ষাপটে, এই ধরনের স্থিতিশীল ব্যবস্থা একটি শিক্ষনীয় উদাহরণ, যেটি ভাবতে শেখায় যে, শুধু শক্তিশালী নেতা নয়, চাই শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। আজকের দুনিয়ায় শক্তি, প্রতিরক্ষা কিংবা শুধু অর্থনীতি নয়, সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শাসন কাঠামোর গভীরতা ও স্থায়িত্ব। ইরান তা দেখাতে পেরেছে।

লেখক : রিয়াজুল হক, যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

ইরান ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর