Logo

মতামত

গত শতাব্দির পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে

Icon

মো. কামরুল ইসলাম

প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০২৫, ০৯:২৫

গত শতাব্দির পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে

সঠিক নেতৃত্ব তৈরির কারিগর ছিল দেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ। ডাকসু, চাকসু, রাকসু, জাকসু, শাকসু, বাকসু— এই সব ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কথা নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে। এমনকি ঢাকা কলেজ, রাজশাহী কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ, ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ, বরিশালের বিএম কলেজ, কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজ, চট্টগ্রামের মহসিন কলেজ, সিলেটের এমসি কলেজ, রংপুরের কারমাইকেল কলেজ, খুলনার বিএল কলেজ এবং যশোরের এমএম কলেজসহ দেশের প্রায় সব সরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতো। এসব নির্বাচনের মাধ্যমে গড়ে উঠত নেতৃত্ব, যার অনেকে পরবর্তীকালে জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

গত শতাব্দীর শেষ প্রান্তের সেই চেনা পদধ্বনি আবারও যেন শোনা যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে— জুলাই আন্দোলনের ফল হিসেবে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনের কারণে। ইতোমধ্যে ডাকসু ও রাকসুর নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হয়েছে। বলা চলে, জাতীয় নির্বাচনের আগে এসব ছাত্র সংসদ নির্বাচন এক ধরনের গণতান্ত্রিক রিহার্সেল।

আশি ও নব্বই দশকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ইসলামী ছাত্রশিবির, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র মৈত্রী, ছাত্র ফেডারেশনসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন কেন্দ্রীয় ও হল সংসদ নির্বাচনে প্যানেল গঠন করে অংশগ্রহণ করত। কেউ এককভাবে, কেউবা যুগপৎ মৈত্রীর মাধ্যমে। ক্যাম্পাসে সৃষ্টি হতো উৎসবমুখর পরিবেশ। যেন এক রঙিন ঈদ আসতো ছাত্রছাত্রীদের মাঝে। প্রতিবছর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের অপেক্ষায় থাকত সবাই।

একসময় ছাত্র সংসদ নির্বাচন থেকেও সরকার পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলত। ধারাবাহিক ছাত্র সংসদ নির্বাচনের শেষ ধাপ ছিল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ, অর্থাৎ শাকসু নির্বাচন, যা সর্বশেষ অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৭ সালে। দীর্ঘ বিরতির পর ‘এসিড টেস্ট’ হিসেবে পরিচিত হয় ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচন। কিন্তু সেবার ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের ভরাডুবির পর আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়নি আওয়ামী লীগ সরকার।

ঠিক যেভাবে জাতীয় নির্বাচনসহ অন্যান্য নির্বাচনব্যবস্থা বছরের পর বছর অব্যবস্থাপনা ও দলীয় প্রভাবের বলি হয়েছে, একইভাবে ধ্বংস হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচনব্যবস্থাও। তবে জুলাই আন্দোলনের পর, বিশেষ করে ৫ আগস্টের পর থেকে দেশজুড়ে পরিবর্তনের যে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, সেটি যদি স্থায়ী হয়— তাহলে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সঠিক নেতৃত্ব তৈরির সুযোগ তৈরি হবে।

ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যক্রমের বাইরেও নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতো। এর অভাবে মাদকাসক্তি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির মতো অনৈতিক প্রবণতা বেড়েছে।

জুলাই আন্দোলনের পূর্ণ সুফল এখনও আমরা ঘরে তুলতে পারিনি, যার প্রধান কারণ রাজনৈতিক সহনশীলতার অভাব। তবে এই আন্দোলনের ফল হিসেবে জাতীয় রাজনীতিতে তরুণ নেতৃত্বের উত্থান ঘটেছে। 'জুলাই স্পিরিট' ধারণ করে গত এক বছরে ডজনখানেক নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করেছে, যাদের হাতেই ভবিষ্যতের রাজনীতির ভার পড়বে।

জুলাই আন্দোলনের স্বীকৃতির প্রেক্ষাপটে স্পষ্ট করে বলা দরকার— এটি ভাষা আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধের কোনো বিকল্প নয়। ভাষা আন্দোলন আমাদের মাতৃভাষাকে রক্ষা করেছে, আর মুক্তিযুদ্ধ আমাদের এনে দিয়েছে একটি স্বাধীন বাংলাদেশ— যা আজ বিশ্ব মানচিত্রে একটি গর্বিত পরিচয়।

২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলন বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছে— ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধে স্বৈরশাসন কাবু হয়ে যায়। সাহস, আত্মত্যাগ ও দৃঢ়তা দেখিয়েছে এই প্রজন্ম। আবু সাঈদ, মুগ্ধদের মতো অনেকেই বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে লড়েছে, দিয়েছে আত্মত্যাগ— যা ভবিষ্যতের বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে।

স্যালুট জানাই জুলাই আন্দোলনের সাহসী সৈনিকদের— তাদের প্রতি যারা দেশের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়েছে। এটি ক্ষমতালিপ্সুদের জন্য একটি কঠিনতম বার্তা— যে বাংলাদেশিরা কখনও মাথা নত করে না।

আমাদের প্রত্যাশা, দেশের সকল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সংস্কৃতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হোক। শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে গড়ে উঠুক সঠিক নেতৃত্ব। বিশ্ব দরবারে আত্মপ্রকাশ করুক বাংলাদেশ একটি যোগ্য ও গর্বিত জাতি হিসেবে। আর আমাদের ছাত্ররা হয়ে উঠুক আগামীর বাংলাদেশের রূপকার।

মো. কামরুল ইসলাম : সাবেক জিএস, শাকসু (১৯৯৪–১৯৯৫); সাবেক প্রেসিডেন্ট, সাস্ট ক্লাব লিমিটেড (২০১৯–২০২১), শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

  • বাংলাদেশের খবরের মতামত বিভাগে লেখা পাঠান এই মেইলে- bkeditorial247@gmail.com
Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর