
নৃশংস-পাশবিক ঘটনাটা ঘটল বুধবার সন্ধ্যায়। জানাজানি হলো দু’দিন পর শুক্রবার। এক সহকর্মী জানালেন, নিউজরুমের ক্রাইম রিপোর্টার রেগে আগুন। আগের দিনে দেওয়া নিউজ ছাপা না হওয়ায়। ফেসবুকে সদাসক্রিয় একজনের পোস্টে দেখলাম, নিউজটি কিল করতে চেয়েছে সংবাদমাধ্যম। আরেক পোস্টে দেখলাম, ঘটনার প্রতিবাদে ৫০ বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তেজনা। মধ্যরাতে স্লোগানে উত্তাল ক্যাম্পাসের পর ক্যাম্পাস। অথচ সংবাদমাধ্যমে ব্ল্যাকআউট। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইভ দিচ্ছেন আন্দোলনকারীরা।
কয়েকজন পোস্ট করেছে, জুলাই আন্দোলনে বিভৎস গণহত্যার ঘটনায় দু-একটি বাদে সব সংবাদমাধ্যমও নীরব হয়ে গিয়েছিল। তখন তারা আওয়ামী লীগের প্রতি ভক্তি বা ভয়ের কারণে এমনটা করেছিল। আর মিডফোর্ডের ঘটনায় বিএনপির প্রতি ভয় বা ভক্তিতে ঘটনা চেপে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। তবে বিকল্প গণমাধ্যম বা সংবাদমাধ্যম হিসেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন দাঁড়িয়ে গেছে। মূলধারার সংবাদমাধ্যমের মেরুদণ্ড হারানোকে তারা সামনে আনছে।
অবাক লাগছে, সংবাদমাধ্যমের রোগটা কোথায়? সেই রোগের নামটাই বা কী? জানা ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ডও কি রাজনীতির মারপ্যাঁচে পড়ে যায়? যেতে পারে? প্রচলিত সত্য হচ্ছে, সংবাদমাধ্যম সবসময় সরকারবিরোধী, ক্ষমতা-দাম্ভিকতাবিরোধী। অথচ প্রায় সব সংবাদমাধ্যম এখন ক্ষমতাসীন অথবা ক্ষমতায় যাবে এমন দলের বেডরুমে শুয়ে পড়ার সুখ উপভোগের নীতি নিয়েছে।
বিগতকালে বেশিরভাগ সাংবাদিক ক্লান্ত হয়ে ক্ষমতার বেডরুমে শুয়ে পড়েছিলেন। এমনকি ধ-র্ষ-ণ অনিবার্য ভেবে তারা উপভোগ করার অভ্যাসও গড়ে তুলেছিলেন। সেই অভ্যাস যায়নি। বরং এখন তো দেখা যাচ্ছে বেডরুম দেখলেই তাদের আত্মসমর্পণের উত্তেজনা বেড়ে যাচ্ছে। ধ-র্ষি-ত হওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকছে। আগে নিউজরুমের যেসব চেয়ারে আওয়ামীবাদীরা পা নাচাতেন, সেসব চেয়ারে এখন বিএনপি-জামায়াতিবাদীরা ধ-র্ষ-ণের শিকার হওয়ার জন্য উত্তেজিত।
সংবাদমাধ্যমের এটা একটা ট্রমা বটে। এমন ট্রমা সিনড্রোম নিয়ে চলা সংবাদমাধ্যম গত ৫ আগস্টের পর আরও বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়েছে। আন্দোলনকারী ছাড়াও নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরা উলঙ্গভাবে বিগত সরকারের পক্ষ নেওয়া সংবাদমাধ্যমের ওপর হামলে পড়েছে। তছনছ করে দিয়েছে অফিসগুলো। এতে প্রচণ্ডরকম সংবেদনশীল হয়ে পড়েছে সংবাদমাধ্যমগুলো।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আগে সংবাদমাধ্যমের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছিল। তারপর পরমবন্ধু হিসেবে বুকে টেনে নিয়েছিল। সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার সেই কৌশলই শেষ অবধি তাদের পতন ঘটিয়ে দিয়েছে। শত শত তারকা সাংবাদিকের জীবন নষ্ট হয়ে গেছে। ঠিক একইভাবে বিএনপির প্রতি এখন রোলপ্লে করছে মেরুদণ্ড ফিরে না পাওয়া সংবাদমাধ্যম। আখেরে যারা বিএনপিকেও সার্ভ করার মতো বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।
এমন বাস্তবতায়, ভারসাম্যহীন সংবাদমাধ্যম বিষয়ে ক্ষমতামুখী রাজনৈতিক দলগুলোর সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গির বদল আনতে হবে। আগে সংবাদমাধ্যমকে সুস্থ করে তুলুন। তাদের স্বকীয়তা ফিরিয়ে দেওয়ার পরিবেশ তৈরি করুন। গণমাধ্যমের জন্য সংস্কার প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করুন। আর বিগত সরকারের আমলের মতো বিএনপি বা অন্যসব রাজনৈতিক দলের প্রতি যেসব সাংবাদিকের অন্ধ মোহ তৈরি হয়েছে তারা ফিরে আসুন।
ভালো সাংবাদিকতা না থাকলে দলগুলো আপনাকে যেকোনো মুহূর্তেই ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলতে দ্বিধা করবে না। তাই সবার আগে প্রবল দেশপ্রেমিক, নির্মোহ, সাহসী সাংবাদিকতার পথ তৈরি করুন। দলের প্রতি অন্ধভক্তি থেকে প্রতিপক্ষের সংবাদ পরিহার বন্ধ করুন। বাইনারি বা ট্যাগিংয়ের রাজনীতির অবসান ঘটান।
দালালি গোপনে করুন, নিউজরুমের বাইরে গিয়ে। নিরপেক্ষ, দলপন্থি নয়, দেশপন্থি শক্তিশালী সংবাদমাধ্যমই পারে রাজনৈতিক নৃশংসতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে। শুধু রাষ্ট্র বা সরকার নিয়ে মত্ত না থেকে সংবাদমাধ্যমকে সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তনে বেশি মনোযোগী করে তুলুন। তবে দেশ মুক্তি পাবে।
লেখক : সাংবাদিক
- বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bkeditorial247@gmail.com