মিশর-ইসরায়েল সম্পর্কের অন্তরালের ইতিহাস ও বাস্তবতা

মো. মোশারফ হোসাইন
প্রকাশ: ৩০ জুন ২০২৫, ১৪:৪১
-68624db8226d5.jpg)
মিশর, এক নামেই যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রাচীন সভ্যতা, ঐতিহ্য, ধর্মীয় ইতিহাস এবং আধুনিক মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। দেশটির প্রাচীন পরিচয় যতখানি গর্বের, আধুনিক রাষ্ট্ররূপ ততটাই কূটনৈতিক সমীকরণের ঘূর্ণাবর্তে জড়ানো।
উত্তর আফ্রিকার উত্তরপূর্ব প্রান্তে অবস্থিত এই রাষ্ট্রটি আফ্রিকা ও এশিয়ার মিলনস্থলে এক সুস্পষ্ট সেতুবন্ধন রচনা করেছে, যার পূর্বে রয়েছে ইসরায়েল ও গাজা ভূখণ্ড, পশ্চিমে লিবিয়া, দক্ষিণে সুদান এবং উত্তরে ভ‚মধ্যসাগর। সিনাই উপদ্বীপের মাধ্যমে এটি এশিয়ার ভূখণ্ড স্পর্শ করে এবং পূর্বে রয়েছে লোহিত সাগরের বিস্তৃতি।
মিশরের মোট আয়তন প্রায় ১০ লক্ষ বর্গকিলোমিটার, যার অধিকাংশই মরুভূমি। তবু এই মরুভূমির মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে আফ্রিকার দীর্ঘতম নদী—নাইল। এই নদীর তীর ঘেঁষেই গড়ে উঠেছে দেশের জনবসতির প্রায় ৯৫ শতাংশ এবং এখানেই গড়ে উঠেছিল প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা। সেই সভ্যতা, যা পিরামিড, স্ফিংক্স, হায়ারোফিক লিপি এবং ফারাওদের মাধ্যমে আজও বিশ্ব ইতিহাসে অনন্য।
বর্তমানে মিশরের জনসংখ্যা প্রায় ১১ কোটি ২৭ লাখ। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলিম, প্রধানত সুন্নি মতাবলম্বী। সংখ্যালঘু হিসেবে রয়েছে কপটিক খ্রিস্টানরা, যারা মিশরের প্রাচীন খ্রিষ্টীয় ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। রাষ্ট্রীয় ভাষা আরবি, যদিও ইংরেজি ও ফরাসি শিক্ষা ও ক‚টনৈতিক অঙ্গনে ব্যবহৃত হয়।
মিশরের রাজনৈতিক ইতিহাস বহুস্তর বিশিষ্ট। আধুনিক মিশরের জন্ম বলা হয় ১৯৫২ সালের সামরিক বিপ্লবের পর থেকে। ফ্রি অফিসার মুভমেন্টের মাধ্যমে রাজা ফারুককে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়ে দেশকে রাজতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্রে রূপান্তর করেন সামরিক কর্মকর্তারা। নেতৃত্বে ছিলেন তরুণ ও দৃঢ়চেতা কর্মকর্তা জামাল আবদেল নাসের, যিনি পরে হয়ে ওঠেন আরব জাতীয়তাবাদের প্রতীক। তবে মিশরের ইতিহাস শুধুমাত্র আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই দেশের মাটি জড়িয়ে আছে অতি প্রাচীন ধর্মীয় ও ঐশী ইতিহাসের সঙ্গে বিশেষ করে নবী মুসা (আ.) ও ফেরাউনের কাহিনির মাধ্যমে, যা কুরআন, বাইবেল ও তোড়াতে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবৃত হয়েছে। নবী মুসা (আ.)-এর ইতিহাস মূলত এক নিষ্ঠুর শাসকের বিরুদ্ধে এক নবীর ঈশ্বরপ্রাপ্ত প্রতিবাদের কাহিনি। মিশরের এক নির্দয় ফেরাউন দাবি করত সে-ই ঈশ্বর।
সে আদেশ দেয়, যেন সব নবজাতক ইসরাঈলীয় পুরুষ শিশু হত্যা করা হয়, যাতে তার সিংহাসনকে কেউ ভবিষ্যতে চ্যালেঞ্জ না করতে পারে। সেই পটভ‚মিতেই জন্ম নেন নবী মুসা (আ.)। তার মা তাকে নদীতে একটি ঝুঁড়িতে ভাসিয়ে দেন, আর স্রোত তাকে পৌঁছে দেয় ফেরাউনের প্রাসাদে। সেখানেই ফেরাউনের স্ত্রী তাকে লালনপালন করেন। মুসা (আ.) বড় হয়ে এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িয়ে মিশর ত্যাগ করেন এবং মাদায়ানে গমন করেন। সেখানে তিনি আল্লাহর ওহি লাভ করেন ও নবুওয়াত প্রাপ্ত হন। এরপর তিনি ফেরাউনের কাছে ফিরে আসেন এবং তার কাছে সত্য ধর্ম ও একত্ববাদের বার্তা পৌঁছে দেন। কিন্তু ফেরাউন তা অস্বীকার করে এবং মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের উপর নির্যাতন চালায়। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর নির্দেশে মুসা (আ.) তাঁর জাতিকে নিয়ে মিশর ত্যাগ করেন। ফেরাউন সেনাবাহিনী নিয়ে তাদের অনুসরণ করে এবং লোহিত সাগরের তীরে এসে পৌঁছায়। সাগর আল্লাহর আদেশে মুসার জন্য দ্বিখণ্ডিত হয়ে পথ করে দেয়, আর ফেরাউন সেই পথে প্রবেশ করে নিজেই পানিতে ডুবে ধ্বংস হয়। এই ঘটনা শুধুমাত্র ধর্মীয় ইতিহাস নয়, মিশরের আত্মপরিচয়ের একটি শিকড়, যদিও আধুনিক মিশরের ক্ষমতাধর গোষ্ঠী এই ইতিহাসকে ধামাচাপা দিয়ে রাখে, কারণ এটি নিপীড়ন ও ক্ষমতার অবমাননার প্রতীক হিসেবেই পরিগণিত হয়। মুসা (আ.) ও ফেরাউনের এই কাহিনি প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি শাসকের সামনে এক সতর্কবার্তা-যে স্বৈরশাসন ও অহংকার চূড়ান্ত পরিণতিতে ধ্বংসের দিকেই নিয়ে যায়।
আজকের মিশরে এই ধর্মীয় ইতিহাসের আবেদন যতটা সাধারণ মানুষের অন্তরে, রাজনৈতিক শাসনে তার প্রতিফলন ততটাই অনুপস্থিত। মিশরের বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা কার্যত একটি সামরিক রাষ্ট্র, যার নেতৃত্বে রয়েছেন আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি। ২০১৩ সালে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসিকে হটিয়ে তিনি ক্ষমতায় আসেন এবং সেনা-সমর্থিত নতুন শাসনের মাধ্যমে নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। মুরসির শাসনকাল ছিল মুসলিম ব্রাদারহুডের উত্থানের এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ, যেটি কিছুটা হলেও ফিলিস্তিনি ইস্যুতে আন্তরিক সহানুভূতি দেখিয়েছিল। কিন্তু সামরিক অভ্যুত্থানের পর সেই ধারা পুরোপুরি উল্টে যায়। আধুনিক মিশরের পররাষ্ট্রনীতি এখন ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক। গাজা উপত্যকার সঙ্গে থাকা ‘রাফাহ ক্রসিং’ প্রায়ই বন্ধ রাখা হয়, খাদ্য, চিকিৎসা ও ত্রাণ প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে মিশরীয় প্রশাসন। এই রকম ভ‚মিকায় জনগণের একাংশ ভীষণ ক্ষুব্ধ, কারণ মিশর ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিনিদের সমর্থক ছিল এবং তাদের মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিল একাধিকবার। কিন্তু আজকের মিশর সেই পথ থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে। ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির পর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েল-মিশর সম্পর্ক এক গভীর সামরিক ও কূটনৈতিক বন্ধনে রূপ নিয়েছে, যেখানে ইসরায়েলের নিরাপত্তা মিশরের কাঁধে তুলে দেওয়া হয়েছে।
মিশর ও ইসরায়েল দুটি দেশের নাম, যারা এক সময় পরস্পরের রক্তপিপাসু শত্রু ছিল, অথচ আজ তাদের সম্পর্ক এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে রাজনৈতিক কূটনীতি ও কথিত শান্তির আড়ালে চলছে এক নতুন ধরনের গোলামি, যাকে মিশরের জাতীয়তাবাদী চেতনার পরাজয় হিসেবেই দেখা যায়। এক সময়ের বীর নেতৃত্ব জামাল আবদেল নাসেরের মিশর আজ আর নেই। এখনকার মিশর বাস্তবিক অর্থে ইসরায়েলের ছায়াসঙ্গী এবং মার্কিন আধিপত্যের আনুগত্যে পরিচালিত একটি রাষ্ট্র মাত্র। এই লেখায় আমরা মিশর-ইসরায়েল সম্পর্কের নানা ধাপ বিশ্লেষণ করব প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ থেকে শুরু করে আধুনিক সময়ের সিসি সরকারের অধীনে সম্পর্কের পরিণতি পর্যন্ত। ১৯৪৮ সালের প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ ছিল একটি ঐতিহাসিক মোড়। ব্রিটিশ ম্যান্ডেটভুক্ত ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণার পরপরই একযোগে মিশর, সিরিয়া, জর্দান, লেবানন ও ইরাকের সেনাবাহিনী ফিলিস্তিনে প্রবেশ করে। তাদের লক্ষ্য ছিল সদ্যঘোষিত ইসরায়েল রাষ্ট্রকে ধ্বংস করা। কিন্তু সংঘাতের ফলাফল হলো আরবদের পরাজয় এবং প্রায় আট লাখ ফিলিস্তিনির বাস্তুচ্যুতি। মিশরের সামরিক ব্যর্থতা জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে এবং এই যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে আবির্ভূত হয় এক নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব-যার প্রধান ছিলেন জামাল আবদেল নাসের।
নাসের ছিলেন একজন বিশিষ্ট প্যান-আরব নেতা। তিনি আরব জাতীয়তাবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন এবং ইসরায়েলবিরোধী অবস্থানকে শক্তিশালী করেন। তার নেতৃত্বেই ঘটে ১৯৫৬ সালের সুয়েজ সংকট। ওই বছর মিশর সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করলে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরায়েল মিলে মিশরে হামলা চালায়। এই হামলার পেছনে কারণ ছিল পশ্চিমা শক্তির অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ এবং ইসরায়েলের দক্ষিণে সিনাই উপদ্বীপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপ, বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে আগ্রাসী শক্তিগুলো পিছু হটে এবং নাসেরকে বিজয়ী হিসেবে দেখা হয়। এই বিজয় আরব বিশ্বের মধ্যে নাসেরের জনপ্রিয়তা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়, যদিও সামরিকভাবে মিশর তখনও দুর্বলই ছিল। তবে ইতিহাসের সবচেয়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধ। ইসরায়েলের পূর্বাভাস ও পরিকল্পনার মাধ্যমে এই যুদ্ধ শুরু হয়। মাত্র ছয় দিনের মধ্যেই মিশর, সিরিয়া ও জর্দানের সম্মিলিত বাহিনীকে চূর্ণ করে ইসরায়েল। মিশরের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক পরিণতি ছিল সিনাই উপদ্বীপের সম্পূর্ণ দখল। সেই সঙ্গে গাজা উপত্যকা, পশ্চিম তীর ও গোলান মালভ‚মিও চলে যায় ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে। এই পরাজয়ের পর নাসের জাতির কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন এবং পদত্যাগের ঘোষণা দেন, যদিও পরবর্তীতে জনতার দাবিতে তিনি আবার ক্ষমতায় ফিরে আসেন। কিন্তু মিশরের ইসরায়েলবিরোধী তেজ ধীরে ধীরে স্তিমিত হতে থাকে। ১৯৭০ সালে নাসেরের মৃত্যু সেই অধ্যায়ের ইতি টানে।
এরপর আসে আনোয়ার সাদাতের যুগ। সাদাত আরব বিশ্বের মধ্যে এক ভিন্নমত পোষণকারী নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ১৯৭৩ সালে তিনি একটি নতুন লড়াই শুরু করেন-যা ইতিহাসে ‘ইমাদ-আল-রামাদান’ বা ‘যম কিপুর যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে আরব বাহিনী প্রথমদিকে সাফল্য পেলেও পরে ইসরায়েল আবারও কৌশলগত দিক থেকে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। তবে এই যুদ্ধেই আরব বিশ্ব তেলকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। সৌদি আরব ও অন্যান্য তেলসমৃদ্ধ দেশ পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে তেল রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যার ফলে তীব্র জ্বালানি সংকট দেখা দেয় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে। এই তেল যুদ্ধ একদিকে আরব রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক শক্তি দেখালেও, অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থনে ইসরায়েল আরও বেশি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠল। ১৯৭৮ সালে একটি যুগান্তকারী চুক্তি হয় ‘ক্যাম্প ডেভিড অ্যাকর্ড’। এই চুক্তির মাধ্যমে মিশর প্রথম আরব রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। আর বিনিময়ে মিশর পায় সিনাই উপদ্বীপ ফিরে পাওয়ার প্রতিশ্রুতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ও সামরিক সহায়তা। আনোয়ার সাদাত ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী মেনাখেম বেগিনকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের মধ্যস্থতায় এ চুক্তিতে আনা হয়। যদিও আন্তর্জাতিক পরিসরে একে শান্তির পথে অগ্রগতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়, কিন্তু আরব বিশ্ব এবং মিশরের জনগণের মধ্যে এটি বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবেই প্রতিভাত হয়। সাদাতকে অবশেষে তাঁর এই ভূমিকাই জীবন দিয়ে মূল্য দিতে হয় ১৯৮১ সালে এক সামরিক প্যারেডে তাকে হত্যা করে এক উগ্রপন্থী সেনা কর্মকর্তা।
সাদাতের পর ক্ষমতায় আসেন হোসনি মুবারক। মুবারক ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে মিশর শাসন করেন, কিন্তু তার সময়কালে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক আরও গভীর হয়। মিশর পরিণত হয় একটি আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েল-মিত্র রাষ্ট্রে, যদিও জনগণের মনে ইসরায়েলবিরোধী মনোভাব বজায় থাকে। মুবারক প্রশাসন সবসময় ইসরায়েলের প্রতি একধরনের সহনশীলতা ও কূটনৈতিক আনুগত্য বজায় রাখে। ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার সময়, বিশেষত গাজা অবরোধের সময় মিশরের ভ‚মিকা ছিল নিঃসন্দেহে প্রশ্নবিদ্ধ। ‘রাফাহ’ সীমান্ত ক্রসিং প্রায় সময়ই বন্ধ রাখত মিশরীয় বাহিনী, ফলে গাজার সাধারণ জনগণ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ২০১১ সালের আরব বসন্ত আন্দোলন মিশরের ইতিহাসে এক মোড় ঘোরানো অধ্যায়। দীর্ঘদিনের মুবারক শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র গণআন্দোলনের ফলে তার পতন ঘটে। মুসলিম ব্রাদারহুডের মুহাম্মদ মুরসি নির্বাচিত হন গণতান্ত্রিকভাবে। তাঁর শাসনামলে ফিলিস্তিন প্রশ্নে কিছুটা সহানুভূতিশীল মনোভাব দেখা গেলেও, তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সেনাবাহিনীর প্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং নিজেই রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হন। তখন থেকেই মিশর আবারও ফিরে যায় আগের সামরিক রাজনীতির ধারায়।
আধুনিক মিশরের এই শাসক সিসি একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের ঘনিষ্ঠ মিত্র, অন্যদিকে ইসরায়েলের সাথে ঘনিষ্ঠ গোপন সম্পর্ক বজায় রাখেন। তাঁর শাসনামলে ইসরায়েলের সাথে মিশরের নিরাপত্তা সহযোগিতা বেড়েছে অনেকগুণ। সিনাই অঞ্চলে জঙ্গি দমন অভিযানের নামে ইসরায়েলের ড্রোন ব্যবহার এবং যৌথ সামরিক উদ্যোগ চলতে থাকে। গাজা সীমান্তে রাফাহ ক্রসিংয়ের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে সিসি সরকার। এমনকি ২০১৪ সালের গাজা যুদ্ধের সময়ও মিশর ইসরায়েলকেই কার্যত সহযোগিতা করে এবং ফিলিস্তিনিদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপে অংশ নেয়। সেই সময় গাজার বহু চিকিৎসাসামগ্রী এবং খাদ্য প্রবেশেও বাধা সৃষ্টি করে মিশর।
এখানে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন উঠে আসে কীভাবে নাসেরের সেই গর্বিত ও ইসরায়েলবিরোধী মিশর, যেটি একসময় তেলকে অস্ত্র বানিয়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে লড়েছিল, আজ সেই ইসরায়েলের নিরাপত্তার রক্ষী হয়ে দাঁড়ালো? মিশরের এই পরিণতি মূলত তিনটি কারণকে নির্দেশ করে: এক. পশ্চিমা অর্থনৈতিক সহায়তার প্রতি নির্ভরতা; দুই. স্বৈরাচারী সামরিক শাসন; এবং তিন. গণতন্ত্র ও জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারের অনুপস্থিতি। এই তিনটি উপাদান মিশরকে একটি কথিত শান্তিপ্রিয় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পরাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করেছে, যার পররাষ্ট্রনীতির একটি বড় অংশ নির্ধারিত হয় ওয়াশিংটন ও তেলআবিবে।
আজ মিশরের গণমাধ্যম, শিক্ষা ব্যবস্থা এবং নিরাপত্তা প্রশাসনে এমন এক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, যেখানে ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলা বা ইসরাইয়েলের সমালোচনা করা প্রায় অপরাধের শামিল। আন্তর্জাতিক পরিসরে মিশর ফিলিস্তিন প্রশ্নে যতটা মুখে সমর্থন জানায়, তার বিপরীতে কার্যত ইসরায়েলের স্বার্থকেই রক্ষা করে চলে। গাজার কোনো রকম উত্তেজনার সময় মিশরের দৌত্যনীতি ইসরায়েলের শর্তে পরিচালিত হয় এবং হামাসকে চাপে রাখাই তাদের লক্ষ্য হয়। সব মিলিয়ে মিশর-ইসরায়েল সম্পর্কের এই রূপান্তর আরব বিশ্বের জন্য এক দুঃখজনক ও লজ্জার ইতিহাস। এক সময়ের প্রতিরোধের প্রতীক মিশর এখন আর প্রতিরোধে নেই। বরং ভ্রাতৃপ্রতিম ফিলিস্তিনিদের কষ্টের সময় চোখ ফিরিয়ে রাখা, তাদের ওপর অবরোধ আরোপে সহযোগিতা করা এবং ইসরায়েলকে মধ্যপ্রাচ্যে টিকিয়ে রাখার জন্য কার্যকর সহায়তা করাই আজকের মিশরের পরিচয়। এই ইতিহাস কেবলই রাজনৈতিক চুক্তি বা সামরিক পরাজয়ের ফল নয়, এ এক জাতীয় আত্মবিক্রয়, যা শুরু হয়েছিল ক্যাম্প ডেভিডে আর এখনও চলছে কায়রোর ক্ষমতার অলিন্দে।
সবমিলিয়ে মিশরের রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো এবং অর্থনীতিও পশ্চিমা অনুদানে নির্ভরশীল। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রতিবছর প্রায় দেড় বিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা পায় মিশর, যার বেশিরভাগই সামরিক খাতে। সুয়েজ খালের কৌশলগত অবস্থান এবং সিনাই অঞ্চলের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ইসরায়েলের সহযোগী হিসেবে মিশরের ভূমিকা স্পষ্ট। বিশেষত সিনাইতে তথাকথিত সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে ইসরায়েল ও মিশরের যৌথ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, যার ফলে সে অঞ্চল কার্যত আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা চুক্তির পরীক্ষাগার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবশেষে, মিশরের ভূখণ্ড যেখানে একদা ফেরাউনদের অহংকার ছিল, যেখানে নবী মুসা (আ.) আল্লাহর পক্ষ থেকে নিপীড়িত জাতিকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিলেন, সেই মাটিতেই আজ চলে আধিপত্যের নতুন ফেরাউনী সংস্করণ। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, সামরিক উন্নয়ন কিংবা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যতই থাকুক, মিশরের আত্মা যেন হারিয়ে গেছে এক নিঃসাড় কূটনৈতিক মিছিলে, যেখানে ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষা করা, ফিলিস্তিনিদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা এবং নিজ জনগণের ধর্মীয় আবেগকে চেপে রাখা হয়ে উঠেছে নতুন রাষ্ট্রনীতির বাস্তবতা। এটি শুধুমাত্র এক রাষ্ট্রের ট্র্যাজেডি নয়, বরং পুরো আরব বিশ্বের রাজনৈতিক পতনের এক প্রতীক, যেখানে ইতিহাসের শিক্ষা মুছে ফেলে বর্তমানের স্বার্থই একমাত্র মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়।
লেখক : উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সরাইল।
- বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bkeditorial247@gmail.com
এমআই