Logo

মতামত

চাপাতি থেকে রড, শেষে পাথর বাহিনী

Icon

আবু জায়েদ আনসারী

প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৫, ১৮:৫৪

চাপাতি থেকে রড, শেষে পাথর বাহিনী

প্রতীকী ছবি (এআই দিয়ে তৈরি)

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিংসতার রেশ কাটছে না। নানা ঘটনা রাজনীতিকে বিতর্কিত করে তুলছে, সেই সঙ্গে দলীয় ভাবমূর্তিকেও ক্ষুণ্ন করছে। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর মানুষ আশায় বুক বাঁধলেও, তা দিনে দিনে ফিকে হয়ে যাচ্ছে। গৌরবগাঁথা অভ্যুত্থানের চেতনায় এখন চাঁদাবাজি, সহিংস মব, হত্যাকাণ্ডের কালিমা লেপনের আশঙ্কা বাড়ছে। নব্য ফ্যাসিবাদী মোড়ক থেকে বের হওয়ার প্রয়াস পরিলক্ষিত হলেও, তা যথেষ্ট নয়।

দীর্ঘ প্রায় ১৭ বছরের মব ও স্বৈরশাসনের অবসানের পর নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের তোড়জোড় চলছে। এর মধ্যেই একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার সাম্যর পর খুলনায় যুবদল থেকে বহিষ্কৃত এক নেতার হত্যা এবং সর্বশেষ রাজধানীর পুরান ঢাকায় মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে পিটিয়ে ও পাথর মেরে হত্যার ঘটনা সে কথাই বলছে। সামাজিক মাধ্যমে এই ঘটনাটি ব্যাপক ভাইরাল হয়। বিএনপির সহযোগী সংগঠনের কিছু নেতাকর্মী এতে জড়িত থাকলেও দলটি তাদের বহিষ্কার করেছে। তবে এতেই কি পরিস্থিতির উত্তরণ সম্ভব? আদতে তা নয়।

সোহাগ হত্যাকাণ্ডের পেছনে চাঁদাবাজির ঘটনা জড়িত। তিনি চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এর আগে, পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে হরতালের সময় ছাত্রলীগের চাপাতির কোপে প্রাণ হারান হিন্দু যুবক বিশ্বজিৎ। আরও আগে, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা লগি-বৈঠা দিয়ে পল্টনে প্রকাশ্য দিবালোকে ছয়জন মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করে, এমনকি লাশের উপর নৃত্য করে। বর্বর সেই দৃশ্য গোটা বিশ্বকে হতবাক করে তোলে। এসব ঘটনা মূলত রাজনীতির দুষ্কৃত চরিত্রকে তুলে ধরে।

রাজনৈতিক মতাদর্শের ব্যর্থতার কারণেই এমন বর্বরতার পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে। কর্মীরা আদর্শের কথা বললেও স্বার্থের দ্বন্দ্বে তারা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এমন রাজনীতি জাতির কতটুকু উপকারে আসবে, এখনই সে ভাবনার সময়।

অভ্যুত্থান-পরবর্তী নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কার প্রস্তাবনা নিয়ে কাজ করছে, বিশেষ করে ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়নের যে পদক্ষেপ নিয়েছে—তা দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করার বিকল্প নেই।

২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলন, যাকে আমরা বিপ্লব বা অভ্যুত্থান বলি—তার মূল উদ্দেশ্য ছিল গতানুগতিক ধারাকে ছুড়ে ফেলে এক নতুন বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠা। যদি তা বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে সেই অভ্যুত্থান কেবল শহীদের সংখ্যা আর অতীত রাজনৈতিক ব্যর্থতার ধারায় যুক্ত হয়ে একটি পর্ব মাত্র হয়ে থাকবে। এই ব্যর্থতা জাতিকে বিভাজনের দিকে ঠেলে দিতে পারে।

এই অভ্যুত্থানে দেশের শিক্ষার্থী, ছাত্রসংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলো ছিল প্রধান স্টেকহোল্ডার। কেউ আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে, কেউ জীবন দিয়েছে, আবার কেউ বুদ্ধিবৃত্তিক ভূমিকা রেখে আন্দোলনের বিজয় নিশ্চিত করেছে। এখন সকলের দায়িত্ব নতুন বন্দোবস্ত নিশ্চিত করা। স্বার্থের দ্বন্দ্বে বিভাজন সৃষ্টি করে যদি বিপ্লবকে ম্লান করা হয়, তবে তা হবে আত্মঘাতী।

রাষ্ট্রীয় সংস্কারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ সংস্কারও জরুরি। কারণ যাদের নিয়ে দল—তারাই যদি খুনি, চাঁদাবাজ, ধর্ষক বা টেন্ডারবাজ হয়ে ওঠে, তাহলে রাজনীতির প্রায়োগিক ফল সাধারণ মানুষ বা রাষ্ট্র কিছুই পাবে না। বরং, সৃষ্টি হবে নৈরাজ্য ও অশান্তির।

স্বৈরশাসনের আমলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি এমন একটি মানসিকতা গড়ে তোলে, যেখানে নিজের দলের অপকর্মও বৈধতা পায়। এই মনোবৃত্তি থেকে বের হতে না পারলে রাজনৈতিক পরিবেশের উন্নতি সম্ভব নয়। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য কেবল ক্ষমতালাভ নয়, প্রয়োজন সততা, নীতিশিক্ষা ও সময়োপযোগী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা।

বর্তমান বাস্তবতায় তরুণ শিক্ষার্থীরা যেমন উদ্বিগ্ন, তেমনি সাধারণ মানুষও হতাশ। আসন্ন নির্বাচনে তারা কাকে বিশ্বাস করবে, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন। নেতৃত্বের এই দেউলিয়াত্ব জনগণকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষায় কে হবে জাতির আস্থার কেন্দ্র—এখন সেটি পরিষ্কার নয়।

গত রাতে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছে। আজও কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মসূচি রয়েছে। পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামী, খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠন প্রতিবাদ জানিয়েছে। এ থেকেই প্রমাণ হয়, হত্যাকাণ্ড কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। এটি সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। এসব নির্মমতার পুনরাবৃত্তি রোধে জরুরি রাজনৈতিক সংস্কার, রাষ্ট্র কাঠামোয় সংস্কার, নীতিগত ও দলীয় সংস্কার।

এই অভ্যুত্থান যেন কেবল ক্ষমতা পরিবর্তনের প্রতীক না হয়—বরং নতুন রাষ্ট্র বিনির্মাণের ক্ষেত্রে একটি কার্যকর পদক্ষেপ হয়, সেটিই হওয়া উচিত সকল অংশীজনের লক্ষ্য। এখানে আপসের কোনো সুযোগ নেই।

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক 

  • বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bkeditorial247@gmail.com

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

চাঁদাবাজি

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর