Logo

মতামত

বিতর্কিত বিদেশি ঋণ নিয়ে আপসের পথে হাঁটছে অন্তর্বর্তী সরকার

Icon

ইয়াহিয়া নয়ন

প্রকাশ: ৩০ জুন ২০২৫, ১২:৪৬

বিতর্কিত বিদেশি ঋণ নিয়ে আপসের পথে হাঁটছে অন্তর্বর্তী সরকার

বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ ক্রমাগত বাড়ছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) বৈদেশিক ঋণের সুদ ও আসল বাবদ অর্থ পরিশোধ ৪ বিলিয়ন বা ৪০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি পৌঁছেছে।

এযাবৎকালের মধ্যে সরকারকে বিদেশি ঋণ পরিশোধে সর্বোচ্চ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, চলতি অর্থবছর শেষে বিদেশি ঋণ শোধের পরিমাণ ৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) পক্ষ থেকে  প্রকাশিত বিদেশি ঋণ পরিশোধ–সংক্রান্ত এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থছরের প্রথম ১১ মাসে বাংলাদেশ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের সুদ ও আসল বাবদ সরকার পরিশোধ করেছে ৩৭৮ কোটি মার্কিন ডলার। যেখানে গত অর্থবছরের পুরোটা সময়ে বিদেশি ঋণের আসল ও সুদ বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছিল ৩৩৪ কোটি ডলার।

কোনো দেশে স্বৈরাচার বা দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার জনগণের স্বার্থের কথা মাথায় না রেখে অর্থ আত্মসাৎ করার জন্য বিদেশি দাতাদের কাছ থেকে যে ঋণ গ্রহণ করে তা-ই ‘অডিয়াস ডেট’ বা বিতর্কিত বিদেশি ঋণ। পরবর্তী সময়ে এ ঋণ দেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। বিশ্বের অনেক দেশ এ ধরনের ঋণের কারণে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার এ ঋণ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আইনি কাঠামোও তৈরি হয়েছে। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ইকুয়েডর, কিউবা, ইরাক ও আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক। যারা অডিয়াস ডেটকে চ্যালেঞ্জ করে বিদেশী ঋণ মওকুফের সুযোগ গ্রহণ করেছে।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বাংলাদেশে বিতর্কিত বিদেশি ঋণ গ্রহণের বহু নজির দেখা গেছে। যেসব ঋণ নিয়ে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলেও আদৌ এসব প্রকল্পের আর্থিক সুফল কতটুকু রয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এমনকি এসব প্রকল্প যখন শুরু করা হয় তখন দেশে ব্যাপকভাবে আলোচনা ও সমালোচনা উঠেছিল। আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশের মেগা প্রকল্পগুলোয় দুর্নীতি ও অনিয়মের যেসব তথ্য-উপাত্ত হাজির করা হয়েছে তাতে সরকার চাইলে এসব ঋণকে অডিয়াস ডেট হিসেবে বিবেচনা করতে পারে। এমনকি আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামোর মধ্য দিয়ে ঋণদাতা দেশগুলোর সঙ্গে দরকষাকষির উৎকৃষ্ট উদাহরণ তৈরি করতে পারে।

শুরুতে সরকার এসব ঋণ নিয়ে তৎপর হলেও এখন এসব বিষয়ে এক ধরনের পিছুটান দেখা যাচ্ছে। যেসব প্রকল্প ঋণগুলোকে সরকার অডিয়াস ডেট ঘোষণা করবে, সেসব প্রকল্পের বিপরীতে সভরেন গ্যারান্টি রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশে বেশকিছু আইন পরিবর্তন-সংশোধন এমনকি বাতিল করে। এসব উদ্যোগের ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নেয়া অনেক প্রকল্প বাদ হয়ে যায়। যেগুলোয় মূলত রাষ্ট্র এ ঋণ পরিশোধে দায় নিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে, সরকার বেশকিছু প্রকল্পের জন্য দেশি-বিদেশি দরপত্র আহ্বান করলেও তাতে বিদেশি দাতা সংস্থার সাড়া মেলেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার এখন যেসব প্রকল্পের জন্য দরপত্র আহ্বান করছে সেগুলোয় রাষ্ট্রের অনেকাংশে দায়ভার নেই। যে কারণে বিদেশি দাতা সংস্থাগুলো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বড় আকারে না আসার পেছনে এ ভয়টিও সরকারের মধ্যে বড় আকারে কাজ করছে বলে মনে করেন তারা।

তবে প্রশ্ন হলো, এ প্রকল্পগুলো আর্থিক সুফল কিংবা ঋণের আকার বা প্রবাহ কমাতে কি সরকারের হাতে কোনো উপায় নেই? অবশ্যই রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব ঋণের মধ্যম মেয়াদি মূল্যায়ন দরকার। সেগুলো মূল্যায়ন করে বিতর্কিত বিদেশি ঋণের বিষয়ে সরকার বড় সিদ্ধান্তে আসতে পারে। এমনকি দাতা সংস্থাগুলোকে দরকষাকষির টেবিলে টেনে আনতে পারে। যেখান থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণের আকার কিংবা সুদ বড় আকারে কমিয়ে আনার সুযোগ রয়েছে।

সামনের দিনগুলোয় সরকারের বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ আরো বাড়বে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপরও চাপ পড়বে। বড় প্রকল্পগুলোয় গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে গেলে সুদ ও আসল দুটোই পরিশোধ করতে হবে। ফলে সামনে ঋণ পরিশোধের চাপ স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে। এ চাপ এমন একটি সময়ে আসছে যখন দেশের রিজার্ভের পতন ঠেকানো গেলেও তা এমন পর্যায়ে নেই যে ঋণ পরিশোধের চাপকে ধারণ করতে পারে। এ অবস্থায় আমাদের বিদেশি ঋণের শর্ত নমনীয় করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে দরকষাকষি করতে হবে। বিভিন্ন দাতাদেশ ও সংস্থার সঙ্গে আলোচনা শুরু করাটা গুরুত্বপূর্ণ, যাতে সহনীয়ভাবে ঋণ পরিশোধ করা যায়। পাশাপাশি নতুন করে বিদেশি ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে খুব সাবধান থাকতে হবে। আমাদের ঋণ পরিশোধের যে প্রক্ষেপণ করা হয়, সেক্ষেত্রেও অস্পষ্টতা রয়েছে, সেগুলোকে ঠিক করতে হবে। তা না হলে নীতিনির্ধারকরা সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। কতটুকু চাপ আসবে, আগাম কোনো সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে কিনা সেটিও বিবেচনায় নিতে হবে। ঋণ পরিশোধের অবস্থা ও রিজার্ভ কোথায় দাঁড়াতে পারে সেই প্রক্ষেপণ বিবেচনায় নিয়ে নতুন ঋণ গ্রহণের কৌশল ঠিক করতে হবে।

অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নয়নের কথা বলে লুটপাটের উদ্দেশে বাছবিচারহীন প্রকল্পে অর্থের অপব্যবহারের কারণেই সরকারের ঋণ এতটা স্ফীত হয়েছে। এসব ঋণের বেশকিছু অংশ অডিয়াস ডেট হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এজন্য সরকারকে সংশ্লিষ্ট দাতাদেশ ও সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালাতে হবে। তাছাড়া দেশের বার্ষিক কত বিলিয়ন ডলার সুদ পরিশোধে ব্যয় করতে হয় এবং কত ডলার আমাদের সক্ষমতা রয়েছে সেটিও বিবেচনা করা উচিত। শুধু যে বিগত সরকারের ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে তা নয়, বর্তমান সরকার বাজেটের জন্যও বিদেশি ঋণ নিয়েছে, সেটিও আগের ঋণের সঙ্গে যুক্ত হবে।

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যই ঋণ নিতে হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো সেই ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা আমাদের আছে কিনা এবং আমরা সঠিক প্রকল্পে ঋণ নিয়ে সঠিকভাবে ব্যবহার করছি কিনা। এমন কিছু প্রকল্পে ঋণ নেয়া হয়েছে সেসব প্রকল্পের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ওভার প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থের একটি বড় অংশ সরিয়ে ফেলার অভিযোগ রয়েছে। প্রকল্পের সময় বাড়িয়ে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। আরো ঋণ নেয়া হয়েছে। দেশের ঋণশোধ করতে হবে ডলারে (বিদেশি মুদ্রা)। তার জন্য প্রবাসী আয় ও রফতানি আয়ের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল দেশ। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে না। সেটা না বাড়লেও সমস্যা। আর বাংলাদেশের বেশির ভাগ ঋণ নেয়া হয়েছে দ্বিপক্ষীয়ভাবে যেমন: রাশিয়া, চীন। এ ঋণের সুদের হার বেশি। পরিশোধের সময়ও কম। আর এ ঋণে নজরদারি কম থাকায় দুর্নীতিও বেশি হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের হিসাবে মোট ঋণের পরিমাণ জিডিপির ৫৫ শতাংশ এবং বিদেশী ঋণ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত থাকলে সেটি নিরাপদ। যেভাবে ঋণের বোঝা বাড়ছে, সেটি এভাবে চলতে থাকলে ঋণের পরিমাণ জিডিপির ৫৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়াটা সময়ের ব্যাপার। আমাদের জিডিপির আকার নিয়েও প্রশ্ন আছে। 

সেক্ষেত্রে ঋণের দিক দিয়ে আমরা হয়ত এখনই নির্ধারিত সীমা ছাড়িয়ে গেছি কিংবা আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সেখানে চলে যেতে পারি। ঋণের নিরাপদ সীমার চেয়ে অনেক নিচে থাকা সত্তে¡ও সাম্প্রতিক সময়ে টাকার অভাবে ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে দেশকে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। ফলে শুধু জিডিপির অনুপাতে ঋণের পরিমাণ হিসাব করা হলে সেটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাই বিদেশি বিতর্কিত ঋণ পুনর্গঠনে দাতাদেশ ও সংস্থাগুলোর সঙ্গে সরকারের আলোচনার জন্য তৎপরতা বাড়ানো প্রয়োজন।

এদিকে বিদেশি ঋণ পরিশোধ বাড়লেও কমেছে বিদেশি ঋণ ছাড় ও ঋণের প্রতিশ্রুতি। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে বিদেশি ঋণছাড় হয়েছে ৫৬০ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৭০২ কোটি ডলার। একই সময়ে নতুন ঋণের প্রতিশ্রুতি এসেছে ৫৪৮ কোটি ডলারের। যদিও গত অর্থবছেরর একই সময়ে ঋণ প্রতিশ্রুতি এসেছিল ৭৯২ কোটি ডলারের।

লেখক : মফস্বল সম্পাদক, বাংলাদেশের খবর

  • বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bkeditorial247@gmail.com 

এমআই

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর