-687c7ed402a61.jpg)
ভূমিধস বিজয়ে আওয়ামী লীগ শিবিরে তখন উল্লাস। এর মধ্যেই জরুরি প্রয়োজনে প্রভাবশালী এক নেতার বাসায় গেলাম। ঘরে দেখলাম ঈদের আমেজ। এক ফাঁকে বললেন, ‘রাজনীতির মাঠে অনেক মার খেয়েছি। পরিবার অনেক সাফার করেছে। দল ক্ষমতায় এসেছে। এখন তো টাকা-পয়সা ধরতে হবে।’ আলাপ শেষে বের হয়েই মনে প্রশ্ন, নেতাদের টাকা-পয়সা ধরার পদ্ধতি কী? উড়ে বেড়ায়ই বা কোথায়?কয়েক মাসের মধ্যেই সব পরিষ্কার হতে শুরু করল। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, তদবিরবাজির রিপোর্ট লেখা নিয়ে ক্ষমতাসীন নেতারা আমাদের ব্যস্ত রাখতে শুরু করলেন।
সেটা ছিল ২০০৮ সালের ঘটনা। দেড় দশকের বেশি সময় ক্ষমতায় থেকে ভূমিধস বিজয়ের সেই সরকারের পতন ঘটল ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে। ঘটনার কয়েক মাস পর গেলাম গ্রামে। দেখলাম, দেড় দশকের কোণঠাসা নেতারা জেগে উঠেছেন। তাদের মধ্যে চাপা উত্তেজনা। জেলা, উপজেলার কোন নেতার ‘লেজ’ ধরবেন, তা নিয়ে টেনশন। এক নেতার সঙ্গে নির্মোহ আড্ডার সময় হঠাৎ সেখানে ছুটে এলেন ব্যস্ত আরেক নেতা। আলাপের ফাঁকে বললেন, ‘ফ্যাসিস্টের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে সব হারিয়ে নিঃস্ব। দল ক্ষমতায় আসছে। এবার সব পুষিয়ে নিতে হবে।’
ব্যস্ত নেতার কথা শুনে ১৬ বছর আগের সেই প্রশ্ন মনে আবারও উদয় হলো। আড্ডা শেষে ঘরে ফেরার সময় ভাবলাম, তরুণ নেতাটির সব হারানোর ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার পদ্ধতি তো সেই একটাই। যা আরও সহজ, স্বাভাবিক হয়েছে। গ্রামের ছোট ভাইদের ভাষ্য, ‘দলে পদ পেলেই ব্যাপক ক্ষমতা। আর ক্ষমতা মানেই টাকা।’ এমন দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে গ্রামের বেকার, অর্ধবেকাররা ব্যাপকহারে ক্ষমতামুখী দলে ঝুঁকছেন। পদ পেয়েই এলাকার শাসক, স্থানীয় অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে যাচ্ছেন। হাটবাজার, সিএনজি-বাস-টেম্পুস্ট্যান্ড, সড়ক-মহাসড়ক, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ফুটপাত, সরকারি বরাদ্দ, উন্নয়ন প্রকল্প সব-ই তাদের কাছে টাকার খনি। অভিযোগহীন লুটপাটের মাধ্যমে নেতারা চোখের পলকে গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়ে যান।
২.
নগরসভ্যতার জটিল, কুটিল, সহিংস রাজনীতি ধীরে ধীরে গ্রাম্য মাতবর, ‘টাউটদের’ কবলে পড়ছে। আমজনতার ওপর আস্থা না রেখে দলীয় রাজনীতিতে ঘরে ঘরে কমিটি আর সভাপতি, সেক্রেটারি বানানোর যে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়েছে কয়েক দশক ধরে, তার চরম পরিণতি টের পেতে শুরু করেছেন পল্লির শন্তিকামীরা। আশার কথা, ঐতিহ্যবাহী দলগুলো ভোট আর ক্ষমতার অর্থনীতির বিস্ময়কর যে মডেল তৈরি করেছেন, তার সুবিধা নিতে শুরু করেছেন প্রান্তিক তরুণরাও। যেখানে দলীয় পদ আর ক্ষমতা কনভার্ট হচ্ছে নগদ অর্থে। যে মডেলের বদৌলতে জনগণের ব্যক্তিগত সম্পদ থেকে রাষ্ট্রীয় অর্থ-সম্পদ পর্যন্ত মুহূর্তে নেতাদের হস্তগত হচ্ছে। দলীয় এই অর্থনীতির মডেলেই ক্ষমতাসীন দলের নেতারা ‘আঙুল ফুলে বটগাছ’ হওয়ার স্বপ্ন দেখেন।
সম্প্রতি অনলাইন-অফলাইনে দেশব্যাপী আলোচনার তুঙ্গে চাঁদাবাজির ঘটনা। স্বদলীয় চাঁদাবাজদের বিষয়ে নীরবতা পালন করছেন মাঝারি থেকে শীর্ষ নেতারা। গা বাঁচাতে কেউ যুক্তি দিচ্ছেন, চাঁদাবাজদের কোনো দল নেই। তারা অপরাধী। অন্যদিকে, চাঁদাবাজরা প্রতিপক্ষ হলে পান থেকে চুন খসার মতো কাণ্ডেই ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটছে। গোটা দলকেই চাঁদাবাজ হিসেবে ভোটের মাঠে কলঙ্কিত করার ব্যয়বহুল প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে যারা রাজনৈতিক চাঁদাবাজির বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে দেশব্যাপী ‘চাঁদাবাজ ঠেকাও’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন, তারা মূলত চাঁদাবাজিভিত্তিক দলীয় অর্থনীতির বাস্তবতাকে পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। অথবা অপ্রাতিষ্ঠানিক মডেলের অপরাধনির্ভর দলীয় অর্থনীতি মানতে পারছেন না। বুদ্ধিজীবী, গণমাধ্যমের ব্যস্ত টকার আর রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরাও ঘটনার গভীরে না গিয়ে ফ্যান্টাসি তত্ত্ব গেলাচ্ছেন।
দশকের পর দশক ধরে বাইনারি তত্ত্বভিত্তিক দেশীয় রাজনীতির অর্থনৈতিক ভিত তৈরি হয়েছে মূলত মাফিয়া চক্রের হাত ধরে। খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, লুটপাট, ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়মসহ সব ধরনের অপরাধের মডেলে। যেকোনো দল, হোক সেটা মহামানব, দেশরত্ন, লৌহমানব, অপোষহীন, গণতন্ত্রের মানসপুত্র বা কন্যা দ্বারা পরিচালিত, মাফিয়া মডেলের সেই অর্থনীতির চক্র থেকে দলকে উদ্ধার করতে সক্ষম হচ্ছে না। ফলে বছরের পর বছর ধরে অপরাধীরাই হয়ে উঠছেন দলের নিয়ন্ত্রক। যাদের মাধ্যমে পাওয়া অর্থেই টিকে থাকছে দল। যে কারণে দলীয়প্রধানকে মহামানব বানানোর মেগাপ্রকল্পগুলোও মার খায়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গিয়ে গোটা দলকেই মাফিয়া হয়ে উঠতে হয়।
৩.
কিছুদিন আগে ঢাকার এক ওসি ও ভারতে অবস্থান করা এক নেতার ফাঁস হওয়া ফোনালাপ থেকে জানা গেল, দেশে আওয়ামী লীগের (কার্যক্রম নিষিদ্ধ) সক্রিয় কর্মীর সংখ্যা ৪ কোটির বেশি। যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৩ শতাংশ। গ্রাম, ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, বিভাগীয় পর্যায়ের হরেক রকম কমিটির নেতাদের ধরেই সম্ভবত তথ্যদাতা হিসাবটা করেছেন। তবে এক্ষেত্রে প্রশ্ন আসে, বিপুল সংখ্যক এসব নেতাকর্মীর পেশা কী? তারা দলীয় রাজনীতির ফুলটাইম নাকি পার্টটাইম কর্মী? দলের জন্য জীবনবাজি রাখার বিনিময়ে তারা কী পেতে চান? সুনির্দিষ্ট কোনো গবেষণা না থাকায় এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া খুব কঠিন। তবে অনেকেই কিছু ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
কিছুদিন আগে ‘স্ট্র্যাটেজি টক’ নামের পডকাস্টে এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহর সঙ্গে আলাপে এবি পার্টির ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ অর্থনীতিবিদদের বরাত দিয়ে একটি তথ্য শেয়ার করেছেন। জানিয়েছেন, দেশে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থানের যোগানদাতা সরকার বা কোনো কোম্পানি নয়, বড় রাজনৈতিক দলগুলো। আওয়ামী লীগের পতনের পর কর্মসংস্থান হারিয়েছেন ৩৫-৪০ লাখ নেতাকর্মী। ক্ষমতায় থাকাকালীন দলটির গড়ে তোলা ‘ইকোনমিক ইকোসিস্টেম’ থেকে ছিটকে পড়েছেন অন্তত ৪০ লাখ মানুষ। যারা টেম্পুস্ট্যান্ড, বাসস্ট্যান্ড, ফেরিঘাট, হাট-বাজার, গরুর-বাজার, সেতু-ব্রিজ পারাপারে চাঁদা তোলার মাধ্যমে কর্ম খুঁজে পেয়েছিলেন। দলীয় এসব চাঁদাবাজের বড় টার্গেট ছিল শিল্পাঞ্চল, বাণিজ্যিক এলাকা, বাস ও নৌ-টার্মিনাল, বালুমহাল, হাটবাজার, ফুটপাথ, পরিবহনখাত।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, শুধু বাস ও মিনিবাস খাতেই বছরে দলীয় চাঁদাবাজি হয় এক হাজার ৫৯ কোটি টাকার উপরে। শুধু ঢাকার ফুটপাত থেকেই দলীয় মাফিয়া অর্থনীতিতে যুক্ত হয় ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। সারাদেশে খুন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন খাত বিবেচনায় নিলে দলীয় অর্থনীতির আকার বিশাল। অনৈতিক বিবেচিত হলেও এই খাত যেমন বিপুল কর্মসংস্থানের জোগান দেয়, তেমনি দলকে শক্তিশালী অর্থনীতির ভিত্তিও দেয়। নেতাকর্মীদের পরিবারের সদস্য ধরলে এই খাতের অর্থে কোটি কোটি মানুষের খাওয়া-পরা চলে। যাদের কোনো সুনির্দিষ্ট পেশা নেই তারা শুধু মাফিয়া অর্থনীতির সুযোগ নিতেই দলের জন্য জীবনবাজি রাখেন। যেখানে নীতি নৈতিকতা, মানবিকতা, দেশপ্রেমের কোনো বালাই নেই। অর্থ আর ক্ষমতার জন্য শুধুই নির্মম লড়াই। রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে ক্ষমতাসীন দল বাধ্য হয় এই মাফিয়া অর্থনীতির জন্য নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করতে। ব্যারিস্টার ফুয়াদের ভাষ্য, চাঁদাবাজরা সব সময়ই ক্ষমতাসীন দলের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকেন।
৪.
ভোট ও ক্ষমতামুখী দেশের অন্যতম প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের কয়েকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তারা প্রায় কাছাকাছি শক্তিধর। জনসমর্থন বা ভোটার সমর্থন ৩০-৪০ শতাংশ। বিএনপির প্রায় সমান সংখ্যক নেতাকর্মী রয়েছে আওয়ামী লীগেও। ২০২০ সালের ২২ অক্টোবর ডেইলি স্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তথ্য দেন যে, তাদের প্রায় ৩৫ লাখ নেতাকর্মীর নামে লক্ষাধিক মামলা দেওয়া হয়েছে। এ তথ্যের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায়, বিএনপি আর আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের সক্রিয় নেতাকর্মীর সংখ্যা কাছাকাছি। দলীয় অর্থনীতির আকারও প্রায় সমান। যদিও ১৬ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকায় বিএনপির দলীয় অর্থনীতি নড়বড়ে হয়ে গেছে। যা পুনর্গঠনের দিকে এগুচ্ছে।
বলা বাহুল্য, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দলভিত্তিক মাফিয়া অর্থনীতির কাঠামো বদলানোর দাবি উঠেছে সর্বত্র। কেননা, বিগত সময়ে ক্ষমতাসীন দলগুলো মাফিয়া অর্থনীতির যে ভয়াবহতা দেখিয়েছে, তা দেশের মূলধারার অর্থনৈতিক কাঠামোকেই ধসে দিয়েছে। বিপুল অর্থ দেশের বাইরে চলে গেছে। সাধারণ মানুষকে ভয় আর আতঙ্কে রেখে ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট হয়েছে নির্বিচারে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, দলীয় বা রাষ্ট্রপ্রধানকে দম্ভ করে বলতে হয়েছে, তার পিয়নও চারশ কোটি টাকার মালিক!ক্ষমতাভিত্তিক মাফিয়া অর্থনীতিই দেশের ঐতিহ্যবাহী আলোকিত রাজনীতিকে ঠেলে দিয়েছে ঘোর অন্ধকারে। সাধারণ ছাত্র-জনতাকে করে তুলেছে রাজনীতিবিমুখ। যার করুণ পরিণতি আওয়ামী লীগ সরকারের লজ্জাজনক পতন।
প্রকৃতপক্ষে মাফিয়া অর্থনীতির পেছনে থাকে অপরাধ, ভয়ংকর খুন-খারাপি। যা দেশীয় সন্ত্রাসবাদকে সর্বজনীন রূপ দেয়। প্রচলিত মূল্যবোধ নষ্ট করে, সামাজিক অপরাধকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়। রাষ্ট্রের সব শক্তি প্রয়োগ করেও যা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। কারণ, মাফিয়া অর্থনীতির সঙ্গে কোটি কোটি মানুষের জীবন ও অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত। সেজন্যই মনে হয় জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট ফাহাম আব্দুস সালাম সম্প্রতি লিখেছেন, ‘একটা দেশের এক-তৃতীয়াংশ তরুণ যদি বেকার হয়—সেখানে সন্ত্রাস কমানো যাবে না। এটাই মানুষের প্রকৃতি। যারা মনে করে যে ভালোবাসা দিয়ে বা ডান্ডা দিয়ে ঠান্ডা করা সম্ভব— তারা সব ছাগল। সেখানে মানুষ ছিনিয়ে নেবে। কোনো না কোনোভাবে। আপনি যেমন ইচ্ছা ফ্যান্সি পলিটিক্যালি কারেক্ট নাম দেন- সেটা মব ভায়োলেন্সই হবে। সেটা এক্সটর্শনই হবে। একটা দেশের কোটি কোটি তরুণ যদি সকাল বেলায় কোনো অর্থকরী কাজ না করে- সেই দেশের ভবিষ্যৎ গোমাসা। প্রত্যেক পার্টির চিন্তা হওয়া উচিত, কেমন করে আমাদের তরুণদের কর্মসংস্থান তৈরি করা যায়।’
৫.
বামপন্থি আর ধর্মভিত্তিক কিছু রাজনৈতিক দলের মধ্যে নিজস্ব তহবিল থেকে নেতাকর্মীদের ভাতা, পারিশ্রমিক বা সহায়তা করতে বিশেষ কিছু প্রকল্প হাতে নিতে দেখা যায়। যার মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দলের কর্মকাণ্ড পরিচালনার পাশাপাশি কর্মীদের পরিবারের জন্য ব্যয় করা হয়। কোনো কোনো দল যৌথ অর্থনৈতিক প্রকল্পের মাধ্যমে প্রান্তিক নেতাকর্মীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করে থাকে। তবে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই চর্চা একেবারেই অনুপস্থিত। তারা পাড়া-মহল্লায় দলীয় কমিটির মাধ্যমে ঘরে ঘরে সভাপতি আর সেক্রেটারি বানিয়ে ভোটের রিজার্ভ ব্যাংক তৈরি করলেও নিজস্ব তহবিল গঠনের মাধ্যমে নেতাকর্মীদের সহায়তা বা কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেয় না।বরং তারা জনসম্পদ বা রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সম্পদ যেমন স্থানীয় হাটবাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ফুটপাত, খাসপুকুর, পরিবহনখাত থেকে চাঁদা উত্তোলনের মাধ্যমে অর্থ আয়ের অঘোষিত নির্দেশনা দিয়ে থাকে। যা শেষ অবধি দেশে সন্ত্রাস আর মাফিয়াতন্ত্রের জন্ম দেয়, যা সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলে।
শুধু কি তাই? কোনো ক্ষমতাসীন দলকে আজ অবধি মহাপরিল্পনার মাধ্যমে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে দেখেছেন?অর্ধশিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তায় কার্যকর পদক্ষেপ আজও নেয়নি কোনো দল। বরং ক্ষমতা আর অর্থের লোভ দেখিয়ে মেধাবী তরুণদের গণহারে দলে টেনেছে। হরেক রকম কমিটি বানিয়ে দলীয় অপরাধীতে পরিণত করার মাধ্যমে তাদের উজ্জ্বল শিক্ষাজীবন নষ্ট করেছে। বিকল্প কর্মসংস্থানের জোগান হিসেবে মাফিয়া অর্থনীতির ভাগীদার করেছে। ক্ষমতা-অর্থের মোহ আর প্রভাবশালী হয়ে ওঠার স্বপ্নে কোটি কোটি তরুণ অন্ধকারে পা রেখেছেন। বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের পথ ছেড়ে তারা জড়িয়ে গেছেন সন্ত্রাসী, মাফিয়া ও কিশোর গ্যাং চক্রে। যে চক্র রাজনীতির মূলধারাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছে। বিগত সরকারের সময়ে এভাবেই দলীয় মাফিয়া অর্থনীতিতে ডুবে গিয়েছিল গোটা দেশ।
পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রতি বছর চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে ২২ লাখ তরুণ। যার মধ্যে বিসিএসে প্রায় দুই হাজার সুযোগ পান। বাদবাকি অন্যান্য খাত মিলিয়ে কর্মসংস্থান হয় দেড় লাখের মতো। আবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব বলছে, গেল এক দশক ধরে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৫ থেকে ২৭ লাখের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে। যার মধ্যে মাত্র দেড় দুই লাখ চাকরির নিশ্চয়তা পেলেও বাকি ২৩-২৫ লাখ কোথায় যাচ্ছেন? দেশের বাইরে? ব্যক্তিগত বা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে প্রায় এক কোটি মানুষ মনমতো কাজ পান না। তারা পড়াশোনাও করেন না। তারা ছদ্মবেকার। কোনো রকম জীবনধারণের জন্য যেকোনো কাজ বেছে নেন। দেশে মব, সন্ত্রাস, অপরাধের উৎস কি এসব বেকারের কর্মহীনতার ক্ষোভ?
৬.
দলভিত্তিক মাফিয়া অর্থনীতির বিকাশকে বৈজ্ঞানিক লেন্সেও ব্যাখ্যা করা যায়। জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট ও চিন্তক লিহন প্রাইম (নোভা) তার সাম্প্রতিক এক লেখায় তেমনটাই তুলে ধরেছেন। লিখেছেন, ‘দেশে শিক্ষিত বা অশিক্ষিত যা-ই হোক, মানুষের হিংস্রতার মাত্রা চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেছে। তবে এর জন্য কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠী বা ব্যক্তি দায়ী নয়। বড় সমস্যা হচ্ছে, লিমিটেড স্পেস ও রিসোর্স। যা ম্যাথম্যাটিক্যাল, পলিটিক্যাল নয়। একটি ক্ষুদ্র মানচিত্রের ভেতর প্রায় ২০-৩০ কোটি মানুষ আটকে আছে। উচ্চ জনসংখ্যা, সীমিত সম্পদ, অপ্রতুল চাকরি, স্বাস্থ্যসেবা, ন্যায়বিচারের অভাব— এসবকিছু মানুষের মধ্যে সবসময় ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্স জাগিয়ে রাখে। যা মানুষের জেনেটিক স্বার্থপরতাকে ট্রিগার করেছে। ফলে তারা যৌক্তিক চিন্তা করতে অক্ষম হয়ে পড়েছেন।’
লিহন প্রাইমের ব্যাখ্যার সম্পূরক যুক্তি হিসেবে বলা যায়, মানুষের এই যৌক্তিক চিন্তার অক্ষমতারই সুযোগ নিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। তারা ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ মডেলে জনগণের সম্মতিকে লুটে নিচ্ছে। স্বাধীন মতামত দমিয়ে দলীয় ন্যারেটিভকে মহিমান্বিত হিসেবে গিলিয়ে ঘরে ঘরে অন্ধ সমর্থক তৈরি করছেন। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত মার্কিন লেখক, রাজনৈতিক অ্যাকটিভিস্ট ও দার্শনিক নোম চমস্কিকে স্মরণ করা যায়। ‘ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট’ বিষয়ে দেওয়া এক বক্তব্যে চমস্কি বলেছিলেন, “জনগণ হচ্ছে বিভ্রান্ত পশুর পালের মতো। বল প্রয়োগে তাদের নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ না থাকলে ‘ক্যালকুলেটেড ম্যানুফ্যাকচার অফ কনসেন্টের’ মাধ্যমে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা হয়।” প্রকৃতপক্ষে, রাজনৈতিক নেতারা জনগণকে আগে পশুর পাল বানান। তারপর তাদের নিয়ন্ত্রণের কৌশল প্রয়োগ করেন।
সীমিত সম্পদ আর অপ্রতুল চাকরির দেশে কয়েক কোটি বেকার তরুণ নিয়ে দলীয় রাজনীতির যে অর্থনৈতিক মডেল দাঁড়িয়ে গেছে তা বাস্তবতা হলেও ভবিষ্যতমুখী নয়। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এমন দেশে বিদ্যমান সংকটের মধ্যে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যে ধরনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া জরুরি সেরকম কোনো পদক্ষেপ ভোট আর ক্ষমতামুখী বড় রাজনৈতিক দলের সক্ষমতার বাইরে। কারণ, এসব দলের নীতিনির্ধারকদের বেশিরভাগই একবিংশ শতকের বৈপ্লবিক প্রযুক্তিভিত্তিক পরিবর্তনের সংকট বোঝেন না। ‘আই হেইট পলিটিক্স’ দৃষ্টিভঙ্গির তরুণদের রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব পড়তে পারেন না। সত্তর বা আশির দশকের রাজনৈতিক লেন্স দিয়ে তারা একবিংশ শতককে দেখছেন। দলীয় সংস্কার তাদের কাছে একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। দলের অপরাধনির্ভর মাফিয়া অর্থনীতি থেকে বের হওয়ার তাগিদও অনুভব করেন না। ফলে আগামীতে চাঁদাবাজির রাজনীতি যে বদলাবে না তা বলাই যায়।
লেখক : সাংবাদিক
- বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bkeditorial247@gmail.com