Logo

মতামত

বাংলাদেশে রাজনীতির ছায়া রাজতন্ত্র : রাজবংশ ও গণতন্ত্র

Icon

মো. খশরু আহসান ও মো. কৌশিক শাহরিয়ার

প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২৫, ১৬:২৭

বাংলাদেশে রাজনীতির ছায়া রাজতন্ত্র : রাজবংশ ও গণতন্ত্র

বাংলাদেশ একটি ভূখণ্ড হিসেবে একাধিকবার গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে। তবে বাস্তবে, দেশটি সবসময়ই এক ধরনের বংশগত রাজনৈতিক দলগুলোর শাসনের অধীনে ছিল। আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’র মতো প্রভাবশালী দলগুলোর মাধ্যমে ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে স্থানীয় নির্বাচনগুলো রাজনৈতিক রূপ পেতে শুরু করে। এর ফলে বহুদলীয় রাজনীতির উত্থান ঘটে এবং ২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে রাজনৈতিক দলগুলো এই নির্বাচনগুলোকে তাদের তৃণমূল আন্দোলনের শক্তি প্রদর্শনের মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে।

২০১৫ সালে সরকার যখন স্থানীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রতীক ব্যবহারের অনুমতি দেয়, তখন এই প্রবণতা আরও বেগবান হয়। এর ফলে জাতীয় নির্বাচনের বড় অংশের ওপর তৃণমূল পর্যায়ের রাজনীতির প্রভাব বাড়তে থাকে।

ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতে পারিবারিক নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দলগুলো বহুল প্রচলিত। উদাহরণ হিসেবে ভারতে নেহরু-গান্ধী পরিবার, পাকিস্তানে ভুট্টো-জারদারি পরিবার এবং শ্রীলঙ্কায় বন্দারনায়েক ও রাজাপাকসে পরিবার উল্লেখযোগ্য। দক্ষিণ কোরিয়ার পার্ক পরিবার একটি উল্টো দৃষ্টান্ত, যেখানে নাগরিক আন্দোলন ও নির্বাচনের মাধ্যমে রাজবংশীয় শাসনের অবসান ঘটানো সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে, ফিলিপাইনের মার্কোস পরিবার রাজতন্ত্রের সঙ্গে জড়িত দুর্নীতি কেলেঙ্কারি ও স্বৈরশাসনের চিত্র তুলে ধরলেও, বর্তমানে দেশটি একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিচালিত হচ্ছে।

দক্ষিণ এশীয় রাজনীতিতে বংশগত নেতৃত্বকে অনেক সময় আধুনিক রাজতন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করা হয়। এমন রাজনৈতিক দলগুলো বাহ্যত শক্তিশালী হলেও, তারা অভ্যন্তরীণ সংকট এবং আন্তর্জাতিক চাপের মুখে দুর্বল হয়ে পড়ে। এক ভারতীয় পত্রিকায় একবার মন্তব্য করা হয়েছিল নেহরু-গান্ধী পরিবারের প্রসঙ্গে, ‘রাজবংশের পতন হয় নির্মমভাবে।’ এই পরিবারটির দুই প্রজন্মই সহিংস মৃত্যুর শিকার হয়েছেন। একই রকম পরিস্থিতি দেখা যায় ভুট্টো পরিবারের ক্ষেত্রেও—হত্যা, নিখোঁজ, নির্বাসিত হওয়ার মতো ঘটনা তাদের রাজনীতিতে বারবার ঘটেছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটি সবচেয়ে প্রভাবশালী নাম। উভয় দলই তাদের প্রতিষ্ঠাতাদের বংশধরদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা, গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন। অন্যদিকে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং বর্তমানে তাদের পুত্র তারেক রহমান লন্ডনে স্বেচ্ছা-নির্বাসনে থেকেও কার্যত দল পরিচালনা করছেন বলে ধারণা করা হয়।

বর্তমান রাজনৈতিক আলোচনায় বিএনপির নাম বারবার উঠে আসে। তবে আগামী নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগকে কীভাবে বিবেচনা করা হবে, তা এখনো একটি প্রশ্ন। বিশেষ করে শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনকাল এবং তার ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ভূমিকা অনিশ্চিত হওয়ার কারণে বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

এই পরিস্থিতিকে ‘ছায়া রাজতন্ত্র’ বলা যায়। এতে দেখা যায়, রাজনৈতিক ক্ষমতা সীমিত কিছু পরিবারের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে। যদিও এসব শাসনব্যবস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে রাজতন্ত্র নয়, তথাপি কার্যত সেগুলোর অভ্যন্তরীণ কাঠামো অনেকাংশেই রাজতন্ত্রের মতো। এর ফলে রাজনৈতিক জবাবদিহিতা দুর্বল হয় এবং জনগণের অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয়।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এই ধরনের শাসনের বিরুদ্ধে বহুবার গণআন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৯০ সালের আন্দোলনে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ পতিত হন। ২০০৬-২০০৮ সালের রাজনৈতিক সংকট মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং দুর্নীতির ফল, যা সামরিক হস্তক্ষেপ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে সমাধান করা হয়। ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলন এবং ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনও দেখিয়েছে—যখন রাজনৈতিক ক্ষমতা বেশি কেন্দ্রীভূত হয়, তখন সাধারণ জনগণের অসন্তোষ বাড়ে এবং গণআন্দোলনের জন্ম নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ঘটনাবলি আমাদের সামনে একটি নতুন চিত্র তুলে ধরে।

গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান ভিত্তি হলো নেতৃত্বের পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন, যা ধারণা, যোগ্যতা ও জনসমর্থনের ভিত্তিতে ঘটতে হয়। কিন্তু যখন রাজনৈতিক বিকল্পের তালিকায় বারবার একই পরিবারের নাম উঠে আসে, তখন গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত হয়। তাই এই অবস্থাকে ‘ছায়া রাজতন্ত্র’ বলাটা যথার্থ। এটি শুধুমাত্র একটি শব্দচয়ন নয়, বরং এটি একটি বাস্তব রাজনৈতিক সংকটকে নির্দেশ করে—গণতান্ত্রিক বিকল্পের অভাব এবং কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার বাস্তবতা।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার দীর্ঘদিন ধরে বংশানুক্রমিক রাজনৈতিক দলগুলোর অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। এতে জনগণের রাজনৈতিক বিকল্প সীমিত হয়ে পড়েছে। অনেক ছোট দলও বিদ্যমান, কিন্তু বড় দলগুলো তাদের প্রভাব বিস্তার ও সুবিধার মাধ্যমে ছোট দলগুলোকে কোণঠাসা করে রাখে। সাম্প্রতিক সময়ে শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনের পর বিএনপি স্বভাবতই ধরে নিয়েছে, তারা আগামী নির্বাচনে জয়ের সম্ভাবনা রাখে। এই সম্ভবনাকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে এটাও সত্য, বিএনপি এখনো নিজ সংগঠনকে পূর্ণভাবে কার্যকর ও সংগঠিত করতে পারেনি।

জনগণের মতামত জানা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে নির্বাচনের প্রাক্কালে। বর্তমানে জনগণের একটি বড় অংশ দীর্ঘমেয়াদী অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন করছে বলে জানা যাচ্ছে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে—এই সমর্থন কি শুধুই জুলাইয়ের গণআন্দোলনের প্রতিক্রিয়া, নাকি জনগণ সত্যিই আর বংশানুক্রমিক দলগুলোর ওপর আস্থা রাখতে চায় না?

দক্ষিণ এশিয়ায় এই রাজবংশতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামো দুর্বল করে দিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো আদর্শ ও নীতিনির্ধারণী জায়গা থেকে সরে এসে কেবল পরিবারনির্ভর আনুগত্যে পরিচালিত হচ্ছে। এর ফলে জনগণের মৌলিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক দাবি উপেক্ষিত হচ্ছে। শেখ হাসিনার লক্ষ্য ছিল তার পিতার গণতান্ত্রিক স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তার শাসন কাঠামো ব্যক্তি নিরাপত্তা ও ক্ষমতা সংরক্ষণের দিকে মোড় নিয়েছে, যা তাকে স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এ অবস্থার মধ্যেই ‘ছায়া রাজতন্ত্র’ ধারণাটি বাস্তব হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে হলে দলীয় রাজনীতির বাইরে নেতৃত্ব বিকাশে উদ্যোগ নিতে হবে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বহুদিন ধরে রাজনৈতিক মেরুকরণ বজায় রেখেছে, যা নতুন নেতৃত্বের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। নির্বাচনী স্বচ্ছতা, শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র নিশ্চিত করাই হতে পারে এই অবস্থার উত্তরণের একমাত্র পথ। বংশগত শাসনের চক্র ভেঙে এমন একটি নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে, যা কেবল কিছু পরিবার নয়, পুরো জাতির প্রতিনিধিত্ব করবে।

এনসিপিকে বর্তমান সময়ের একটি সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিবেচনা করা যৌক্তিক কি না, তা নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়েছে। গঠনের শুরু থেকেই দলটির মধ্যে কিছু পোলারাইজেশন লক্ষ্য করা গেছে। বাংলাদেশ বা ভারতের মতো দেশগুলোতে রাজনীতি একটি জটিল সমীকরণ। অনেক সময়ই ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থই সাধারণ জনগণের চাহিদার ওপরে স্থান পায়।

মো. খশরু আহসান : শিক্ষার্থী, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

মো. কৌশিক শাহরিয়ার : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

  • বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bkeditorial247@gmail.com

এমএইচএস

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আওয়ামী লীগ বিএনপি জাতীয় নাগরিক পার্টি

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর